ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ

মায়ামৃদঙ্গ ও আলকাপের সৈয়দ মোস্তফা সিরাজ

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

মায়ামৃদঙ্গ ও  আলকাপের   সৈয়দ মোস্তফা সিরাজ

বাংলা উপন্যাসের বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকগত নিরীক্ষার উৎসাহী লেখক সৈয়দ মোস্তফা সিরাজ, উপন্যাস সাহিত্যকে স্বাধীন-প্রাজ্ঞ শিল্পরূপে পরিপূর্ণ ও স্বকীয় বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল করেছেন,শুধু একজন সফল বা শক্তিশালী সাহিত্যিকই নন, মানবিক মূল্যবোধ ও শাশ্বত অনুভূতির রূপকার। জীবন দর্শনের গভীরতায় নয়, চরিত্র-চিত্রণ-ভাষা বর্ণনা বা বিশ্লেষণে সিরাজ শিল্পকুশলী এক নান্দনিক কথাশিল্পী। সমাজচেতনা ও মানবিক চেতনা এই দুয়ের সম্মিলিত প্রকাশ তার সৃষ্টিকর্মের সবচেয়ে পরিস্ফুট বৈশিষ্ট্য। গ্রামের সহজাত জীবনের চিত্রার্পণ-মধ্যবিত্তের আত্মহুতি-অর্ন্তযন্ত্রণা-মনোবিকোলন সমস্যা কিংবা মিথ বা ঐতিহৃ চেতনা, শ্রেণীদ্বন্দ্ব, প্রতিক্্িরয়াশীল রাজনীতির দাপট ইত্যাদি চেতনাগত আখ্যান নিরূপণে তিনি স্বতন্ত্র আঙ্গিকের জন্ম দিয়েছেন স্বীকার করতেই হয়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের উপন্যাসের স্বর সাধারণত গ্রামীণ জনপদের সুখ-দুঃখ আর ভালোবাসার সম্মিলিত প্রয়াস। শরৎচন্দ্রের মতো গ্রামবাংলার সেই পুরানো ঘ্যাঁনঘ্যাঁনানি নয়, বস্তাপঁচা একঘেঁয়ে প্রেম নয়, বাস্তবতার নিরিখে তার চরিত্রগুলো উঠে আসে সজিব হয়ে, অজস্রফুলের মতো ফুটে ওঠে কাহিনীর ডালপালা। মালদাহ-মুর্শিদাবাদ অর্থাৎ রাঢ়অঞ্চলের লোকনাট্য বা লোকসংস্কৃতির একটা বড় নিদর্শন আলকাপ, আঙ্গিক প্রায় যাত্রাধর্মী হলেও ‘নাচিয়ে ছোকরা’ ই বড় আকর্ষণ, যাতে ‘বিরল মায়া’ সৃষ্টির জুড়ি নেই। ‘মায়ামৃদঙ্গ’ (১৯৭২) তার ফেলে আসা জীবনেরই একটা খন্ডাংশ, ‘নীলঘরের নটী’ (১৯৬৬) বা ‘নিশিলতা’ (১৯৬৭) উপন্যাস দুটো রাঢ়বাংলার প্রান্তিক প্রাকৃত জনসমাজের পটভূমিতে রচিত, আলকাপ দল নিয়ে মেলায়-মেলায় দিনরাত্রি যাপনের সময় সার্কাস দলের মানুষজনের গাল-গপ্প এবং তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিয়ষাদি নিয়ে আলাপ-পরিচয়ের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই সিরাজ লিখেছেন ‘নীলঘরের নটী’, সেখানে যাত্রার ভেতর-বাইরের অনেক অজানা রহস্য লুকিয়ে, যা খুলেছেন তিনি পাঠকের সামনে এবং রাণীচকের রুদ্রদেবের মেলাকে মূল পটভূমি করে নির্মিত হয় ‘নিশিলতা’ দশজন বিক্রেতার মতো বিনোদিনী রুদ্রদেবের মেলায় আসে পানের পসরা সাজিয়ে, প্রতিবছর বিভিন্ন মেলায় ছোটে, পান বিক্রি তার পেশা-নেশা, বয়স হয়েছে, শরীরে আর তাগদ নেই, তবু আসে প্রাণের আর্কষণে, সদ্যযুবতি ভাইঝি