ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

ওবামার অশ্রুসিক্ত বিদায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

ওবামার অশ্রুসিক্ত বিদায়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মাধ্যমে দুই মেয়াদে থাকা বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ৮ বছরের পরিসমাপ্তি ঘটবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিদায়ের ৯ দিন আগে মঙ্গলবার তিনি জাতির উদ্দেশে শিকাগোতে শেষ ভাষণ দেন। এ ভাষণে ওবামা তার সময়ের সাফল্য, যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত ঝুঁকি, গণতন্ত্র, ঐক্য ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা বলেন। বিদায়ী ভাষণ দিতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হন ওবামা। যা বলা চলে, আগে কোন ভাষণে দেখা যায়নি। আমেরিকানদের সতর্ক করলেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মঙ্গলবার তিনি শেষ ভাষণ দেন। এতে সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ ও জাতীয়তাবাদের বিষয়ে তিনি হুঁশিয়ার করে দিলেন মার্কিন ভোটারদের। এ সময় তিনি বর্তমান বিশ্বে যেসব জটিল সমস্যা রয়েছে সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বরাবরের মতোই তিনি এদিনও ছিলেন দৃঢ়কণ্ঠের বক্তা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, রাজনীতিবিদরা মুসলিমদের কটাক্ষ করলে তা আমাদের নিরাপদ করে না। যখন একটি মসজিদে হামলা হয় বা কোন শিশু নিপীড়নের শিকার হয় তখন আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘিœত হয়। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাতে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে জাতির উদ্দেশে শেষ ভাষণ (স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন এ্যাড্রেস) দেয়ার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমাদের এমন রাজনীতি পরিহার করতে হবে, যা নির্দিষ্ট কোন গোষ্ঠী বা ধর্মকে আঘাত করে। এ বিষয়গুলোয় আসলে রাজনৈতিক সংস্কারের কোন প্রয়োজন নেই। এগুলো বোঝার বিষয়। শান্তির কথা বলেন, যেমনটা তিনি এর আগে জাতিসংঘের ভাষণে বলেছিলেন। সময় এবং মানবজাতি এমন একটি পর্যায়ে এসেছে যেখানে বার বার যুদ্ধ ও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। হয়ত এটাই আমাদের পরিণতি। ওই ভাষণে ওবামা ঘোষণা করেন ৫০টি দেশ এ বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর ৩ লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীকে নেয়ার অঙ্গীকার করেছে। তিনি আরও বলেন, জার্মানি, কানাডাসহ বিশ্ব নেতারা গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ শরণার্থী নিতে চেয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে যুদ্ধ অথবা নির্মমতার শিকার হয়ে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে শরণার্থী হয়েছে। এর মধ্যে ৬ বছরের যুদ্ধকবলিত সিরিয়ারই রয়েছে ৯০ লাখ মানুষ। বাকিরা যুদ্ধকবলিত অন্য দেশগুলো থেকে পালিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বারাক ওবামা বলেন, আমরা আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না। পারি না পিছু ফিরতে। এসব বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য যদি আমরা দরজা বন্ধ করে দিই তাহলে আমাদের গভীরে যে মূল্যবোধ রয়েছে তার সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। ২০১৭ আর্থিক বছরে নতুন এক লাখ ১০ হাজার শরণার্থী নিতে রাজি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে ১ অক্টোবর থেকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সমর্থন দিয়ে রাশিয়া কৌশলগত ভুল করেছে। সিরিয়ার এই যুদ্ধ তার ও পুতিনের মধ্যকার কোন প্রতিযোগিতার বিষয় নয়। সম্প্রতি সিরিয়া নিয়ে মার্কিন সিদ্ধান্তহীনতার যে অভিযোগ উঠেছে তার জবাবে তিনি এ কথা বলেন। ওবামা বলেন, এটা আমার ও পুতিনের মধ্যকার কোন প্রতিযোগিতা নয়। তিনি বলেন, রাশিয়াকে যে প্রশ্নটি করা উচিত তা হলো, তারা কি মনে করছে যে তারা একটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশে কয়েক শ’ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করে বিজয়ী পক্ষের মিত্র হিসেবে খুব বড় কিছু অর্জন করতে পারবে? পুতিন মনে করে থাকতে পারেন যে, তিনি রুশ সৈন্যদের সহায়তায় সিরিয়াকে স্থায়ীভাবে দখল করার মতো প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু এর জন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হবে। দেশটির তিন-চতুর্থাংশ এলাকা আসাদের নিয়ন্ত্রণে নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত অস্ত্রবিরতি কার্যকর করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। এর জন্য পুতিনই অনেকটা দায়ী। সিরিয়ায় এক সপ্তাহের মধ্যে অস্ত্রবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা (ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে) একটি সাদা রুমাল দিয়ে চোখযুগল মুছে বলেন, ‘তুমি হোয়াইট হাউসকে এমন একটি জায়গায় পরিণত করেছ, যাতে এটি সবার হয়ে ওঠে। আর তোমার ভূমিকার কারণেই নতুন প্রজন্ম বড় হওয়ার ক্ষেত্রে তোমাকে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখছে। ওবামার জনসমক্ষে কাঁদার ঘটনা খুবই বিরল। অতীত ঘটনাগুলো তা-ই বলছে। তিনি যখন স্যান্ডি হুকে স্কুলে