ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. চিত্তরঞ্জন দাশ

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

(পূর্ব প্রকাশের পর) একশত চার বছর পর আর এক বিলাস বহুল জাহাজের যাত্রী হতে পেরে এবং তার গল্প বলতে গিয়ে নিজেও কম গর্ববোধ করছি না। এমন সৌভাগ্য কতজনের ভাগ্যে জোটে। এমন সৌভাগ্য ভবিষ্যতে হবে কিনা জানি না তাই এ তরীর নাড়ি নক্ষত্র সবকিছু জেনে শুনে বুঝে নিতে চাই কড়ায় গ-ায়। এ হলো মোর বাসনা। শুরুটা কোথা থেকে করব ঠিক বুঝে ওঠার আগেই দেখি সবাই ছুটে চলেছে জাহাজের ডেকে কারণ, এখনই প্রমোদ তরী সেল করবে অর্থাৎ ছেড়ে যাবে। তাই আমরাও সকলে মিলে চলে গেলাম উম্মুক্ত খোলামেলা ফুটবল খেলার মাঠের সদৃশ ডেকে। সারা ডেকজুড়ে রাখা আছে অসংখ্য চেয়ার যে চেয়ারে বসে উপভোগ করা যাবে প্রকৃতির অকৃপণ দানে পরিপূর্ণ করা এই বসুনধারাকে। সাগর বক্ষ থেকে উঠে আসা দীর্ঘ চ্যানেল যার দু’কূল সমৃদ্ধ হয়েছে ছোটবড় পাহাড়, তাকে আচ্ছাদিত করে রয়েছে সবুজ বনবৃক্ষ। বনবিথীর মাঝে শোভা পাচ্ছে বিলাসী ভিলা। ঘাটে বাঁধা আছে যন্ত্রচালিত নৌযান, মাঝে মধ্যে নৌবিহারে যাওয়ার নিমিত্তে। নির্দিষ্ট সময়ে বেজে উঠল প্রচ- শব্দে জাহাজের ভেঁপু। মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হলো সারা শরীরে। শিহরিত হয়ে গেল সারা মনপ্রাণ, নোঙর তুলে ছেঁড়ে গেল সেলজিয়া। আমাদেরও যাত্রা হলো শুরু। সবাই যে যার মতো সঙ্গী সাথী নিয়ে আসন সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমরা আবার বাদ যাই কেন। ডেকের একেবারে পেছনে খোলা আকাশের নিচে চেয়ারে বসে উপভোগ করতে লাগলাম স্কটহোমের অপরূপ সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি। যে কথা আগেই বলার চেষ্টা করেছিলাম যে সারা স্কটহোম শহরটার মধ্যে অসংখ্য চ্যানেল দ্বারা পরিপূর্ণ। এই অংশের চ্যানেলটা আকারে ও গভীরতায় যে অনেকটা বড় সেটা অনুমান করা যায় যে প্রমোদ তরীতে আমরা যাত্রী তার বিশালত্ব নিয়ে চ্যানেল অতিক্রম করার কথা ভেবে। ধীরে ধীরে তরী খানি এগিয়ে চলেছে আর মুহুর্মুহু দৃশ্যপটের পরিবর্তন যাত্রী সকলকে যে অনাবিল আনন্দে উদ্বেলিত, উচ্ছলিত করে চলেছে সেটা বোঝা যায় যাত্রীদের কলকাকলি ও ফটো তোলার হিড়িক দেখে। একদিকে জলরাশি ভেদ করে চলেছে প্রকা- জাহাজ আর অন্যদিকে দুই কূলের প্রকৃতির অপরিসীম দানের মাঝে মানব সভ্যতায় গড়ে তোলা প্রমোদ ভবনগুলো সবুজ বনরাজির মাঝে নীরবে দাঁড়িয়ে মনোরঞ্জন করে ফিরছে নৌপথের যাত্রীদের। নগর সভ্যতাকে পেছনে ফেলে অতলান্ত সাগরের অকুল দরিয়ায় প্রবেশের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি, কিন্তু এ চলা যেন ফুরাতে চায় না। আসলে সাগর বক্ষ থেকে উঠে আসা এই চ্যানেলটি অতিকায় দীর্ঘ। প্রায় দুই ঘণ্টারও অধিক সময় লেগে গেল চ্যানেল অতিক্রম করতে। এদিকে জাহাজের গতি যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে বাতাসের গতিও। তাই বেশিক্ষণ আর খোলা আকাশের নিচে বসে থাকা সমীচীন নয় স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে। ইতোমধ্যে রাতের আঁধারের কালো আভারণ ঢেকে ফেলেছে