ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপত্তার খাতিরে বন্ধ রাখা হয় কলাপসিবল গেট!

কেমন চলছে ঢাকা মেডিক্যালের ওয়ান স্টপ

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

কেমন চলছে ঢাকা মেডিক্যালের ওয়ান স্টপ

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি)। নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসা সেবা মেলে এখানে। যৌতুকের জন্য বা অন্য নানা কারণে নির্যাতনের শিকার নারীদের এখানে রেখে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। ঢাকা মেডিক্যালের ওসিসি নিরাপত্তার প্রয়োজনে একটি কলাপসিবল গেট দিয়ে সবসময় বন্ধ রাখা হয়। ‘অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ’ সেখানে। এর মধ্যে একটি কক্ষে রাখা হয় নির্যাতিতদের। অথচ যদি কোন কারণে তারা বেড ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন তাদের নানারকম কটূক্তি শুনতে হয় কর্তব্যরত কর্মচারীদের কাছ থেকে। ‘আপনি কোন সাহসে বাইরে আসছেন, কে বলছে বেড ছেড়ে বাইরে আসতে? যে কা- করে এইখানে আসছেন তা আবার সাংবাদিকের কাছে বলেন! লজ্জা নাই? ভেতরে যান’ নির্যাতনের শিকার মেয়েশিশু ও নারীদের সহায়তা দিতে খোলা ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সহযোগী ও আয়া হিসেবে গেটের বাইরে যারা থাকেন, তাদের বেশিরভাগই নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার নারীদের সঙ্গে এভাবেই আচরণ করেন অহরহ। তাদের মধ্যে কোন মানবিক আচরণ নেই। এমনকি এদের নিয়ে উর্ধতন কর্মকর্তারাও বেশ বিব্রত পরিস্থিতিতে আছেন। তবে মিডিয়ার সামনে তারা সতর্কতা অবলম্বন করেন। অনেক কথা স্বীকার করেন না তারা। আবার মিডিয়ার সঙ্গে ভুক্তভোগী নির্যাতিত নারীদেরও কথা বলতে নিষেধ করে দেয়া হয়। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে, রোগীর অপেক্ষমাণ আত্মীয় পরিচয় দিলে এক আয়ার মুখে কথা ফোটে। তিনি বলেন, ‘এহানে বেবাগ বিবাহিতরা ফাজলামি করে। আরামের জায়গা মনে করে এইডা। বাচ্চাগো কথা আলাদা আফা। স্বামী-শাশুড়ি শায়েস্তা করার জায়গা পাইছে। ঠিকমতো বেডে থাকে না, কথা শোনে না। সাংবাদিক আইছে শুনলেই দৌড়ে বাইরে আসে।’ ২০০১ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেকে) প্রথম চালু হয় ওসিসি কার্যক্রম। পরবর্তীতে বিভাগীয় শহরসহ আটটি ওসিসি ও জেলা পর্যায়ে ৪০ এবং উপজেলা পর্যায়ে ২০ ওসিসির মাধ্যমে নির্যাতিত নারী-শিশুদের ফরেনসিক ডিএনএ পরীক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক পুনরেকত্রীকরণ, পুনর্বাসন, আইনী সহায়তা, মনোসামাজিক কাউন্সেলিংসহ নির্যাতিত নারীদের সহযোগিতা করে থাকে ওসিসি। ওসিসিতে ভর্তি থাকা নির্যাতিত নারীদের সঙ্গে কোন আত্মীয় আছে কি-না জিজ্ঞাসা করলে আয়া বলেন, ‘থাকবো না আবার! এরা মাইর খাইছে স্বামীর কাছে, মামলা দিব, সেবা নিব। কোন স্বামী মারে না। খামাখা এইহানে ভিড় করে।’ ওসিসির কর্তব্যরত আয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় হঠাৎ এক নির্যাতিতের দেখা মিলল। ডেমরা থেকে আসা মেয়েটিকে তার স্বামী নির্যাতন করে কোমর আর পায়ের কিছু অংশ থেতলে দিয়েছে। মেয়েটি তার শরীরের জখম হওয়া অংশগুলো দেখানোর চেষ্টা করলে, পাশে থাকা আরেক আয়া বলেন, ‘কেউ আসলেই শরীর দেখাইতে আসেন। লজ্জা নাই না-কি?’ ওসিসিতে উপস্থিত এসব আয়ার মুখের ভাষা শুনেই স্পষ্টত হয়ে যায় এখানকার নির্যাতিত রোগীরা কতটা অপমাণ ও অমানবিকতা সহ্য করে এখানে থাকছেন। অমানবিকতার পাশাপাশি অপরিচ্ছন্নতাও লক্ষ্যণীয় ওসিসিতে। সরেজমিনে দেখা গেল, দুপুরের খাবার আসার পর মোট বিশটি হাসপাতালের স্টিলের খাবারের প্লেটে ভাত, সবজি ও মাছ রাখা হলো এবং সেই প্লেটগুলো একটির ওপর একটি রাখায় ভাত তরকারি মাখামাখি, একটি প্লেটের নিচের ময়লা আরেকটি প্লেটের ভাতের ওপর। এবার একে একে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রোগীরা খাবার নিয়ে যান। রোগীদের খাবার পরিবেশনের সময় মূল ফটকের সামনেই তরকারির ঝোল আর ডালে মেঝে ভিজে গেলে একটা কাপড় এনে সেটি সঙ্গে সঙ্গে মুছে দেয়া হয় ঠিকই, কিন্তু কাপড়টি সেখানেই ফেলে রাখা হয় এক কোণায়। মাছি উড়ছে। ওসিসির ভেতরের চিত্রে যেমন রয়েছে অমানবিকতা তেমন রয়েছে নির্যাতিতদের প্রকাশ করতে না দেয়া একেকটি ঘটনা। ওসিসিতে নির্যাতিতদের মা, বোন অথবা কোন নারী ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না, সেহেতু বাইরে অধীর আগ্রহে তাদের বাবা, ভাই বা স্বজনরা অপেক্ষা করেন। এক নির্যাতিতের ভাই জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমার বইন আজ পাঁচ দিন ধরে এইহানে ভর্তি আছে। ওর জামাই ওরে যৌতুকের লাইগা মাইরা জখম করছে। ভেতরে আম্মা আছে। তয় ওগো কাছে মোবাইল ফোন নাই। কি আর করতাম! বইসা আছি কহন কি লাগব তাই। খবর পাঠাইছি, ঘণ্টা যায় কিন্তু ভেতরের খবর আইনা দেয় না। কই বিশ টাকা দিলে তাড়াতাড়ি খবর পাইয়া যামু না-কি।’ ওসিসি’র সমন্বয়ক ড. বিলকিস এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বললেন, ‘আমি এসব বিষয়ে কখনও কিছু শুনিনি। অবশ্যই, আমরা দেখব এ ধরনের কোন কিছু ঘটেছে কিনা। তবে, এখানে যেসব রোগী আসে, তাদের সামলানোও খুব সহজ কাজ নয়।’ গত তিন বছরের চেয়ে ২০১৬ সালে দেশের ৬০ ওসিসি থেকে ৯ হাজার ৩শ’ ৮১ নির্যাতিত নারী চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ৭ হাজার ৩শ ৪৮, ধর্ষণের শিকার ৮শ’, দগ্ধ ৫৩, এসিডের শিকার ৬০, মানসিক নির্যাতনের শিকার ৮শ ৩১ জনসহ অন্যান্যভাবে নির্যাতিত হওয়া ২শ’ ৮৯ নারী ওসিসিতে চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন। ২০১৫ সালে চিকিৎসা সেবা পাওয়া নারীর সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ১৬। এছাড়া, ২০১৩ তে ছিল ৪ হাজার ৩শ’ ৯১ ও ২০১৪ তে এর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৪শ’ ৪০।
×