ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাদিক ইসলাম

জসীমউদ্দীনের পল্লী বাংলা

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

জসীমউদ্দীনের পল্লী বাংলা

কবি জসীমউদ্দীন আমাদের পল্লী বাংলার হারিয়ে যাওয়া অমূল্য কাহিনীগুলো- যা আমাদের নিজস্বতাকে মনে করিয়ে দেয় সমাজ, সমাজের ভিতর বাহির, লোকজঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা, নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরা, মানবিক বিপর্যয়, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলো উপমার মাধ্যমে, চিত্রকল্পের মাধ্যমে আন্তরিকভাবে চিত্রিত করেছেন। গীতিকবিতার সুরের ধ্বনি বার বার তার কবিতায় ধ্বনিত। তার অন্তর্লীন চেতনা ছিল অতিতমুখী লোকজ সংস্কৃতির দিকে সতত ধাবমান। তাই তিনি-‘পল্লী কবি’ উপাধিতে ভূষিত। তিনি প্রকৃতি বর্ণনায় বিশিষ্ট, অন্য লেখকদের থেকে আলাদা, কারণ তিনি প্রকৃতিকে যেমন নিরাভরণে আর অকৃত্রিমভাবে বর্ণনা করেছেন তা খুবই জীবন্ত তার সঙ্গে সঙ্গে তার বাচনভঙ্গি খুব আধুনিক। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে জসীম উদ্্দীন কল্লোল যুগের কবি। যেখানে নবীন কাব্যজগতের নামজাদা কবিরা ইউরোপের সাহিত্য আন্দোলনে প্রভাবিত নন শুধু, মুগ্ধ অনুসরণকারী রবীন্দ্র-নজরুলের রোমান্টিকতাকে একদিকে সরিয়ে রেখে এজরা পাউন্ড, টিএস এলিয়ট, জেমস জয়েস প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, ও অমিয় চক্রবর্তী সবার মননে গেঁথে বসেছে কিন্তু এরই মাঝে জসীম উদ্্দীন সবাইকে উপেক্ষা করে তার নিজ দেশ, মানুষ, প্রকৃতি ও পল্লীর বর্ণনায় ছিলেন অবিচল আর শব্দ চয়নে খুব সাধারণ হয়েও অসাধারণ প্রয়োগে সৃষ্টি করে গেছেন অনন্য জীবনমুখী, পল্লী-নিবিষ্ঠ কাব্যমালা। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ অতিতচারী। তিনি পিপাসিত মনে মুক্ত বাংলার প্রকৃতি আর সহজ সরল মানুষ তার সঙ্গে পল্লী জীবনের অবহেলিত, উপেক্ষিত, দরিদ্র করুণ জীবনের সংবেনশীলতা, আবেগ, অনুভূতি, অনুভব লিপিবদ্ধ করে গেছেন সত্যনিষ্ঠভাবে। তিনি লোকজ ও লৌকিক, প্রাত্যহিক ঘটনা যেগুলো গ্রাম বাংলার শেকড়কে চেনায় তা আমাদের সামনে তুলে এনে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর পুরনো কিন্তু চিরায়ত জীবনযাপন প্রণালী সাহিত্যে অমর করে রেখে গেছেন। কল্লোল যুগের কবিরা যেমন গ্রাম ছেড়ে পশ্চিমা ধাঁচে বাংলা সাহিত্য আর জীবনকে উপস্থাপিত করেছেন আর গ্রামকে উপেক্ষা করে শহুরে জীবনকে সাহিত্যে প্রাধান্য দিয়েছেন জসীম উদ্্দীন তা থেকে দূরে ছিলেন। ইংরেজী সাহিত্যের বক্র বর্ণনা, দুর্বোদ্ধতা, জটিলতা পরিহার করে জসীম উদ্্দীন তার নিজের ধারাতেই লিখে গেছেন সত্য, সুন্দর, নির্মল ও প্রাঞ্জল ভঙ্গিতে। তার মৌলিকতায় তিনি রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কাব্যধারার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ রেখে উপস্থিত হয়েছিলেন নিজের প্রথায় কিন্তু লক্ষণীয় যে তিনি কল্লোল যুগের