বসুনধারাকে। তবে সে আঁধার বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, চাঁদ মামার আবির্ভাব তার সব অবয়বকে উম্মুক্ত করে দিল। আবছা আলো আঁধার সাগর বক্ষে লুকোচুরি খেলায় মত্ত। শান্ত সাগরের মাঝে দৃষ্টিকে হার মানিয়ে অজানা আশঙ্কায় হঠাৎ যেন মনটাকে বিষাদে ভরিয়ে দিল। রাতের বেলায় কূলকিনারাবিহীন সাগরবক্ষে যদি কোন অঘটন ঘটে তবে কেমন হবে সে অঘটন? কেন জানি তেমনই একটা ভীতিকর পরিস্থির উদয় হলো মনের মাঝে। যদিও তার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না মনের মধ্যে আকস্মিক এই অজানা আশঙ্কার। কিছুটা নীরব নিস্তব্দ থেকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম গভীর সমুদ্রের মাঝে সমস্ত নির্জনতাকে উপেক্ষা করে কেমন করে জাহাজ খানি সশব্দে ছুটে চলেছে। এমন চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভাল। প্রীতিলতার আমায় নিয়ে চাঁদের আলোয় মনপ্রাণ উজাড় করে ভাসিয়ে দিতে ভীষণ ভাল লাগে। যদিও সে সুযোগ জীবনে তেমন একটা আসেনি। সেই বিয়ের পর থেকেই ছাড়াছাড়ি। এক সঙ্গে তেমন করে আর ঘর সংসার করা হলো কই। শুরুতেই রাজশাহী ঢাকা, গোপালগঞ্জ ঢাকা, খুলনা তালা, খুলনা ইন্দোনেশিয়া, খুলনা তানজানিয়া, লন্ডন লাইবেরিয়া, লন্ডন সুদান এই করতে করতেই জীবনের শেষ প্রান্তে এস হাজির হয়েছি। এর মাঝে ঝগড়াঝাটি তো লেগেই থাকে। চাঁদ তো সবদিন রাতের আঁধারে ঢাকা আকাশকে আলোকিত করে না। তারও প্রকৃতির সঙ্গে মিলে মিশে, প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ফিরতে ও বসবাস করতে হয়। তারও সুখ দুঃখ, হাসি কান্না আছে। তাইতো রোদ বৃষ্টি ঝড়ে তার মুখে হাসি ফোটে না। যেমনটি মনের আবহাওয়া অনুকূল না থাকলে হাসি ফোটে না আমার প্রিয়তমার মুখে। এমনতর ঘটনা ঘটলে কেমন করে দোহে মিলে চাঁদের আলোয় মনের আলো মিলেমিশে একাকার হবে। তবে আজকের ব্যালটিক সাগরের অকূল দরিয়ায় দুজনকে এমন প্রসন্ন চিত্তে পেয়ে যাব চিন্তাই করিনি। ধীরে ধীরে রাত্রি যেমন গভীর হচ্ছে তেমনি গভীরতা বাড়ছে সাগরের, এমনিভাবে বিশাল তরী খানির গতির গভীরতা বেড়ে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে। কখন যে কূলকিনারা হারিয়ে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি। যতটুকু পারা গেল শিপের মান্তুলে দাঁড়িয়ে, বাতাসের প্রচ- ঝাপটাকে উপেক্ষা করে চাঁদের আলোয় গভীর সাগরকে উপভোগ করলাম দুজনে মিশে গিয়ে। কিন্তু সেটাও দীর্ঘস্থায়ী করা গেল না বাতাসের তীব্রতার কারণে। ওকে বললাম চল ফিরে যাই আমাদের পরিপাটি করে সাজানো গোছানো আপন স্যুটে যার জন্য অর্থদ- দিয়েছে অনেক বেশি করে। আজ আর কোন কিছুতে নিরাশ হওয়ার সামান্যতম লক্ষণ দেখা গেল না। ঘরের জানলার পর্দা টানতেই মনে হলো চাঁদ মামা কখন থেকে সেজেগুজে আমাদের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। কি সৌভাগ্য আবারও বলতে ইচ্ছা করছে এমন চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভাল ...। না এমন চাঁদের আলোয় মরতে চাই না, তাকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালবেসে উপভোগ করতে চাই। চলবে...
×