নিশিলতাকে আনে, সরলা-নিস্পাপ গ্রাম্য কিশোরী, ভালোমন্দ বোঝার সাধ্যি হয়নি, মেলায় মস্তান গোবরার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে, ভালোবাসা-অনুরাগ-বিরাগ যে টানাপোড়েন তৈরী করে, তা মানতে পারেনি নিশির বাপ-পিসি বা অন্যরা, শেষাবধি গোবরার মৃত্যুতে সম্পর্কের যবনিকা ঘটে। ‘মায়ামৃদঙ্গ’ আলকাপ দলের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না নিয়েই নির্মিত, সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেরই বোহেমিয়ান হওয়ার একটা প্রবণতা থাকে, মনে-মনে হলেও থাকে কেনো না লেখকজীবনের অভিজ্ঞতা তার লেখালেখিতে আনে বৈচিত্র্য-আনে বর্ণময়তা-আনে ভিন্ন সুর, সেই প্রেক্ষাপট স্মরণ রাখলে বাংলাসাহিত্যের একজন প্রবাদপ্রতীম সাহিত্যিক প্রকৃত অর্থেই ছিলেন বোহেমিয়ান, তিনি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তারাশঙ্করীয় দৃষ্টিভঙ্গির উত্তরণ ঘটেছে তার লেখনিতে, প্রান্তিক জনপদের বাঁচা-মরার অভিখ্যানও বটে, রাঢ় বাংলার জীবন-ভৌগোলিক পরিমন্ডল-প্রাকৃতিক প্রতিবেশ-আঞ্চলিক সংস্কৃতি, সবই মূর্তি হয়ে ওঠে তার শিল্পভূবনে। তারাশঙ্করের ‘ কবি’ উপন্যাসে রাঢ়বাংলার কবিয়ালের জীবনকথা বিবৃত হয়েছে। রাঢ় বাংলার নিভৃত গ্রামাঞ্চলে যে লোকসংস্কৃতির নিজস্ব ধারা আপন ঐতিহ্য অনুরক্ত হয়ে যুগ পরম্পরায় লোকরঞ্জনে নিবেদিত, তার সাথে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক যুক্ত জীবনের অন্তলীন উল্লা ও ক্ষয়কে তারাশঙ্কর তার ‘কবি’তে চিত্রায়িত করেছেন। মেলায়-মেলায় ঘুরে বেড়ানো ঝুমুর দলের প্রায় অজ্ঞাত ও অবহেলিত জীবনের কথামালাতে অনবদ্য দক্ষতার সঙ্গে উপন্যাসে তুলে ধরা হয়, অথবা ‘ হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (১৯৪৬) য় কোপাই নদীর বাঁকে কাহার গোষ্ঠির জীবন তথা সমাজ বিন্যাসের ভেঙ্গে গড়ার গভীর স্বপ্নে লেখক নিয়ন্ত্রণ করেছেন কালস্রোতের স্বাচ্ছন্দ গতিতে। আধার করেছেন লোকসংস্কৃতির উপাদানকে, সারাবছর ধরে ভাদু-ভাঁজোর গান, ঘেঁটু গানের যে উৎসব হয় তারই রেশ ছেলে-ছোকরাদের গান-বাজনার আসর। তাছাড়া ধর্মরাজের বোলান গান, মনসার ভাসান গানও প্রায়শই গীত হয়। লেখক বলেছেন, হাঁসুলী বাঁকের জীবন মন্থর গতিতে, পায়ে হাঁটা আলপথে পদাতিকের জীবন, সে জীবনে পাল্কীবাহন-কৃষিকাজ-গো চারণ-আখের গুড় তৈরীর অবসরে উৎসব আনন্দ-মদ্য মাংস-নারী। বাঁশবাদি গ্রামে কাহারদের পরিচিতি দিতে গিয়ে তারাশঙ্কর হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ য় বলেছেন, দুই পুকুরের পাড়ে দুটি পাড়া, বেহারা কাহার এবং আটপৌরে কাহার; হরিজন যাদের বলা হয়, এদের মধ্যে যারা পাল্কী বয়ে থাকে তারাই কাহার, কাহার সম্প্রদায়ের কাহিনী উঠে এসেছে