একজন প্রতিনিধি হয়েও সর্বগ্রাসী পশ্চিমা ধারার প্রভাবমুক্ত থেকে নিজের কাব্যধারাতেই নিবদ্ধ ছিলেন এক্ষেত্রে তিনি পুরোপুরি প্রথা বিরুদ্ধ আর বাংলা প্রকৃতি ও জীবননিষ্ঠ। কবি হয়ত নিজেই বলে গেছেন এটিÑ‘মা’ কবিতায় : ‘এত বড় এই ডাকাতের দলে আমি একা গেঁয়ো-কবি একে একে ওরা ছিনাইয়া নিল যাহা ছিল মোর সবই। যা ছিল এবার শূন্য আমার, তবু কি উহারা ছাড়ে? সেয়ানা ডাকাত পকেট ধরিয়া মহা কলরবে নাড়ে। আমি বলি ওরে কিছু নেই আর, ছাড় ছাড় তোরা ছাড়,’ হেন কালে হল পকেট হইতে গল্পের ঝুরি বার।’ তবে এটা ঠিক তার অনেক কবিতার ভাবধারায় পশ্চিমা কবিতার ভাব পরিলক্ষিত এর মাঝে ‘পল্লী জননী’র মতো বিখ্যাত শোক গাথায় পশ্চিমা শোক কবিতা বা এলিজির প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এটি টমাস গ্রের ‘এলিজি রিটেন ইন আ কান্ট্রি চার্চ ইয়ার্ড বা ‘রাইডার্স টু দ্য সি’র সঙ্গে তুলনীয়; তবে মহান ব্যক্তিদের চিন্তার সমীকরণ যুগে যুগে ঘটে তা আমরা জানি। তবে সব যুগের সব কবিরাই যে একি মনোভাবাপন্ন হবেন তা নয় তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তাদের রচনার মূল নিয়ামক হয়ে যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর জসীম উদ্্দীনের রচনাশৈলী একেবারেই নিজের; পল্লীর রূপ আর মানুষের স্বভাব-আচার বর্ণনায় তিনি পুরোপুরিই সার্থকভাবে নিজস্বতাকে ধরে রেখে গ্রাম বাংলার আসল রূপটি এঁকেছেন অবিকলভাবে। জসীম উদ্্দীনের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ও কাব্যাখানের মধ্যে রয়েছে, সোজন বাদিয়র ঘাট (কাব্যোপন্যাস), নক্সী কাঁথার মাঠ, রাখালী, বালুচর, ধানক্ষেত, হাসু, মাটির কান্না, মা যে জননী কান্দে, পদ্মা নদীর দেশে রূপবতী, গ্রামের মেয়ে, পল্লীবধূ ইত্যাদি। তার কাব্যগ্রন্থগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বাংলা সাহিত্য জগতে আন্তর্জাতিক খ্যাতি বয়ে এনেছে। তার বিখ্যাত কবিতা ‘নিমন্ত্রণ’ পল্লী বাংলার সুচারু চিত্র এঁকে গ্রাম বাংলার মানুষের অকৃত্রিমতা যেমন তুলে এনেছে তেমনি এটি বাংলাদেশের পল্লীরূপের বর্ণনা দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছে পল্লী বাংলার প্রাত্যহিকতাকে। তার এই নিমন্ত্রণ শুধু একদিনের জন্য নয় চিরকালীন ডাক; শুধু একজনকেই নয় সবার জন্য প্রযোজ্য। কবি জানেন গ্রামেই আমাদের আপন সত্তা বিরাজ করে; গ্রামেই আমাদের আত্মার মুক্তি। এখানে ভালবাসার মধ্যে কোন কুটিলতা নেই, নেই ভণিতা; সব সাবলীল আর নির্মল : ‘মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের ¯েœহের ছায়, তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সঙ্গে আমাদের ছোট গাঁয়।’ কবি তার অনেক কবিতার মতো এই কবিতাতেও মানুষকে প্রকৃতির অঙ্গ করে; পরিপূরক করে দেখেন। পাখির সাথে, প্রকৃতির সাথে মানুষ, বালক, বালিকা, রাখাল, কৃষাণির তুলনা তার অনেক কবিতায় পাওয়া যায় : ‘হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে, তোমার পায়ের রংখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।’ জসীম উদ্্দীন শুধুই বাংলা সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য কবি নন তিনি লোকসাহিত্য সংগ্রাহকও যেটি বাংলা সাহিত্যের লোকশিল্প বা লোককথা বা ফোকলোরকে নতুন মাত্রা দিয়েছে; তিনি দীনেশ চন্দ্র সেন এক সাথে ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করেন। বিমল গুহ তার ‘আধুনিক বাংলা কবিতায় লোকজ উপাদান’ বইতে মন্তব্য করেন ‘এক যুগ থেকে অন্য যুগে প্রবহমানতার কারণে সজীবতাই হচ্ছে লোকসংস্কৃতির ধর্ম। গ্রাম বাংলার লোকজীবনের সাথে লোকসংস্কৃতির সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। লোক সংস্কৃতি মূলত রক্ষণশীল। গ্রামের বৃহত্তর জনসাধারণ যা বিশ্বাস করে ও প্রাত্যহিক জীবনে দীর্ঘদিন ধরে লালন করে আসছে তা তারা সহজেই ত্যাগ করতে পারে না। বাঙালীর জীবনধারার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের পরেও তা মানুষের মনে থেকে যায়। প্রচলিত লোক বিশ্বাস ও সংস্কারের বেলায় দেখা যায়- তা গ্রামীণ মানুষের জীবনাচরণের গভীর উৎস থেকে সৃষ্ট। এতে বিশ্বাসের মাত্রা প্রবল।’ এ সকল বিষয় জসীম উদ্্দীনের কাব্যের মুখ্য বিষয়। ‘রাখালী’ জসীম উদ্্দীনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ; তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘কবর’ এবং ‘পল্লী জননী’ এই কাব্যের আশ্চর্য জীবনঘনিষ্ঠ কবিতা। ‘কবর’ কবিতাটি কবি তরুণ বয়সে রচনা করেন তাই এতে তার অনুভূতি প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেও বাস্তবতা বর্জিত নয়। প্রেম কবির কবিতার একটা প্রধানতম উপাদান কিন্তু শ্যামল, সবুজ, মায়াঘেরা ¯িœগ্ধ পল্লীর রূপায়ণ ও সহায়হীন মানুষের দুঃখ, বেদনার করুণ দিকগুলো তার কবিতাগুলোকে পরিপূর্ণতা দান করেছে অন্যতম সমাজ সচেতন শিল্পি হিসেবে। ‘কবর’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই জসীম উদ্্দীনের কবি হিসেবে সাড়া পড়ে যায়। এটি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ড্রামাটিক মনোলগ। এটি একটি শোকগাথা বা এলিজি বাংলা সাহিত্যে এত মর্মন্তুদ কবিতা আর লেখা হয়নি, কবিতাটি পাঠকের আবেগকে পুরোমাত্রায় সিক্ত করে; আর কবিতাটি পাঠক ও সুধী মহলে এত বেশি সাড়া ফেলেছিল যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এটি তাদের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় যা সে সময়কার কোন মুসলমান কবির মধ্যে ছিল প্রথম; এটি জসীম উদ্্দীনের মতো অল্প বয়সী এক কবির জন্য ছিল বিরাট প্রাপ্তি। কবিতাটি জন মিলটনের ‘লিসিডাস’, শেলীর ‘এডোনিস’, বা টেনিসনের বিশ্বখ্যাত ‘ইন মেমোরিয়াম’-এর সমতুল্য। কবিতাটির বেদনাঘন বর্ণনা আর এক বুড়ো অসহায়ের সব হারানোর যন্ত্রণা সবার হৃদয়ে নাড়া দেয়। শুধু বেদনাবিধুরতা নয় পল্লীর সমাজ জীবনও পাওয়া যায় এ কবিতায় : ‘শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু’পয়সা করি দেড়ি, পুঁতির মালা একছড়া নিতে কখনো হইত না দেরি। দেড় পয়সার তামাক এর মাজন লইয়া গাঁটে, সন্ধ্যা বেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে। হেস না- হেস না শোন শোন দাদু , সেই তামাক মাজন পেয়ে দাদি যে তোমার কত খুশি হতো দেখিতিস যদি চেয়ে।’ মৃত্যুর কাছে পরাজয় এ এক অমোঘ নিয়ম কিন্তু সবাই যখন একে একে চলে যায় সেই নিঃস্ব বুড়ো আমাদের ‘রাইডারস টু দ্য সি’র মরিয়ার কথা মনে করিয়ে দেয় : ‘শত কাফনের শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি, গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারাদিন রাত জাগি।’ পল্লী জীবন যে কত সঙ্কটময় আর ভয়াবহ যাতনার হতে পারে ঘুরে ফিরে আসে এই কথা এই কবিতায় : ‘সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।’ কবিতার শেষাংশটুকু গভীর বিষাদ ছড়িয়ে দেয় আমাদের মনে : ‘আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি, দাদু, ধর-ধর বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।’ ‘নক্সী-কাঁথার মাঠ’ ও ‘সাজন বাদিয়ার ঘাট’ অনবদ্যভাবে আবহমান বাংলার চিত্র তুলে ধরেছে। জসীম উদ্্দীন ছোট মানবীয় ঘটনাগুলোকে এত চমৎকার গুরুত্ববহ করে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা দিয়েছেন যা কাব্য দুটিকে বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ সম্পদ করে রেখেছে। এগুলো আরও দক্ষ অনুবাদক দিয়ে অনুবাদ করা হলে বলা হয় জসীম উদ্্দীনের জন্যে নোবেল পুরস্কারের দাবিদার হতেন। এখানে প্রেম আছে, বাঙালী মনের বিরহকাতরতা আছে, অবিরল প্রকৃতি আছে, সম্প্রীতি আছে, লোকজ ঐতিহ্যের পরিস্ফুটন স্পষ্ট আর মুসলমান হিন্দুদের সৌহার্দ যেমন আছে বিবাদের বিষাদময় বর্ণনা আছে বিশেষ করে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটে।’ ‘নক্সী-কাঁথার মাঠ’ জসীম উদ্্দীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এটি একটি কাব্যপোন্যাস। বাংলার মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি যেমন এখানে অবিচলরূপে বিবৃত তেমনি দৈনন্দিন গ্রাম্য জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিঁখুতভাবে অঙ্কিত। বাংলা মানুষের হৃদ-স্পšদন তার কবিতায় এখনও জীবন্তাকারে পাওয়া যায়। এদিক দিয়ে দেখলে তার কবিতার নৃতাত্ত্বিক গুরুত্বও অপরিসীম। পল্লীর শোভা, সুগন্ধ সাবলীলভাবে ‘নক্সী-কাঁথার মাঠ’ কাব্যে উপস্থিত। রাখাল বালক সাজু আর রুপাইয়ের প্রেম গাথা কোনো অংশে লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ত্রিস্তান ও ইসোল্ট’ (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এটিকে ‘সোনালি দুঃখ’ নামে অনুবাদ করেছেন), বিখ্যাত প্রেম কাহিনীর চেয়ে ক্ষুদ্র নয় বরং পল্লীর ছোট্ট প্রেম কাহিনীকে কবি মহিমায় করেছেন তার অসাধারণ শিল্পি শক্তিতে। রূপাই আর সাজু দুই গ্রামের দুই কিশোর-কিশোরী একে অপরের প্রেমে পড়ে- একদিন তাদের বিয়েও হয়। সুখের স্বর্গ রচিত হয় গ্রাম্য কুঞ্জে কিন্তু তা বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একদিন