ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লিটন হত্যায় আরও চার জামায়াত শিবির ক্যাডার গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

লিটন হত্যায় আরও চার জামায়াত শিবির ক্যাডার গ্রেফতার

গাফফার খান চৌধুরী/আবু জাফর সাবু ॥ গাইবান্ধায় বাড়িতে ঢুকে গুলি চালিয়ে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যায় ঢাকা ও গাইবান্ধা থেকে জামায়াত-শিবিরের দুজন করে চারজন গ্রেফতার হয়েছে। এ নিয়ে লিটন হত্যায় এক আওয়ামী লীগ নেতাসহ সর্বমোট ১৪ জন গ্রেফতার হলো। এদের অধিকাংশই জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী ও ক্যাডার। ঢাকা থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত দু’জনই শিবির নেতা। তারা প্রশিক্ষিত শিবির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। এদের একজন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানা জামায়াতে ইসলামীর আমিরের ছেলে আশরাফুল। অপরজন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জহিরুল ইসলাম। সেও শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডার। গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। সংসদ সদস্য হত্যার পর থেকেই তারা পলাতক ছিল। গ্রেফতার এ দুজন সংসদ সদস্য হত্যার অন্যতম প্রধান সন্দেহভাজন আসামি। বৃহস্পতিবার ভোরে রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব দু’জনকে গ্রেফতার করে। এরা হচ্ছে, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমির (পশ্চিম) হাজী ইউনূসের ছেলে আশরাফুল ও তার সহযোগী জহিরুল ইসলাম। র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, গ্রেফতাররা সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান সন্দেহভাজন আসামি। তাদের মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা সুন্দরগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রসঙ্গত, বিদায়ী বছরের শেষদিন ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর পরই সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শাহবাজ গ্রামের নিজ বাড়িতে ঢুকে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে লক্ষ্য করে হত্যার উদ্দেশে গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। গুলিতে লিটন মারাত্মক আহত হন। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে লিটনের বোন তাহমিদা বুলবুল বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৪/৫ জনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যেটির তদন্ত করছে থানা পুলিশ। মামলার বাদীর দাবি, জামায়াত-শিবির তার ভাইকে হত্যা করেছে। র‌্যাবের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, আশরাফুল ঘটনার দিন সকালে বাড়ি থেকে একটি কালো রঙের পালসার মোটরসাইকেল নিয়ে একাই বের হয়। পরে তিনি জহিরুলকে সঙ্গে নেন। লিটন হত্যার পর থেকে আশরাফুল ও জহিরুল আর বাড়ি ফেরেনি। দু’জন শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডার। আশরাফুল ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় অবস্থিত ক্যাম্পাসে বিবিএ’র ছাত্র। সে পুলিশ হত্যা মামলার আসামি। অপরজন জহিরুলের বিরুদ্ধে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানায় গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার পাঁচটি মামলা রয়েছে। সূত্র বলছে, সংসদ সদস্য লিটন হত্যার পর থেকেই আশরাফুল ও জহিরুল আর বাড়ি না ফেরায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহ বাড়তে থাকে। কারণ, হত্যাকারীরাও হত্যাকা- সংঘটিত করতে একটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করেছে। যেটি কালো রঙের ভারতীয় মোটরসাইকেল বলে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে সন্দেহভাজন এ দু’জনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনার দিন একটি মোটরসাইকেলে তিনজন সংসদ সদস্যের গ্রামের বাড়িতে যায়। একজন মোটরসাইকেল চালু রেখে বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছিল। বাকি দুজন হেলমেট পরিধান করেই সংসদ সদস্যের বাড়িতে ঢোকে। তারা সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলার ছলে ভেতরে ঢুকে খুব কাছ থেকে গুলি চালায়। আর তাতেই সংসদ সদস্যের মৃত্যু হয়। গাইবান্ধা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা আবু জাফর সাবু