ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ছোটদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে রাঘব বোয়াল রক্ষা করতে চাইছে প্রভাবশালী মহল

পাঠ্যবই কেলেঙ্কারির নায়কদের রক্ষার অপচেষ্টা!

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

পাঠ্যবই কেলেঙ্কারির নায়কদের রক্ষার অপচেষ্টা!

বিভাষ বাড়ৈ ॥ পাঠ্যবই কেলেঙ্কারির নায়কদের রক্ষায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে দুই মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রভাবশালী কর্মকর্তারা। কয়েক ছোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর সব দায় চাপিয়ে কেলেঙ্কারির রাঘববোয়ালদের রক্ষায় আয়োজন চলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা অপরাধী চক্রকে রক্ষা করতে তদন্ত কমিটিকে প্রভাবিত করা এমননি মন্ত্রীসহ সরকারের কাছে ভুল তথ্যও তুলে ধরছেন। এদের হাত ধরেই হয়েছে হেফাজত-জামায়াতী পাঠ্যবই। এদিকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বই প্রত্যাহার ও বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি তুলেছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ। এবার কারিকুলাম নিয়ে কলেঙ্কারি হলেও এখন পর্যন্ত কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির মূল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যারা বিতর্কিত এ কারিকুলাম অনুমোদন করেছে সেই কমিটির কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং এদের নিয়েই গঠন করা হয়েছে একাধিক তদন্ত কমিটি। অভিযোগ উঠেছে নিজেরা রক্ষা পেতেই ভুলত্রুটির জন্য প্রীতিশ কুমার সরকার ও লানা হুমায়রা খান নামে দুই কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বোর্ডের আর্টিস্ট কাম ডিজাইনার সুজাউল আবেদিনকে। অথচ ‘পাঠ্যবইয়ে ছাগলের আম খাওয়ার ছবি’ ‘ও তে ওড়না চাই’ ‘বিখ্যাত কবিতার লাইনে বিকৃতি’ অধিকাংশ বিষয়ের অনুমোদনসহ সদস্য কারিকুলামের (প্রাথমিক) হাত ধরেই এসেছিল। এমনকি আগের বছরের পাঠ্যবইয়ে কবিতার লাইন ঠিক থাকলেও এবার সেখানে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। কারিকুলাম সদস্য ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটির অনুমোদনের পর নির্দেশ অনুসারে বইয়ের প্রচ্ছদ প্রণয়ন ও ছাগলের আম খাওয়ার ছবি আর্টিস্ট এঁকেছেন বলে সকল দায় তার ওপরই চাপানো হয়েছে। নিজেরা রক্ষা পেতে ছোট কর্মকর্তাদের শায়েস্তা করা হলেও সদস্য কারিকুলাম আবদুল মান্নান আবার জনকণ্ঠকে বলেছেন, ‘ওই ছবিটি অসাধারণ।’ এ কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত ভুলের বিষয়টিকে বড় কোন সমস্যা মনে করছেন না। প্রতিষ্ঠানটিতে বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা গেছে রীতিমতো থমথমে অবস্থা। কোন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক কর্মকর্তা বলেছেন, চেয়ারম্যান, কারিকুলাম সদস্য, মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটির সুপারিশ ছাড়া বইয়ে কোন কিছু ঘটেনি। এখন সকল দোষ চুনোপুুঁটির ওপর চাপিয়ে বড়রা পার পেতে চান। এ নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও সাহস করে কেউ প্রতিবাদ জানাতে পারছেন না। এনসিটিবিতে থাকা বড় কর্মকর্তাদের কিছুই করছে না মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ওএসডি হওয়া তিনজন ছাড়া বাকিরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, মূল নায়কদের রক্ষায় তুলনামূলক ছোট কর্মকর্তাদের শাস্তি দিতেই উঠেপড়ে লেগেছে মন্ত্রণালয়ের চক্রটি। চলতি বছরের পাঠ্যবইয়ে ভুল এবং সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার জন্য এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা, এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক সরকার আবদুল মান্নান, সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান কোনভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। অথচ তাদের বেলায় এখনও নীরব শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকের বইয়ের সকল কাজ করেছে