রূপাই গ্রামের কিছু কৃষকের মারামারি-হানাহানিতে উপস্থিত থেকে রক্তাক্ত সেই মামারিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে; দোষী না হয়েও তাকে পালিয়ে যেতে হয় প্রিয়তম সাজুকে ফেলে। ফিরে আসবার কোন পথ থাকে না। সাজু প্রতিক্ষণ, প্রতি মুহূর্ত, দিন-রাত রূপাইয়ের অপেক্ষায় থাকে। স্বামী শোকে মূহ্যমান এক অসহায়া গ্রাম্য নারী; না জানি কত হাজার হাজার এমন অসহায়ের প্রতিচ্ছবি এই সাজু। কিন্তু তার প্রিয়তম আর ফিরে আসে না; তাই সাজু একটি নক্সী কাঁথায় তার মনের সমস্ত বেদনা, জীবনের করুণতম কথাগুলো লিখে যায় চিত্রাকারে। বেদনাহত সাজু রূপাইয়ের অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে মৃত্যুর কাছে হার মানে। চলে যাবার আগে সাজু তার মাকে অনুরোধ করে সে যেন তার কবরের সঙ্গেই যেন সেই নক্সী কাঁথাটি রাখে। এরপর একদিন রূপাই ফিরে আসে; ফিরে আসে নিঃস্ব পৃথিবীতে যেখানে তার সাজু নেই যে শুয়ে আছে মাটির মমতায় আর আরও বেশি মমতায় তার কবরে জড়ানো সেই নক্সী-কাঁথা। রূপাই সাজুর এই চলে যাওয়া কীভাবে সহ্য করবে! রূপাই সাজুর সেই নক্সী-কাঁথা জড়িয়ে ধরে চরম বেদনায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এভাবেই এই অসামান্য কাব্যের মর্মান্তিক পরিসমাপ্তি ঘটে। উল্লেখযোগ্য বিষয় ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ বা ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ দুটি কাব্যেই কবি প্রেম আর পল্লী বাংলা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ এ রয়েছে পল্লী প্রকৃতির সুন্দরতম রূপায়ণ যা বাংলা সাহিত্য আর কেউ করেননি। যেমন : ‘বুকে তাহার এ-গাঁর ও-গাঁর হরেক রঙের পাখি, মিলায় সেথা নতুন জগত নানা সুরে ডাকি। সন্ধ্যা হলে এ-গাঁর পাখি ও-গাঁর পানে ধায়, ও-গাঁর পাখি এ-গাঁয় আসে বনের কাজল ছায় । এ-গাঁর লোকে নাইতে আসে, ও-গাঁর লোকেও আসে জলীর বিলের জলে তারা জলের খেলায় ভাসে।’ ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ দুটি গ্রাম্য ছেলেমেয়ের প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত গ্রাম বাংলার একটি অপূর্ব রূপকথা তবুও মনে হয় সব চরিত্রগুলোকে আমরা চিনি; প্রেমের আড়ালেই জসীম উদ্্দীন নিখুঁতভাবে গ্রামের সামন্ততান্ত্রিক প্রথার সমালোচনা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিবৃত্ত রেখে গেছেন। এটি একটি বহুল পঠিত বই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসটি সমন্ধে বলেছিলেন ‘তোমার সোজন বাদিয়ার ঘাট অতীব প্রশংসার যোগ্য। এই বই যে বাংলার পাঠক সমাজে আদৃত হবে, সে বিষয়ে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নেই।’ জসীম উদ্্দীনের বর্ণনা তা হোক প্রকৃতি, মানুষ, নারীর রূপ, মানুষের মনোভাবনার প্রতীকী উপস্থাপনা এতে তিনি কতটা স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন তার প্রমাণ এই কাব্যের অক্ষরে অক্ষরে পাওয়া যায়; আর মানুষ, প্রকৃতি, পল্লীর সূক্ষ্ম চিত্র আমাদের সামনে তার কাব্যের চরিত্রগুলোকে রক্ত-মাংসের করে তুলে; হারিয়ে যাওয়া বাংলার জীবন-কাহিনী এখনও যেন স্পষ্ট আর জীবন্ত হয়ে আছে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’-এ। এখানে মুসলমান, হিন্দুর সৌহার্দের সঙ্গে একত্রে বসবাসের বর্ণনা আছে : ‘নমু মুসলমানের আবাস, গলায় গলা ধরি খেড়ো ঘরের চালগুলো সব হাসছে মরি মরি।’ এই কাব্যে সোজন মুসলমান আর দুলী নিম্ন বর্ণ হিন্দু (নমু) কিন্তু ধর্ম তাদের সুগভীর প্রেমের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। জসীম উদ্্দীন এখানে দেখিয়েছেন কিভাবে মুসলমানদের মহররমে হিন্দুরা এসে অংশ নিত আবার হিন্দুদের পূজা, পার্বণ, কীর্তনে মুসলসানরা সহযোগিতা করত- ধর্মে ধর্মে বিভেদ না করা বাংলাদেশের এক প্রশংসনীয় মানবতাবাদীরূপ যা সারা বিশ্বে বিরল। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী বকধার্মিকের কারণে কখনও কখনও এই সম্প্রীতে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ রক্তক্ষরণ মানবিকতায় বা আক্ষরিক অর্থেই। দুলীর কাতর আর একনিষ্ঠ প্রেমের কারণে সোজন বিপদ জেনেও দুলীকে নিয়ে পালিয়ে তার বিয়েরক্ষণে। বনের হিং¯্র প্রাণী বা সাপ-খোঁপের হাত থেকে রক্ষা পেলেও হিন্দু নায়েবের রোষানল থেকে রক্ষা পায় না সোজন। তাদের বিচ্ছেদ আমাদের ‘ডাচিস অব মালফি’র হতভাগ্য ডাচিস ও এ্যান্টোনিওর কাছে নিয়ে যায় যারা জাতপাতের কারণে অন্ধকার অমানিশার অতলে ডুবে সুতীব্র প্রেমের জন্যে জীবন দিতে বাধ্য হয়। সোজন আর দুলীও এমনি অন্ধকার জগতের করুণ শিকার। দুলীর ভালবাসাই যে ছিল চরম ভুল আর মৃত্যু যে অবধারিত তা সে জানে; সে মৃত্যুকে বেছে নেয় কারণ সমাজ সত্যের পথে যুগে যুগে অন্তরায়। তার ভালবাসার উক্তি অমর হয়ে থাকবে : ‘মন সে তো নহে কুমড়ার ফালি / যাহারে তাহারে কাটিয়া বিলান যায়।’ সে একজনকেই ভালবেসেছিল তাই জীবন চলে গেলেও তার ভালবাসাকে সে তুচ্ছ করতে পারে ন। সমাজের হাতে যে বাঙালীনারী চির অসহায় এই কথাও জসীম উদ্্দীন বলে গেছেন। যেমন তার ‘কবর’ কবিতায় এই চরণটি ‘শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে’ অথবা ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’-এ হতভাগ্য দুলীর বিলাপ নারীদের অসহায়ত্ব অঙ্কন করে : ‘না- না দুলী সব ভুলিয়া গিয়াছে; নারী সে যে অসহায় মন যে তাহার খেলার পুতুল সমাজের হাতে হায়।’ বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ। পল্লী বা গ্রামই আমাদের প্রায় নিত্য প্রয়োজনীয় সকল উপকরণের চাহিদা মেটায়। শহর, নগর আর এর মানুষজন পল্লীর এই উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু যুগ যুগ ধরে এই গ্রামই থেকে যায় উপেক্ষিত আর বঞ্চিত। গ্রাম্য কথাটি আমাদের দেশে ব্যবহার করা হয় কটূক্তি করতে, তাচ্ছিল্য করতে। আমরা মুখে যতটা গ্রামের প্রতি প্রীতির কথা বলি মনে তা লালন করিনা তা আমরা সবাই নিজেকে প্রশ্ন করলেই উপলব্ধি করতে পারব আমরা কতটা পল্লীবিমুখ। পল্লীর প্রতি ভালবাসা অনেকটাই লোক দেখানোর