ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তাহেরা বেগম জলি

নারী সাহসিকা বিদুষী বিনোদিনী

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

নারী সাহসিকা বিদুষী বিনোদিনী

কিংবদন্তিতুল্য প্রতিভাময়ী সুন্দরী বিনোদিনী দাসী অভিনয় সম্রাজ্ঞী হিসেবেই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। সাহিত্যকর্মেও এই প্রতিভাময়ীর বলিষ্ঠ পদচারণার গল্প এক সময় মানুষের মুখে মুখে ছিল। তিনি নাটককে একটা পরিশীলিত সাহিত্যিক মানে উন্নিত করার চেষ্টা এবং অভিনয় শিল্পের শ্রীবৃদ্ধির কাজ করেছেন একই সঙ্গে এবং তা দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে। নাটককে প্রকৃত সাহিত্যিক মর্যাদায় দাড় করানোর প্রচেষ্টা ছিল তার কাছে অভিনয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। বিনোদিনী দাসীর নিজের উল্লেখ পাওয়া যায়, ‘অবসর মতো আমাদের বাটিতে বসিয়া, অমৃত মিত্র, অমৃত বাবু (ভুনি বাবু) আরও অন্যান্য লোকে মিলিয়া... বড় বড় বিলাতি কবি শেক্সপিয়ার, মিল্, বায়রন প্রভৃতির...পুস্তক লইয়া পড়িয়া পড়িয়া বুঝাইতেন।’ নাটককে ভোগবিলাসের চৌহদ্দি থেকে বের করে, সমাজের প্রাণশক্তিতে রূপান্তরিত করার উপায় নিয়ে, শ্রী গিরিশচন্দ্র ঘোষের উদ্যোগে তখন চলত নিরন্তর সাহিত্য গবেষণা। বিনোদিনী অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সঙ্গে সেই আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন। তৎকালীন সময়ে বিনোদিনীর মধ্যে এই মহৎ গুণের প্রকাশ, নাট্যাঙ্গনকে সংস্কৃতির উঁচু মানে যেতে সাহায্য করেছে। সরস্বতীর মানস কন্যা বিনোদিনী দাসীর কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। তার সম্পর্কে গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলতেন, ‘প্রকৃত অধ্যবসায় এবং নিবিড় অধ্যয়ন ব্যতিরেকে এমন নিপুণ চরিত্র সৃষ্টি সম্ভব নয়।’ কালোত্তীর্ণ মহা তারকা বিনোদিনীর সঙ্গে ১৮৮৭ সালে নাটকের সম্বন্ধ ছিন্ন হয়ে যায়। নাটক এবং বিনোদিনীর বিচ্ছেদে ছিল আসমান জমিন পতনের বেদনা। জীবনকে যারা ভালবাসে, জগতে তারা তাদের পদচিহ্ন রেখে যেতে চায়। জীবনের সকল বেদনা শক্তিতে পরিণত করে, নটী বিনোদিনীও কালক্রমে হয়ে উঠলেন বিদুষী বিনোদিনী। সকলের মাঝে নতুন রূপে আবির্ভূত হলেন কবি বিনোদিনী। অভিনয় শিল্পী হিসেবে সাহিত্য চর্চা ছিল বিনোদিনী দাসীর নিত্য সঙ্গী। এবার অন্তরালের বিনোদিনী হয়ে উঠলেন সত্যিকারের শব্দ কারিগর। সৃষ্টিশীল মানুষ জীবনকে সাজিয়ে তোলে সৃষ্টির আনন্দে। সেই সৃষ্টির আনন্দেই কলম সৈনিকে পরিণত হয়েছিলেন মহান এই বিদুষী নারী। সমৃদ্ধ কবিতা এবং গদ্য আঙ্গিকে জীবন ঘনিষ্ঠ লেখায় সমসাময়িক সময়ে যথেষ্ট খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি। তার রচিত কাব্যগ্রন্থ বাসনা এবং কাব্যোপন্যাস কনক ও নলিনি আজও তার কাব্য প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পাওয়া বিনোদিনী দাসী, তৎকালীন সময়ে