এভাবেই, অনুরূপ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বৈতালিক’ উপন্যাসে রাঢ়ের আলকাপের মানুষের কথপকথন চিত্রায়িত হয়েছে, লোকসংস্কৃতিসেবী মানুষের অস্বাভাবিক সম্পর্কে গ্রথিত জীবনের প্রতিফলক এ’ উপন্যাসে বিদ্যামান। ‘মায়ামৃদঙ্গ’ একাধারে আত্মজৈবনিক এবং ডকুমেন্টারী উপন্যাস। সিরাজের ভাষায় ছয়/সাতটা বছর, সে এক লম্বা আশ্চর্য মায়াময় জীবন, সৌন্দর্য-পাপ বা অমৃত বিষ নির্দ্বিধায় আস্বাদন করতে-করতে নীলকন্ঠি হয়ে যাওয়া। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত আলকাপ দলের মাষ্টার ছিলেন তিনি, দল এবং দলের লোকজন এবং তার নিজেকে নিয়েই সময়টা কেটেছে, সবটুকুই মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। ১৯৪৫ সালে নিজের গ্রাম খোশবাসপুরে একটি আলকাপ দল গঠন করে। সে দল চলতেই থাকে, ১৯৫০ সালে প্রকৃতপক্ষে সিরাজ সাঁওতাপাড়ার আধুনিক আলকাপ দলে যোগ দেন, তবে দলের ওপর কিঞ্চিৎ রাগ করে সাঁওতাপাড়ার দল থেকে ১৯৫৩ সালে চলে যান মহালন্দির সন্নিকটস্থ ডাঙাপাড়ার দলে, ১৯৫৪ সালে আবার যোগ দেন নবগ্রাম থানার পলাশগ্রামের আলকাপে। দু’ বছরের অধিককাল পর—-এ’ দল থেকে সিরাজ আলকাপ ছেড়ে দেন সাহিত্য চর্চার তাগিদে। কর্ণসূবর্ণের কাছে ভরাট-এ ওস্তাদ ঝাঁকসার দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সাঁওতাপাড়ার দল বায়না পেয়ে সিরাজ মাষ্টারের ডাক পড়ে, তখন গাতলার কোবাদ গোমস্তার বাড়িতে ছিলেন তিনি। সেখানে তার গান শুনে ওস্তাদ ঝাঁকসা প্রশংসা করেন, এবং ঝাঁকসার গান শুনে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন। তারপর দুজনে নলহাটির নিকটে গোবিন্দপুরের কাছাকাছি কোনো এক জায়গায় গান গাইতে যায় সাঁওতাপাড়ার দল। বিপক্ষে ছিলেন গোবিন্দপুরের মনকির হোসেন। দু’দিন গান গাওয়ার পর ঝাঁকসা চলে যায়, সাঁওতাপাড়ার দল গান করতে থাকে। সেখানে এক বাল্যসঙ্গিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় সিরাজের, তারা একসময় হাবোল গোঁসায়ের কাছে গান শিখতো একসঙ্গে, সেই সঙ্গিনী তখন এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকের স্ত্রী, তাদের বাড়ি যাওয়ার এবং খাওয়ার নিমন্ত্রণ পায়, সিরাজ দলের ছোকরা সুধীর দাসকে সঙ্গে নিয়ে খেতে যায়, ১৯৫৩ সালে সুধীর সাঁওতাপাড়ার দল ছেড়ে চলে যায়, সিরাজও ওইসময় দল ছাড়েন। লোকনাট্য আলকাপের সঙ্গে সিরাজের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার কথা রয়েছে ‘মায়ামৃদঙ্গ’ উপন্যাসে, যার আখ্যান গড়ে উঠেছে দুই ছোকরা শান্তি এবং সুবর্ণ-কে ঘিরে। উপন্যাসে ওভাবেই গল্পটি এসেছে, আনিস তাকে গাতলার কোবাদ গোমস্তার বাড়ি থেকে সাইকেলে করে কর্ণসূবর্ণের কাছে ভরাটে নিয়ে যায়। সেখানে সিরাজ অর্থাৎ সনাতন রায় পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ওস্তাদ ঝাঁকসাকে এবং জয়ধ্বনি দেয়, দলের ছোকরা মায়া আর্কষণ করতো, সিরাজ নিজেই লিখেছেন, ‘১৯৫০ সালের শেষ দিকে একটা বাঁশের বাঁশী ফিরিয়ে নিয়ে গেলো গ্রামীণ মিথের সুপরিচিত জগতে, কাটতে থাকলো দিনরাত্রি গাঁয়ে-গঞ্জে হাটে-বাজারে মাঠে-ঘাটে নানান জেলায়, অজস্র মানুষ চাক্ষুস করলাম, বিচিত্র-বিস্ময়কর সব মানুষের বেশ-বাস চেহারা-সুরোত, মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-মালদাহ-সাঁওতাল পরগণা দুমকো ঘুরে বেড়াই আলকাপ দলে, মেয়েদের হৃদয় ও মুখমন্ডল বিশিষ্ট তরুণ পুরুষের শরীরে কিংবদন্তীর গ্রামপরীরা কিভাবে অনুপ্রবেশ করে দেখেছি, দলের ছোকরার প্রেমে পড়েছি, অচরিতার্থ কামনায় জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে ধিকি ধিকি মরেছি, ঝাঁকড়ামাকড়া চুল নাড়া দিয়ে দোহারকিরা আগুনের হল্কার মতো লোকগাঁথার বিস্ফোরণ ঘটায়, হাজারো গ্রামীণ অভাজন মানুষের ভীড়ে সামিয়ানার তলায় ধ্বনি ওঠে, জয়-জয় মা বাকবাদিনী কী জয়/জয়-জয় ওস্তাদ তানসেন কী জয়/জয়-জয় ওস্তাদ সিরাজ কী জয়’... ‘মায়ামৃদঙ্গ’ উপন্যাসে ওস্তাদ ঝাঁকসা গাইয়ে হিসেবে প্রতীয়মান, শান্তিকে গান শিখিয়েছেন আদরে বিহলতায় গভীর নেশায় প্রত্যক্ষ করেছেন নিজের সৃষ্টিকে। সেই ওস্তাদকে নিঃস্ব করে শান্তি পালিয়ে যায়। ঝাঁকসা নিথর-পাথর হয় তারপর, সংসার সুখের হয়নি। আলকাপের দলের ওস্তাদের নসিবে সুখ বলে কিছু নেই। চারদিকে শুধু ধাক্কা, মান-সম্মান থাকলেও সেটা গুটিকয়েক মানুষের চোখেই। কিন্তু বিশাল মানুষ উপেক্ষার চোখে দেখে। লোকশিল্পের বাহন কথাটা মাথায় আজ গভীরভাবে বসে গেছে, ধনঞ্জয় সরকার বা ঝাঁকসার ওস্তাদ ছিলেন মনিরুদ্দিন, সেই মনিরুদ্দিন মারা গেছে কালুখাঁর দিয়াড়ে তার গোর। ওস্তাদ মনিরুদ্দিন শেষজীবনে তওবা পড়ে শরীয়াতে মন দেয়, একদিন কোরআনের আয়াত শোনায়, সাদ আর গোমরাহ নামে দুটো শহর ছিলো, দুটো জাতি সামুদ আর আদ, সেখানে পুরুষ হয়ে পুরুষের কাছে যেতো, একে অপরকে আউরাতের মতো ভালোবাসতো, প্রাণের রৌশন বিলিয়ে দিতো, পরিণামে আল্লাহ পাকের হুকুমে দুটো শহর দুটো জাতি ধ্বংস হয়ে গেলো। ওস্তাদ ঝাঁকসার কাছে উপদেশবাণী ভালোলাগেনি, হিন্দুর বেদপুরাণ যার কন্ঠমুখে বাস, মাথায় সন্নেসীদের মতো লম্বা চুল, চাঁছায় গাল, ধারলো গোঁফ, সেই লোক আজ অজানা আতঙ্কে কাঁপছে, মানুষটা কি পাগল হয়ে গেলো শেষকালে। ওস্তাদ ঝাঁকসার মতো আরেক অসুখী সনাতন কুমার রায় অর্থাৎ সোনাবাবু বা সোনাদা, গানের মাষ্টার, কন্ঠে যাদুর বাস, কয়েকমাস কলকাতায় হন্যে হয়ে ঘুরেছে ভাগ্য পরিবর্তন করতে কিন্তু সে দরোজা তার সামনে খুলে যাওয়া অলৌকিক ঘটনা, ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, তারপর আলকাপের মাষ্টার হয়, ‘সুবর্ণ’ নামের কোমর দোলানিকে তার কোনোমতে পুরুষ ভাবতে ইচ্ছে করে না। ভুল জেনেও চোখে মায়া জড়িয়ে থাকে, যেন সদ্য যৌবনাবতী কিশোরী, হাসিতে-কটাক্ষে বাকভঙ্গিমায় চলনে সে ছবি স্পষ্ট, এমন কি ওর দুই বাহু-আঙুল-গ্রীবা-বক্ষদেশ-চিবুক-কোমর-নিতম্ব-উরু-নিতম্বের নাচন থেকে পায়ের পাতা, নিটোল কমনীয় তার সুঠাম শরীরখানা নটীর দেহলতা, মুখশ্রীতে বিদ্যুৎ খেলে। সোনাডাঙার মেলায় ওর গান শুনেছিলো প্রথম, সে রাত্রে থেকেই সোনাবাবু বিমূগ্ধ চাতক। সুবর্ণকে ভালোবাসে, আদর করে, চুমো খায়, জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে, সুবর্ণ’র প্রতি তার অদ্ভূত দূর্বলতা এ যে ‘বিরল মায়া’ তাকে ছাড়া জীবন যে পোড়া কাষ্ঠ। সিরাজ প্রধানত ‘ মায়ামৃদঙ্গ’ উপন্যাসে সমকামী যৌনচেতনার দিকটিকে আলকাপ দলের শিল্পরীতির অনুষঙ্গে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন, চৌদ্দটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত ‘মায়ামৃদঙ্গ’ আখ্যান গঠন-চরিত্র চিত্রন-দেশ কালের পরিচয় ও লেখকের জীবনদর্শনে এক অনবদ্য কাহিনীমালা হয়ে উঠেছে বলতেই হয়। ঝিঁঝিডাঙায় গানের আসরে আলকাপ দল ভাড়া পায়। নলহাটির দিকে জায়গাটা। গানের আসরে সনাতন মাষ্টারের গান যেন আলোর তুফান। মন ভরিয়ে দেয় শ্রোতার, চোখ জুড়িয়ে দেয় সুবর্ণ’র শরীরি আকর্ষণ, সেখানে একদিন সুধার সঙ্গে দেখা, দুজনে একসময় হাবল গোঁসাইজীর কাছে গান শিখতো, সেই ভদ্রপুরের মেয়ে সুধামুখীর বিয়ে হয়েছে ঝিঁঝিডাঙার কোনো এক স্কুলের পন্ডিতের সঙ্গে। বিয়ের সময় সনাতন কলকাতায় ছিলো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, বিয়ের পর প্রৌঢ় পন্ডিত স্বামী নিয়ে সুধা যে সুখী নয়, শ্বশুরবাড়ি এসে গানপ্রিয় সুধা নিজেকে ভেঙে ফেলেছে, সনাতন সেই সুধাকে দেখে, তার জীবনের অসহৃ কষ্ট দেখে ব্যাথিত হয়। হঠাৎ নিজের ওপর অসম্ভব রাগও হয় সনাতনের। সুধার ভালোবাসার মূল্য দিতে পারেনি, চন্ডাল সে যেন। ইতর অভাজন চাষাভূষোদের সামনে বাহাবা কুড়োবার জন্য জীবন উৎসর্গ, নিজেকে দীনহীন ছন্নছাড়া মনে হয়,ওস্তাদ ঝাঁকসার ওপর রাগটা গিয়ে পড়ে, ওই নিয়ে তার জীবনের উচ্চাকাঙ্খার শেষ নেই, অথচ সুধার বিদ্রুপ কানে লাগে, ‘মিন্সেনাচানো’ কথাটা মৌমাছির দংশনের জ্বালা দিচ্ছে শরীরে। নিজেকে কোনোভাবে ক্ষমা করতে না পারলেও চোখের সামনে আর পথ খোলা নেই। এভাবেই মানুষ সমস্ত অপমান মুখ বুঁজে সহ্য করে নেয়। একবার সুধার শ্বশুরবাড়ি নিমন্ত্রণ পেয়ে সনাতন আর সুবর্ণ যায়, সুধাপদ বাবু রোগা-ঢ্যাঙা-কুঁজো একটা লোক। মাথায় কাঁচাপাকা অল্প চুল, একটা টিকিও আছে, গলায় তুলসী কাঠের মালা, ওমন একটা মেয়ে সুধা, তার কি না