ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

অতিথির আলয়...

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

অতিথির আলয়...

বিখ্যাত ইংরেজ কবি জিএল গৌল্ড ওয়ান্ডার থার্স্ট কবিতায় বলেছেন, ফিরে আসব কোনদিন, কিন্তু যেতে আমাকে হবেই; আর যদি লোকে জিজ্ঞাসা করে কেন যাব, এসবের জন্য দোষ দিও তাদের, সূর্যকে আর সাদা রাস্তা আর সুনীল আকাশকে। কবির মতো আমিও ডাক শুনি ওই সুনীল আকাশে ঘুরে বেড়ানো ডানা মেলা পাখির। তাই বার বার তাদের ডাকে সাড়া দিতে ঘুরে বেড়াই দেশের আনাচে-কানাচে। আমাদের আজকের গন্তব্য সিলেট শহরের খুব কাছে দক্ষিণ সুরমা নামক এলাকাতে। উদ্দেশ্য শহরের ছায়াতে অতিথি পাখি দেখা। এই জায়গাটির সন্ধান দেন আমাদের ফটো সাংবাদিক বন্ধু ইউসুফ ভাই। ইউসুফ ভাইয়ের কথা অনুযায়ী সূর্যোদয়ের পরে হালকা নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়ি সফরসঙ্গী আমার সবসময় এর বন্ধু আমার মা। ইতপূর্বে অতিথি পাখি দেখেছি কিন্তু একদম শহুরে পরিবেশে অতিথি পাখি কখনো দেখিনি। তাই রওনা হলাম অতিথি পাখি দেখার জন্য। অতিথি পাখির অবস্থান থাকে সাধারণত বিলের দিকে কিন্তু প্রথমে কোন বিল এর দেখা পেলাম না, তাই সেখানে একটি পাখিও নজরে পড়ল না। দীর্ঘ সময় ধরে ঘুরলাম কিন্তু পাখির তো দেখা পাই না। আকাশে সূর্যের দেখা নেই আর আমাদের আকাশের বুকে আঁধার নেমে আসছে, আর সম্ভব হলো না অতিথি পাখির সঙ্গে মোলাকাতের। আমরা মন খারাপ করে ঘুরে আসব ঠিক সেই সময় একটা ঝিল এর দেখা পেলাম আর একটু সামনে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম উনিই রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। আমরা সামনে এগিয়ে পেলাম নর্থ ইস্ট মেডিক্যাল কলেজ। এরপর কলেজে ঢুকে পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনছি কিন্তু পাখি তো দেখছি না পরে হঠাৎ দেখি অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে অতিথি পাখির ঝাঁক, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। অনেক সময় দাঁড়িয়ে রইলাম কাছে আসে কিনা। কিন্তু না কাছে আসা তো দূরের কথা আরও দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যেতে লাগল। সামনে এগিয়ে যেতেই পেলাম আমাদের শহুরে পরিবেশে সেই সুদূরের অতিথি পাখিদের। অতিথি পাখিদের মনমুগ্ধকর ডাক যে কারোরি মন ভরিয়ে দিতে পারে। বলে রাখা ভাল শীতকালে শীতের হাত থেকে বাঁচতে যে সব পাখি ওদের নিজ দেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে, তাদের বলা হয় অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখি। প্রতিবছর শীতকালে আমাদের দেশেও কিন্তু এ রকম কিছু অতিথি পাখি আসে। ওরা আসে মূলত হিমালয়ের পাদদেশ আর রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে। এই পাখিগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই সুন্দর এদের গায়ের বাহারি রং। ওদের দেখলেই মন ভরে যায়। আমাদের দেশে মোট পাখি আছে প্রায় ৬২৮ প্রজাতির। এর মধ্যে ২৪৪ প্রজাতির পাখিই স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বাস করে না। এরা আমাদের দেশের পরিযায়ী পাখি বা অতিথি পাখি। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে এরা আমাদের দেশে আসতে শুরু করে। আর তারপর মার্চ থেকে এপ্রিলের দিকে ওদের দেশে বরফ গলতে শুরু করলে ফিরে যেতে থাকে নিজেদের দেশে। আমাদের দেশে অতিথি পাখিরা অতটা পথ পাড়ি না দিলেও তারাও অনেক দূর থেকেই আসে। বরফ শুভ্র হিমালয় এবং হিমালয়ের ওপাশ থেকেই বেশিরভাগ অতিথি পাখির আগমন ঘটে। এসব পাখিরা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত তিব্বতের লাদাখ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে দিয়ে প্রবেশ করে। এছাড়া ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য (যেমন সাইবেরিয়া) থেকেও এসব পাখি আসে। এরা কিছু সময় পর আবার ফিরে যায় নিজ দেশে। এসব পাখিদের মধ্যে বাংলাদেশের অতি পরিচিতি অতিথি পাখি নর্দান পিনটেইল। এছাড়া স্বচ্ছ পানির বালি হাঁস, খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস পাখি, বড় সারস পাখি, হেরন, নিশাচর হেরন, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন পাখি, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচার্ড, বিলুপ্ত