মতো ভাসা ভাসা অন্তরের ভেতর থেকে তা আসে না। কথাগুলো বলা সামগ্রিক অর্থে। আর সামগ্রিক অর্থে পল্লী বলতে শুধু গ্রাম, এর কুঁড়ে ঘর বাড়ি, ধানের ক্ষেত বোঝায় না; পল্লীর প্রকৃতি এর ডোবা, নালা, নদী, মাঠ, ঘাস, লতা, গুল্ম সবই পল্লীর মাঝে একীভূত হয়ে যায়। এর সাথে রয়েছে পল্লী মানুষের আচার, অনুষ্ঠান, রীতি, খাওয়া, ভাষা, চিন্তা , অভ্যাস, ভাবনা, কৃষ্টি-কালচার আর মানসিকতার বৈশিষ্ট্যসমূহ। কিন্তু লোকজ বাংলার ঐতিহ্য, লোকাচারসমৃদ্ধ সংস্কৃতি থেকে আমরা ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ মাটির টানে ফিরে যেতে বলেছেন, ধানের ক্ষেতে অপরূপ বাংলার রূপ দেখে বিমুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু আধুনিকতার প্রতি মোহ, আর শহুরে ও নাগরীক জীবন অন্বেষী এই যুগে আমাদের কাছে আমাদের মহামূল্যবান পল্লী স্মৃতিগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে। পরিতাপের বিষয় হলেও পল্লী বাংলার সেই সৌরভ আজ বিলুপ্তির মুখে। যেখানে আমেরিকা তার ৬০ ভাগ বনভূমি আর কানাডা ৬৮ ভাগ প্রকৃতি অক্ষত রেখেছে সেখানে আমরা নগরায়নের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার হেক্টর আবাদী জমি, প্রকৃতি আর বনভূমি ধ্বংস করে আমাদের কোমল পল্লীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলছি। আমাদের শেকড় যে পল্লীতে, আমাদের আত্ম-পরিচয়ের কেন্দ্র যে গ্রামকেন্দ্রিক জীবনাচার তা যদি আমরা ভুলে যাই তবে আমরা বাঙালী সত্তা, আমাদের নিজস্ব লোকজ ঐতিহ্য, হাজার বছরের পুরনো রুচি, বোধ, লৌকিকতা, মনোভাবনা, বিশ্বাস, মানবিকতা, লোকশিল্প নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আমরা আত্ম-পরিচয় হারিয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে যাবো; আর আমাদের ভবিষ্যত জনগোষ্ঠীর ওপর অন্য কোনো বহির প্রভাব এসে দুর্বল করে দেবে আমাদের নিজস্বতাকে। যখন এই সঙ্কটময় অবস্থার আশঙ্কা তখন আমাদের মুখ ফিরাতে হয় আমাদের সৃষ্টিশীল সাহিত্য কাজে যেখানে আমরা আমাদের আমিকে; আমাদের সংস্কৃতির, জীবনাচারের সত্যরূপটি খুঁজে পাব। আমরা জসীম উদ্্দীনের কবিতায় আবার আমাদের নিজেকে খুঁজে ফিরে পেতে পারি; যা আমাদের বর্তমানের উদ্দেশ্যবিহীন সাংস্কৃতিক জীবন চর্চাকে শিকড়ে ফিরিয়ে আনতে পারি। জসীম উদ্্দীন আমাদের মাঝে আর নেই; পহেলা জানুয়ারি তার জন্মদিবস অতিবাহিত হয়ে গেছে কিন্তু তা খুবি নিভৃতে; কোন পল্লী গাঁয়েও তার কোন কবিতা পাঠ বা গানের সুর ধ্বনিত হয়নি, যা আমাদের জন্য শুধু লজ্জার নয় আত্ম-প্রবঞ্চনাও বটে। আমরা যদি আমাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টিকে, লোকজ অতিতকে ভুলে যাই তবে তা আমাদের জাতীয় মর্যাদা চরম অবহেলার শামিল হবে। আমাদের সামনের দিকে এগোতে হলে আমাদের পেছনের ঐশ্বর্যময় পল্লী সমাজকে জানতে হবে; আর তা জানতে হলে আমাদের আবার জসীম উদ্্দীনের কাছে ফিরে যেতে হবে অন্য ধার করা সংস্কৃতির কাছে ঋণী হয়ে নয় আমাদের নিজের অমূল্য ভা-ারে হাত বাড়িয়েই।
×