ওমন একটা আধাবুড়ো স্বামী, তারপর ফিরে এসে সনাতনের মন খারাপ হয়ে যায়। হাসি-খুশি ভরা ওমন একটা গানের মেয়ের একি দশা, সব অপরাধ নিজের মনে হলেও কোনো পথ নেই ফিরে যাওয়ার। একদিন ঘন অন্ধকার রাত্রে সুধা স্বামীর ঘর ছেড়ে সনাতনের কাছে পালিয়ে আসে। সুধা একসময় বলে, আমি আর ও বাড়ি ফিরে যাবো না, ওখানে আমার সুটকেস আছে, আমাকে বাঁচাও, নিয়ে চলো, মিন্সেনাচানো বাদ দিয়ে আমাকে গ্রহণ করো। সনাতনের আত্মসম্মানে লাগে। আর তাই সে আসর ছেড়ে দল ছেড়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু লক্ষণ বুঝতে পেয়ে সুবর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, ‘একটা মেয়ের জন্য অর্থাৎ সুধাদির জন্য পালিয়ে যাচ্ছেন, কেনো-কেনো যাবেন, আপনার যাওয়া হবে না’। সুবর্ণ মেয়েও নয়, ছেলেও নয়, আবার হিজড়েও নয়, মায়া,ওস্তাদ ঝাঁকসা বলে, মহামায়া, সেই মহামায়ায় আটকে যায়, সনাতন পারেনি পন্ডিতের বউ সুধাকে পালিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু সুধাকে সে’ রাত্রে দলের ছেলে কাবুল অর্থাৎ ঘনশ্যাম এবং নন্দ ধর্ষণ করে এবং নির্মমভাবে গলা টিপে খুন করে। ‘মায়ামৃদঙ্গ’ বাস্তবিক অর্থে কয়েকজন দুঃখী সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের বর্ণলিপি, গ্রামবাংলার ইতরজনের কাছে এই আলকাপওয়ালারা কিছুসময়ের জন্য আনন্দ বিতরণ করে, মানুষকে রঙ্গবঙ্গেরসে সিক্ত করে দিতেই আলকাপ দলের আনন্দ, কিন্তু সিরাজ জানেন এ’সব কুশীলবরা সব নীলকন্ঠ,তামাম বিষ পান করে অমৃতময় আনন্দ দর্শকদের উগলে দেয়, আমজনতা ঘেঁয়ো এবং গেঁয়ো দর্শকরা জানে, তারা যা দেখছে তা সত্য নয়, মানুষের আড়ালে অন্য আরেক ফানুষ, শুধুই চোখের বিভ্রম, যাকে মেয়ে ভেবে তারা উল্লসিত-কামার্ত, সে আসলে মেয়ে নয়, মরিচিকা, যার ভেতর আছে রহস্য, অথচ সে রহস্য ভেদ করা কার সাধ্যি। উপন্যাসের ঘটনার মতো চরিত্রগুলোও বাস্তবভিত্তিক। ভূমিকায় সিরাজ লিখেছেন, মায়ামৃদঙ্গের চরিত্রেরা নামে-স্বনামে এখনো বেঁচেবর্তে আছে এবং পদ্মা-গঙ্গা-অজয়-মষুরাক্ষীর এপার-ওপার যোজনবিস্তৃত অববাহিকায় গ্রাম-গঞ্জ হাটমেলায় উৎসব-নিরুৎসবে লোকগাঁথা বিস্ফোরণ করছে। দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছেন, বিগত শতকের ষাটের দশকের শুরুতেই নাচিয়ে ছোকরা’র বদলে মেয়েদের আলকাপে ঢোকানো হয়েছিলো, কিন্তু মেয়েরা ঝাঁকসা-কথিত ‘বিরল মায়া’ সৃষ্টিতে একেবারে ব্যর্থ হয়। স্বয়ং ওস্তাদ ঝাঁকসাই নিজের কন্যাকে দলে ঢোকান এবং ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি আলকাপের আঙ্গিক সম্পূর্ণ বদলে দিয়ে যাত্রাধর্মী লোকনাট্য পঞ্চরস সৃষ্টি করেন, ভিন্ন মাত্রা হলেও এর আঙ্গিক যাত্রাধর্মী বলার অপেক্ষা রাখে না। আলকাপে