জানান, বৃহস্পতিবার ভোরে পুলিশ সংসদ সদস্য লিটন হত্যা মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন আসামি মনিরুল ইসলাম রতনকে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন সাদুল্যাপুর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের তাহেরপুর গ্রামের তার খালাশ্বশুর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। রতন গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের প্রতাপ গ্রামের বিভিন্ন নাশকতা মামলারও আসামি। তার পিতার নাম মৃত মফিজুল ইসলাম। লিটন হত্যার পর থেকেই রতন পলাতক ছিল। সে জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডার ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গার পুলিশ ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ৪ পুলিশ হত্যাসহ একাধিক নাশকতা মামলার অন্যতম আসামি রতন। সাদুল্যাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম নয়ন এবং নলডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মাইদুল ইসলাম প্রিন্সের আপন ভাই রতন। তারা রতন গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অপর আরেকটি অভিযানে সংসদ সদস্য হত্যার অন্যতম সন্দেহভাজন আসামি জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডার সাইফুল ইসলাম পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে দিনাজপুর জেলার আউলিয়াপুর গ্রামে তার এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে গাইবান্ধা পুলিশ দিনাজপুর পুলিশের সহযোগিতায় তাকে গ্রেফতার করে। সাইফুল সংসদ সদস্য লিটন হত্যার পর থেকেই পলাতক ছিল। সে একাধিক নাশকতা মামলার আসামি। তার পিতার নাম ইউনূস আলী। বাড়ি জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শিবরামপুর গ্রামে। এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গত বুধবার জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও যুবদলের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া চার জনের কোন হদিস মেলেনি। তুলে নিয়ে যাওয়া ওই চার জনের মধ্যে সন্ত্রাসী রতনের ভাই মাইদুল ইসলাম প্রিন্সও রয়েছে। রতনকে গ্রেফতার করতেই ওই চার জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এ ব্যাপারে জামায়াত ক্যাডার রতনের ভাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নলডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলাম নয়ন বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে নলডাঙ্গা রেলগেট এলাকা থেকে মোটরসাইকেলসহ মাইদুল ইসলাম প্রিন্সকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে এ ব্যাপারে কোন কিছুই স্পষ্ট করা হয়নি। এখন পর্যন্ত লিটন হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে অনেককে গ্রেফতার করা হলেও হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটনে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয়নি। সংসদ সদস্য লিটন হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন ॥ বৃহস্পতিবার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের জামালহাট থেকে কালীতলা বাজার পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষিকা, অভিভাবক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ সরকারদলীয় বিভিন্ন সংগঠন। এমন কর্মসূচীতে যোগ দেন সমাজের নানা শ্রেণীপেশার মানুষ। মানববন্ধনে সরকারদলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও বক্তব্য রাখেন শিক্ষক জহুরুল ইসলাম বাদশা, ছাইদার রহমান ম-ল, পরেশ চন্দ্র ম-ল, সাজেদুল ইসলাম সাজু, একেএম ইউসুফ আলী, রেজাউল হক রেজা, সৈয়দ আবু নাসের মিরান, জাহেদুল ইসলাম জাবেদ, আব্দুল খালেক গাফলাদার, জাকির হোসেন, শহীদ লিটন মঞ্চের সমন্বয়ক ফয়সাল সাকিদার আরিফ, যুবলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ, নাদিম হোসেন প্রমুখ। বক্তারা ঘটনার ১৩ দিন পরেও হত্যাকা-ের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হত্যাকারীদের ফাঁসি দাবি করেন। এর আগে এ হত্যাকা-ে আরও দশজন গ্রেফতার হয়েছে। যাদের অধিকাংশই জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী ও প্রশিক্ষিত ক্যাডার। গ্রেফতারদের মধ্যে জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আহসান হাবিব মাসুদ, সুন্দরগঞ্জ উপজেলা পূর্ব অঞ্চলের জামায়াত আমির সাইফুল ইসলাম ম-লও রয়েছেন।
×