প্রায় প্যালাস ফিস ঈগল (বুলুয়া) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও নানা রং আর কণ্ঠ বৈচিত্র্যের পাখিদের মধ্যে রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, বালি হাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল, নীলশীর পিয়াং, চীনা, পান্তামুখি, রাঙামুড়ি, কালোহাঁস, রাজহাঁস, পেড়িভূতি, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি। এবার প্রশ্ন আসতে পারে অতিথি পাখি কেন আসে কেন যায় এর উত্তর খুব সহজেই দেয়া যায়, শীত এলে এরা সহ্য করতে না পেরে অন্য দেশে যেখানে শীত অপেক্ষাকৃত কম সেখানে চলে যায়। তাছাড়া এ সময়টাতে শীতপ্রধান এলাকায় খাবারেও দেখা যায় প্রচণ্ড অভাব। কারণ শীতপ্রধান এলাকায় এ সময় তাপমাত্রা থাকে অধিকাংশ সময় শূন্যেরও বেশ নিচে। সেই সঙ্গে রয়েছে তুষারপাত। তাই কোন গাছ-পালা জন্মাতেও পারে না। তাই শীত এলেই উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়ার কিছু অঞ্চল, হিমালয়ের আশপাশের কিছু অঞ্চলের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে চলে আসে কম ঠাণ্ডা অঞ্চলের দিকে। শীতের প্রারম্ভেই ওদের পাখনার ঝাপটায় সৃষ্ট নান্দনিক ছন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলার প্রত্যন্ত জনপদে নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়, ঝিল, জলাশয় ও বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল, অতিথি পাখির গুঞ্জনে-কুঞ্জনে সবুজ-বনানী পরিবেষ্টিত রূপসী বাংলার নির্জন প্রান্তর তখন সেজে উঠে নতুন সাজে নবরূপা। এসব অতিথি পাখিরা কেবল নিজেদের প্রশান্তির জন্যই আমাদের দেশে আসে না। আমাদের দেশে অতিথি হয়ে আসা এসব পাখি সেই সঙ্গে বিভিন্নভাবে আমাদের উপকার করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অতিথি পাখিরা সাধারণত ছোট ছোট মাছ, শামুক, ব্যাঙাচি, পোকামাকড়, জল ও শেওলা ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে। কীটপতঙ্গ খেয়ে অতিথি পাখিরা যেমন জীববৈচিত্র্যে ভারসাম্য রক্ষা করে, তেমনি ফুল ও শস্যের পরাগায়নেও এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এরা ইঁদুর খেয়ে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। অতিথি পাখিরা যেহেতু সারের কাজ করে, সেহেতু পাখির মলে জমি পায় উর্বরতা। বসন্তের সময় মানে মার্চ-এপ্রিলের দিকে শীতপ্রধান অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করে, কিছু কিছু গাছ-পালা জন্মাতে শুরু করে। ঘুম ভাঙতে শুরু করে পুরো শীতকালে ঘুমিয়ে থাকা অনেক প্রাণীদের। ঠিক এ রকম এক সময়ে অতিথি পাখিরা নিজ বাড়িতে ফিরে যায় দলবলসহ। আবার এখানে বেশ মজার একটা ব্যাপার আছে। তারা ফিরে গিয়ে ঠিক তাদের বাড়ি চিনে নেয়। অদ্ভুত এক ব্যাপার। গবেষকরা বলছেন, সমুদ্রের নাবিক যেমন কম্পাস ব্যবহার করে পথ চলে এই পাখিদের দেহে সে রকম কিছু একটা জন্মগতভাবেই আছে। যা তাদের পথ চলার সময় দিক চিনতে সাহায্য করে। তাছাড়া তারা সূর্য ও তারার অবস্থানের উপরই নির্ভর করে। পরিষ্কার মেঘমুক্ত রাতে যখন আকাশে নক্ষত্র দেখা যায় তখন পাখিরা নির্বিঘেœ পথ চলতে পারে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকলে নক্ষত্র ঢাকা পড়ে। এ সময় এসব পাখিরা আকাশ থেকে নিচে কোন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে চলা পাখিরা এক্ষেত্রে দিকভ্রান্ত হয়। তাই এ সময় অনেক দূরের কোন লাইটহাউসের শক্তিশালী আলোর দিকে তারা পথ ভুল করে চলে আসে দলে দলে। মেঘলা কুয়াশাচ্ছন রাতে লাইটহাউজের গ্লাসে আঘাত পেয়ে হাজার হাজার পাখি মারা পড়ে। তবে আমাদের দেশে সারা বছর না থাকলে কি হবে, আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু ওদের কম ভালবাসে না। পথের ঠিকানা : ঢাকার যে কোন স্থান থেকে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে যাত্রাবাড়ী বা কমলাপুর। এখান থেকে বাসে অথবা ট্রেনে করে সিলেট। সিলেট এর রেলস্টেশন / বাস টার্মিনাল থেকে দক্ষিণ সুরমা চণ্ডির পুল নর্থ ইস্ট মেডিক্যাল কলেজ এ পৌঁছালেই দেখা মিলবে অতিথি পাখির ভাড়া পরবে ৩০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা ট্রেন অথবা বাস পরে স্টেশন/ টার্মিনাল থেকে রিক্সা ভাড়া ৩০ টাকার বেশি নয়। [email protected]
×