ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বছরের আবর্জনা মুছে যাক

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

বছরের আবর্জনা মুছে যাক

২০১৬ সালে প্রাপ্তির আনন্দ যেমন আছে তার চেয়েও বেশি মর্মাহত হওয়ার বেদনা, বঞ্চনা আর ঘাত-প্রতিঘাতের দুঃসহ অভিজ্ঞতাও আমাদের তাড়িত করে। অর্জনের পাল্লার চাইতেও অনেক বেশি ভারি ছিল যন্ত্রণা আর কষ্টের অভিঘাতগুলো। তিক্ত অভিজ্ঞতার নানা দুর্ভোগের মাত্রায় নারী নির্যাতন ছিল বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তার ওপর বিষফোঁড়ার মতো নতুন উপসর্গ এসে যোগ হলো নারীজঙ্গী উত্থানের ভিন্ন মাত্রার এক নতুন উন্মাদনা। হত্যা, ধর্ষণ এবং নিপীড়নের মতো জঙ্গীবাদে নারীর যোগসাজশও ছিল সাড়া জাগানো আর্তনাদ। পুরো বছরটা এমনই বেদনাঘন অনুভবে নারীদের নানাভাবে ব্যথিত, উৎকণ্ঠিত উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত অবস্থার মধ্যে যেতে হয়েছে। নতুন বছরে যেন সেই দুঃসহ স্মৃতির পুনরাবৃত্তি না হয়। সমস্ত অপতৎপরতা, দুঃসময় আর যন্ত্রণার কষাঘাত থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন সূর্য যেন আলোর মিছিলে অন্ধকারকে লুপ্ত করে দেয়। সবটুকু হয়ত পারা যাবে না কিছুটা হলেও নতুন বছরের সম্ভাবনা নারীর চলার পথকে নিষ্কণ্টক করুক, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কিংবা আশা-আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটাবে এইটুকু আমরা ভাবতেই পারি। নারী হত্যা, ধর্ষণ কিংবা নির্যাতন হয় মূলত সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার তীব্র কষাঘাতে। প্রত্যেক মানুষ তার মৌলিক চাহিদা এবং স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। এর ব্যত্যয় হলে সত্যিকার অর্থে কারোরই সম্মান কিংবা মর্যাদা থাকে না। আর যে কোন সমাজই নির্ধারণ করে প্রতিটি নাগরিকের ন্যায্য দাবি এবং অধিকার আদায়ের বিভিন্ন পর্যায়। ছোট পরিবার থেকে বৃহত্তর সামাজিক আঙিনায় শ্রেণীবিভাজন নামক বহুল আলোচিত প্রত্যয়টি এমন শক্তভাবে গেড়ে বসা যার থেকে মুক্তি লাভ আসলেই কঠিন। শ্রেণী বিভক্তির কারণে মানুষের ক্ষমতায়নের পার্থক্যও চোখে পড়ার মতো। আর এই কর্তৃত্বের কাঠামোর শীর্ষস্থানে থাকে সমাজের বিত্তবান এবং সুবিধাভোগী শ্রেণী। ফলে অসহায় এবং নির্বিত্তরাই হয় সব ধরনের অন্যায়, অবিচার এবং নিপীড়নের নির্মম শিকার। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ দৃষ্টিকটু না হলেও সমাজের দুর্বল এবং পিছিয়ে পড়া অংশ হিসেবে নারীরা অনেকখানি এগিয়ে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর সিংহভাগই নারী। ঘাত-প্রতিঘাতের টানাপোড়েনে নারীরা বিভিন্ন পর্যায়ে যেভাবে অবজ্ঞা কিংবা উপেক্ষার আবর্তে পড়ে তা যেমন মর্মান্তিক একইভাবে অমানবিকও। জন্ম থেকেই এই অলিখিত, অনিয়মটি নারীর ওপর আরোপিত হয়। কন্যাসন্তানের জন্ম বাবা-মার জন্য কখনও সেভাবে সুখকর হয় না। ছেলেমেয়ের পার্থক্য শুরু করা হয় সেখান থেকেই। পরবর্তী ধাপে কন্যাসন্তানরা পড়ে বাল্য-বিবাহ নামে সামাজিক বিধির নিষ্ঠুর জালে। মন এবং শরীরের ওপর অবিচার করে তারা অকাল মাতৃত্বের অভিশাপে জর্জরিত হয়। ফলে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে যায়। যার অনিবার্য পরিণতি পরনির্ভরশীলতা। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ একেবারেই রুদ্ধ হয় যা দেশের সার্বিক উন্নয়নের বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। বিগত বছরের বিভিন্ন জরিপে উঠে আসে শুধু বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার দেশই নয় বিশ্বব্যাপী কন্যাসন্তানরা বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক অভিশাপে নিষ্পেষিত। জানি না নতুন বছর কন্যাসন্তানদের জন্য কোন মঙ্গলজনক অবস্থা তৈরি করতে পারে কিনা। বিভিন্ন পর্যায়ে নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান ও সামাজিক প্রতিবেদনে এসব স্পষ্ট হয়। স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি কিংবা পরিবারের নিকটতম স্বজনদের দ্বারা নারী নিগ্রহের সুস্পষ্ট চিত্রও জনসমক্ষে প্রতীয়মান হয়। আর বছরজুড়ে নৃশংসভাবে নারী হত্যাযজ্ঞের উত্তাল সংবাদটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি এসব নারী সহিংসতার বিচারিক প্রক্রিয়া এখনও দোদুল্যমান অবস্থায়। যা এই ধরনের ভয়ঙ্কর ঘটনাকে নানামাত্রিকে উৎসাহিত করে। ৫ বছরের কন্যাশিশু থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন বয়সের নারী ধর্ষণের মতো ক্ষত-বিক্ষত দুর্ঘটনাও ২০১৬ সালে সারা বাংলা কাঁপানোর মতো নিষ্ঠুর অধ্যায়। যা মনুষ্যত্বকে বিপন্ন আর সভ্যতাকে শিহরিত করে। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে আরম্ভ করে উন্নয়নের সব ধরনের সূচকে দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অর্ধাংশ নারী জাতির সিংহভাগের যদি এমন মর্মান্তিক অবস্থা হয়, তাহলে উন্নয়নের নিরন্তর গতির কি ছন্দপতন হয় না, বিচ্যুতি ঘটে না? শিক্ষায়, পেশায়, কৃষি উৎপাদনে, শিল্প কারখানায় শ্রম বিনিয়োগে নারীরা যেভাবে অসাম্য বৈষম্যের শিকার হয় তার বাস্তব চিত্রও খুব করুণ। বিশেষ করে কৃষি, অবকাঠামো এবং শিল্প-কারখানায় শ্রম বিনিয়োগকারী নারী যে পরিমাণ অবিচার এবং অনিয়মের বিপাকে পড়ে তা কোনভাবেই যৌক্তিক নয়। শ্রমের সময় এবং ধরনের কোন রকম ফারাক করা হয় না। কিন্তু মজুরির বেলায় নারী-পুরুষের পার্থক্য নির্ণয় করা হয়। তা যেমন বেআইনী, অমানবিক একইভাবে অযৌক্তিক এবং অনাকাক্সিক্ষত। এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং প্রতিবাদেও কর্তৃপক্ষের কোন টনক নড়ে না। কারণ আজ অবধি নিয়মমাফিক কোন প্রতিকার নারী শ্রমের এই বিভাজনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেনি। জানি না নতুন বছরে এই অসম মূল্য নির্ধারণের বিরুদ্ধে কোন ধরনের আশার আলো দেখা যাবে কিনা। সব ধরনের ক্ষমতায়ন থেকে নারীরা পিছিয়ে। মালিকানা স্বত্বেও নারীদের কর্তৃত্বের কাঠামোর অনেক সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। বংশানুক্রমে পিতা কিংবা স্বামীর সম্পত্তি পাওয়া ছাড়া অন্য কোন মালিকানা স্বত্ব তৈরি করা নারীদের পক্ষে বিরাট বাধা। যৎসামান্য নারীরা মালিকানার অধিকারটি পেয়ে থাকেন, কিন্তু সিংহভাগ নারীর অবস্থা অত্যন্ত নড়বড়ে এবং বিপন্ন। সকাল থেকে রাত অবধি যে নারীর হাড়ভাঙা শ্রমে পরিবার সংহত হয়, সমাজ-সভ্যতার ভিত মজবুত হয়, প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞে যাদের বলিষ্ঠ অবদান অনস্বীকার্য তারা যদি অবজ্ঞা, উপেক্ষা কিংবা অবহেলার শিকার হয় তাহলে দেশের সমৃদ্ধি কি পিছিয়ে যেতে পারে না? নারীর সম্মান এবং মর্যাদার বিষয়টিও নতুন করে বিবেচনার দাবি রাখে। অত্যাচার, নিপীড়িন আর দীর্ঘশ্বাসের করুণ পথপরিক্রমায় ২০১৬ সাল অতিক্রান্ত হলো। ২০১৭ সালে নতুন অধ্যায় রচিত হোক নারীর সম্ভাবনাময় পথ চলায়। যা উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকেও নতুন মাত্রা এনে দিতে পারে। মুছে যাক গ্লানি, মুছে যাক জরা অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা
×