শিশুদের ওপর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বক্তব্য দিয়েছিলেন তখনও কাঁদেননি, তার দাদির কথা স্মরণ করেও কাঁদেননি। এমনকি ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে বিউ বাইডেনের মৃত্যুতেও নয়। কিন্তু এবার তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। ফলে ওবামা ও তার পরিবারের সদস্যদের কান্নার ঘটনা এক আবেগময় অবস্থার সৃষ্টি করে। জনসমুদ্রের সে কান্নায় যেন ট্রাম্পের আগমনে গভীর শোক ও আগত ট্রাম্প প্রশাসন নিয়ে ভীতির ধ্বনিও প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। বিদায়ী ভাষণে বর্ণবাদকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন দেশটির বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাত ও বাংলাদেশ সময় বুধবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ শুরু করেন। এ সময় তিনি তার আট বছর শাসনামলের নানা স্মৃতি রোমন্থন করেন। ওবামা বলেন, বর্ণবাদ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখনও অনেক বড় সমস্যা। এটা দেশের সম্প্রীতি নষ্ট করার পাশাপাশি অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারপরও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী (অভিবাসী) যুক্তরাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করেছে। পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণের জন্য একজন মার্কিনী যেমন কঠোর পরিশ্রম করেন তেমনি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রতিটি নাগরিককে কঠোর পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা চালাতে হবে। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের এ ভাষণ শুনতে কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছেন। টিকেট কেটে প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে ভাষণ শুনতে হাজির হন ওবামার একনিষ্ঠ ভক্তরা। এই শিকাগো শহর থেকেই ওবামা ২০০৮ এবং ২০১২ সালের নির্বাচনে জয় ঘোষণা করেছিলেন। আজ সেখানেই তিনি বিদায়ী ভাষণ দিলেন। এ সময় ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার স্ত্রী জিল বাইডেনও উপস্থিত হন। টানা দুইবার নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালনের পর আগামী ২০ জানুয়ারি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন বারাক ওবামা। ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে এটাই তার শেষ ভাষণ। মঞ্চে উঠে তিনি আমেরিকাবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘গুডবাই!’ উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ করে ওবামা বলেন, আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আট বছর পার করেছি। আমি আমার দেশ এবং দেশের মানুষের উন্নয়নের কথাই সব সময় ভেবেছি। আমি সব সময় সব বিষয়ে ইতিবাচক ছিলাম, সবাই যেখানে ব্যর্থ ছিল সেখানে আমি আশার আলো জাগিয়েছি। আমি মার্কিনীদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রসার ঘটিয়েছি। দেশে বেকারের সংখ্যা হ্রাস করেছি। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছি। আমি আশা করব শরণার্থী ইস্যুতে আমাদের যে অবস্থান রয়েছে তা ভবিষ্যতে আরও উন্নত হবে। আমি আশা করি আমরা সবাই মিলে সামনের সময়গুলোতেও একত্রে কাজ করতে পারব। আজ রাতে আমি সামনের দিনগুলোর জন্য সহজ কিছু প্রথাগত প্রস্তাবের তালিকা জানাতে চাই। চিন্তার কিছু নেই। আমি রোগীদের চিকিৎসার সুব্যবস্থার জন্য কম্পিউটার কোডকে পার্সোনালাইজ করে ব্যবহারের পদ্ধতি ছাত্রদের শিখতে সাহায্য করেছি এবং উন্নয়নের জন্য যেসব কাজ করা প্রয়োজন তা চালিয়ে যাব। অভিবাসন পদ্ধতির জন্য একটি নির্ধারিত পদ্ধতি, আমাদের শিশুদের বন্দুক সহিংসতা থেকে সুরক্ষা, কাজ ও বেতনের মধ্যে সমতা, বেতনভোগী ছুটি, ন্যূনতম মজুরিসহ বিভিন্ন কঠিন কাজ একত্রে সমাধান করতে হবে। ভাষণের এক পর্যায়ে ওবামা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও আলোচিত বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে বলেন, আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়। সন্ত্রাস এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে মার্কিনীদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাদের ভবিষ্যত নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেননা দেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আইএস এবং আল কায়েদা জঙ্গী সংগঠনের জন্য আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়েক দশক ধরে অস্থিরতা চলতেই থাকবে। নিজের শেষ ভাষণে ওই দুই জঙ্গী গোষ্ঠীকে সরাসরি হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন ওবামা। তিনি বলেন, আইএস এবং আল কায়েদা উভয়ই বর্তমান বিশ্বে আমাদের লোকজনের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাদের কাছে মানুষের জীবনের কোন মূল্য নেই। তারা নিজেদের জীবনেরও পরোয়া করে না। তারা বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করতে পারে। তারা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সহজ-সরল মানুষের মনের ওপর প্রভাব খাটাচ্ছে। আর এদের দিয়ে মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজ করাচ্ছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আইএস এবং আল কায়েদার হুমকির বিষয়টিকেও আলোকপাত করতে হবে।
×