দোহাররা খঞ্জনী বাজিয়ে পাত্র-পাত্রীদের গানের ধুয়া দ্রুত থেকে দ্রুততম তালে গেয়ে চরম পর্যায়ে থেমে যেতো, ‘পঞ্চরস’ এই দোহার রীতি সম্পূর্ণ বর্জন করে, অসংখ্য গ্রামে এখন পঞ্চরস অপেরা এভাবেই গড়ে ওঠে। সাঁওতাপাড়া দলের অন্যান্য সদস্যরাও বাস্তবভিত্তিক, আনিস-কাদু ওরফে কাদের, কাবুল ওরফে ঘনশ্যাম,কালা-নফর আলী-আমির প্রভৃতি স্ব-স্ব ভূমিকায় বর্তমান। এদের মধ্যে কালা আর কাবুল ছাড়া সবাই সাঁওতাল পাড়ার লোক। এরা মডুরা গ্রামের। অন্যান্য চরিত্রগুলো, ওস্তাদ ঝাঁকসা ওরফে ধনঞ্জয় সরকার-সুফল-ফজল-মনিরুদ্দিন ওস্তাদ-গোপাল ওস্তাদ-জগু ওরফে ওস্তাদ জগিরুদ্দিন-বোনাকোলা ওরফে বনামালী দাস-আরশাদ ওস্তাদ- সোলেমান ওস্তাদ-মনকির হোসেন-চন্দ্র জুয়াড়ি-ভানু-নাসির-উদ্ধব-বটো-বাঘা মিয়া-পঞ্চনন-প্রসন্ন-কালাচাঁদ-নন্দ-পাতু ওস্তাদ ইত্যাদি নামগুলো উপন্যাসে বর্তমান স্বনামে। সুধাও একটা বাস্তবভিত্তিক চরিত্র, তার মধ্যে ভালোবাসা থাকতে পারে, সে কাউকে না কাউকে ভালোবাসতেই পারে, মায়ামৃদঙ্গে তাকে একটা ভাইটাল ক্যারেকটরে দেখানো হয়েছে মানতেই হয়। ধনপতনগর-চন্ডিতলা-ঘুঘুডাঙা-ঝিঁঝিডাঙা-মদনপুর-ভদ্রপুর-রহিমপুর-বিনোদিঘি-মিঠিপুর-রাঙামাটি-চাঁদপাড়া-বাঘড়ী-জঙ্গীপুর-নলহাটি-আজিমগঞ্জ-সাঁওতাপাড়া প্রভৃতি স্থান উপন্যাসে বর্ণিত হলেও বাস্তবভিত্তিক তাতে সন্দেহ নেই। বৃহৎ রাঢ়অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির স্বকীয় ধারার নিভৃত হৃদস্পন্দন আবিস্কারের একনিষ্ঠ প্রয়াসের সবুজ ফসল মায়ামৃদঙ্গ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ যে জীবন উপাদানকে এ’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেছেন, এক অন্ত্যজ ধর্ম ও সংস্কৃতির স্বকীয় আবেগ-অনুভবে পুষ্ট বাংলার গ্রামীণ জীবনের তাৎপর্যময় পরিচয়টিকে পরিস্ফুটনের জন্য তা ব্যতিক্রমি কিন্তু বর্ণোজ্জ্বল উপকরণ। লেখকের ব্যাপক জীবনাভিজ্ঞতার এক শিল্পিত সোনালী সম্পদ। শিল্পের মায়াবী সন্মোহন উপন্যাসের প্রায় সর্বত্রই ছড়ানো বলেই এর নাম মায়ামৃদঙ্গ সম্ভবত। বাংলাভাষার উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় সিরাজের অবদান বিশিষ্ট ও ব্যতিক্রমধর্মচিহ্নিত, নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের বহুমাত্রিক অসংগতির চিত্র-অঙ্কনের পঞ্চাশ দশকী মৌল প্রবণতার পথ ছেড়ে উপন্যাসে তিনি বিচরণ করেছেন গ্রামীণ জীবনতটে, গ্রামের নিরন্ন-নিঃস্ব খেটে খাওয়া মানুষের জীবন যন্ত্রণা-সংগ্রাম ও দহনের পোড়োজমিতে। সিরাজ শ্রেণীসচেতন শিল্পী, তাই বস্তুবাদী সমাজচিন্তার আলোকে তিনি তুলে ধরেন গ্রামীণ শ্রেণীর শোষণের চিত্র, নির্মাণ করেন সর্বহারা মানুষের সংগ্রাম ও উত্তরণের জয়গাঁথা এবং নিপীড়ন বর্জিত প্রতিবাদী বাঁক।
×