সাহিত্যক সমাজে বেশ সমাদরের আসন পেয়েছিলেন। বিনোদিনীকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করার মহা আয়োজনে যারা মেতে উঠেছিল। রক্ষিতার পোশাক গায়ে চড়িয়ে বিনোদিনী কন্যা শকুন্তলাকে পর্যন্ত যারা কোন বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে দেয়নি, তাদের দেখতে হলো, আগুনে পুড়ে খাটি হওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত মানুষকে ধ্বংস করার শক্তি কারোর নেই। মঞ্চ কাঁপানো নটী বিনোদিনী আজ শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে গেঁথে চলেছেন সাহিত্য নির্ভর জীবনগাথা। বিনোদিনীর রক্তাক্ত হৃদয়ের কাব্যগাথার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠল চলমান সমাজ। নিষ্ঠুর সমাজ কিভাবে হাজারো বিনোদিনীকে ঠেলে দেয় অন্ধ গলিতে, রুদ্ধ করে দেয় ফিরে আসার সকল দরজা। তার কলমে জীবন্ত হয়ে উঠল নারী জীবনের আধারে লুকানো লাঞ্ছনার ইতিহাস। বিনোদিনী লিখলেন, পুরুষতান্ত্রিকতার নিষ্ঠুর বলি হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে কত শত বিনোদিনী! অসম্ভব দক্ষতায় বিনোদিনী লিখে চললেন সেই সব অবিচারের ইতিহাস। মধ্যগগনে পৌঁছানোর আগেই কেবল বিকশিত একটা জীবন মাঝ পথে কিভাবে থেমে গেল! নিষ্ঠুর সমাজ কীভাবে হঠাৎ জ্বলে ওঠা এক প্রতিভাকে নির্মমভাবে হত্যা করল! বিনোদিনীর কলমের আঁচড়ে উঠে এলো সেই অব্যক্ত কান্নার ইতিহাস। লিপিবদ্ধ হলো এক অগ্নিময় পথযাত্রা। তবে তা শুধুই কান্নার কাহিনী নয়। নীলকণ্ঠী বিনোদিনী কান্নাকে পেছনে ঠেলে, কিভাবে অহরাত্রি জীবনের সন্ধান করেছেন, ছবির মতো তা ফুটে উঠল তার লেখার প্রতি ছত্রে। নিজের লেখনী দিয়ে রচনা করলেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আলোকিত পথ। লেখনীকে উদ্দীপনায়-বেদনায় মিশিয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে একজন লেখকের চাই পরিমিত রুচিবোধ। উন্নত সাংস্কৃতিক মানের অধিকারী বিনোদিনী দাসী, নিজের কর্মময় জীবন নিয়ে যে দু’খানা গ্রন্থ রচনা করলেন, তা সাহিত্য জগতে উচ্চ আসনের মর্যাদাই পেয়েছিল এবং আজ তা সমগ্র নারী সমাজের আত্মকথা হয়ে আমাদের সামনে ধরা দিয়েছে। এখানে উল্লেখের দাবি রাখে, বিনোদিনী দাসীর জীবনী গ্রন্থ রচনার আগে, গোটা এশিয়া মহাদেশে আর কোন অভিনয় শিল্পী এই দুরূহ কাজ করেছেন বলে জানা যায় না। অভিনয় যে শুধু রঙ্গালয়ের রঙ্গ নয়, জীবন বোধের বলিষ্ঠ প্রকাশ, বিনোদিনী দাসীর জীবনের পরতে পরতে সেই রুচির প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং নির্মলচন্দ্র সম্পাদিত রূপ ও রং নামের পত্রিকায় বিনোদিনীর অভিনেত্রী জীবন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই সেদিনের নীলকণ্ঠী বিনোদিনীর কণ্ঠ আজ আমাদেরই কণ্ঠ। তার গায়ে জোর করে চাপিয়ে দেয়া রক্ষিতার জ্বলন্ত পোশাক আজ আমাদের গায়েও জ্বালা ধরায়। লাঞ্ছিত-অপমানিত জীবনের বোবা কান্না ভেদ করে সমাজের প্রতিটা নারী আজ হয়ে উঠুক বিনোদিনী দাসী।
×