প্রাথমিক কারিকুলাম সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা। বিকৃতি হলে দায় তাদেরই। সরকার আবদুল মান্নান পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রাথমিক শিক্ষা উইংয়ের প্রধান। ১২ বছর ধরে তিনি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিভিন্ন পদে কাজ করছেন। গত ১২ দিনে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বিভিন্নরকম তথ্য দিয়েছেন। প্রাথমিকের বইয়ে ভুলের জন্য বোর্ডের টিম প্রধান হিসেবে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার দাবি উঠলেও মন্ত্রণালয় রহস্যজনক কারণে নীরব। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে আরও অন্তত ১৫ কর্মকর্তা রয়েছেন যাদের কর্মকা- নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বোর্ডের সচিব থেকে গবেষণা কর্মকর্তা পর্যন্ত অনেকেরই রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের বিরুদ্ধেই শিবিরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের প্রগতিশীল শিক্ষকরা। এদিকে এনসিটিবির বড় কর্মকর্তাদের পার পেয়ে যাওয়ার রহস্য সম্পর্কে জানা গেছে, ‘পাঠ্যপুস্তকের কারিকুলাম (পাঠ্যক্রম) উলোটপালোট ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে ধর্মীয় বিষয়বস্তু ছাপতে বাধ্য করেছেন শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দু’জন অতিরিক্ত সচিব। তাদের একজন একটি পর্যটন জেলার ডিসি ছিলেন এবং আরেকজনের গ্রামের বাড়ি সিলেট। এই দুই কর্মকর্তাই পাঠ্যক্রম তৈরি থেকে বই মুদ্রণ পর্যন্ত যাবতীয় কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা ইতোমধ্যেই বৈঠকে এনসিটিবির মূল কর্মকর্তা বিশেষত সদস্য কারিকুলামসহ উর্ধতনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থ্ ানেয়ার কথা বলেছেন। শিক্ষামন্ত্রীসহ অন্যদের কাছেও তোলা হয়েছে বিষয়টি। তবে এক অতিরিক্ত সচিব বলেছেন, সদস্য কারিকুলামের বিষয় পরে ভাবা যাবে। জানা গেছে, প্রাথমিকের বইয়ের অধিকাংশ বিবৃতির ঘটনা চূড়ান্ত হয়েছিল গত ১৬ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এনসিসিসির সভায়। অনুমোদন দেয়া কোন বইয়ে কোন কবিতা লেখা থাকবে? কোনটা বাদ যাবে। সে অনুসারেই ছাপা হয় বই। এদিকে নিজেরা কোন দায় নিতে রাজি নয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান। তারা যা বলে এনসিটিবি তাই করে। এনসিটিবিতে প্রাথমিক শিক্ষার একটি উইং থাকলেও সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লোকজন কর্মরত। ফলে এনসিটিবিতে আমাদের লোকবল নেই। আমাদের লোকবল না থাকায় আমরা সেখানে কোন কাজই করতে পারি না। এক কথায় পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল। পা-লিপি পরে দেয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপানো হয় ন্যাশনাল টেন্ডারের মাধ্যমে। আর প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপানো হয় ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডারের মাধ্যমে। ফলে একটু সময় লাগে। এটি বুঝতে হবে, শুধু যা খুশি তা বললেই হবে না। তারমতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের খবরদারি এবং প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ের লোকবল এনসিটিবিতে না থাকার কারণেই প্রাথমিকের বইয়ে ভুল হয়েছে । সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক প্রত্যাহার দাবি ॥ পাঠ্যপুস্তকে ‘সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক’ বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যত আরও বিপন্ন করে তুলবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা। ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেছেন, পাঠ্যপুস্তকের যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে সাম্প্রদায়িকতার সূক্ষ্ম চর্চা আছে, ধর্মীয় বিদ্বেষ ও বৈষম্য তৈরির একটি প্রক্রিয়া আছে। এ অবস্থায় এসব পাঠ্যবই প্রত্যাহারের সঙ্গে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘু পরিস্থিতি-২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়।
×