ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সাদাসিধে কথা ॥ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

সাদাসিধে কথা ॥ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস

লেখাটির শিরোনাম দেখে যে কেউ একটু অবাক হয়ে যাবে। কোন কিছুকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিসেবে দাবি করে ফেলাটা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, সেই দাবিটি যদি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিয়ে করা হয় সেটাকে অবিশ্বাস করা হলে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলো সত্যি, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিয়ে আমার অভিজ্ঞতাটুকু লিখতে বসেছি। কয়েক মাস আগে কুলিয়ারচরের ইউএনও আমাকে ফোন করলেন। তার পরিচয় জেনে আমি যথেষ্ট মুগ্ধ হলাম। নাম ডক্টর উর্মি বিনতে সালাম, আমাদের দেশের ইউএনওরা ডক্টরেট করছেন জেনে মুগ্ধ না হয়ে উপায় কী? ড. উর্মি ফোনে আমাকে যেটা বললেন সেটা শুনে আমি চমৎকৃত হলাম। তিনি বললেন, স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসটি অস্ট্রেলিয়াতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি তার চাইতে বড় একটি ক্লাস করাতে চান! অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে তাদের সকল সাহায্য সহযোগিতা সুযোগ সুবিধা সহায় সম্পদ নিয়ে যে বিশ্ব রেকর্ডটি তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের একটি উপজেলাতে সেটি ভাঙ্গার পরিকল্পনা করতে বুকের পাটা লাগে। আমি তাঁর বুকের পাটা দেখে যথেষ্ট অবাক হলাম। তিনি আমার কাছে একটা সাহায্য চাইলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসটির আয়োজন করা হয়েছে আমাকে সেটি নিতে হবে। আমি খুব আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম- স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কিছু একটা করার সুযোগ পাওয়া আমার জন্য বিশাল বড় একটা ব্যাপার। আমি ড. উর্মির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম সত্যি, কিন্তু তিনি আদৌ সেটা করতে পারবেন সেটা নিয়ে আমার ভেতরে তখনও যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ব রেকর্ডটি ভাঙতে হলে একটা ক্লাসরুমে কমপক্ষে তিন হাজার দু’শ’ ছাত্রছাত্রীকে হাজির করতে হবে। তাদের হাতে-কলমে কোন একটা এক্সপেরিমেন্ট করাতে হবে। এত বড় ক্লাসরুম কোথাও নেই, তাই সেটা তৈরি করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের বসার জন্য চেয়ার টেবিল যোগাড় করতে হবে। ছেলেমেয়েদের নিজ হাতে করার জন্য সমানসংখ্যক এক্সপেরিমেন্ট ছাড়া করাতে হবে। এর কোনটিই খুব সহজ নয়। সাহস থাকলেই বড় একটা পরিকল্পনা করে ফেলা যায়, কিন্তু শুধু সাহস দিয়ে বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় না। কাজেই আমি খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি, আমার মনে হতে থাকে কিছুদিনের ভেতরই ড. উর্মির আরও একটা ফোন পাব যখন তিনি লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবেন যে, তিনি শেষ পর্যন্ত ম্যানেজ করতে পারলেন নাÑ তাই এবারের মতো পরিকল্পনাটি স্থগিত করা হলো। কিন্তু সেই টেলিফোন এলো না এবং আমি যখন খোঁজ নিলাম তখন জানতে পারলাম সত্যি সত্যি তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসটির আয়োজন করার কাজ করে যাচ্ছেন! আমি তখন ছেলেমেয়েদের উপযোগী কয়েকটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড়া করালাম। ছোট বাচ্চাদের চুম্বক নিয়ে এক ধরনের কৌতূহল থাকে, তাই আমি চুম্বক তৈরি করা তাদের বিপরীত মেরুতে আকর্ষণ সমমেরুতে বিকর্ষণ, কম্পাসের উত্তর দক্ষিণ হয়ে থাকাÑ এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছু এক্সপেরিমেন্ট দাঁড়া করালাম। সেগুলো ছাড়া করানোর সময় লক্ষ্য রাখতে হলো খুব অল্প খরচে সেগুলো যেন দাঁড়া করানো যায়। কুলিয়ারচর অস্ট্রেলিয়া নয়, এ দেশের কিছু একটা করতে হলেই প্রথমেই আমাদের দেখতে হয় কত কম টাকায় সেটা আয়োজন করা যায়! জানুয়ারির ২ তারিখ কুলিয়ারচরে একটা সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হলো। সাংবাদিক সম্মেলন নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুব ভাল নয়। হোটেল সোনারগাঁও বা শেরাটনে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হলে আমি সাংবাদিকদের উৎসাহ নিয়ে যেতে দেখেছি! ছোটখাটো জায়গায় সেরকম উৎসাহ দেখিনি। আমি ড. উর্মিকে বলে রাখলাম কুলিয়ারচরের সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি যেন খুব বেশি সাংবাদিকদের আশা না করেন এবং সেই সংবাদটি পত্রপত্রিকায় ছাপা হবে সেটিও যেন আশা না করেন। এটি একটি আনুষ্ঠানিকতা এবং তিনি যে তার পরিকল্পনা মতো এগিয়ে যাবেন আর শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে আসতে পারবেন না তার একটা ঘোষণা ছাড়া কিন্তু নয়! কাজেই সাংবাদিক সম্মেলন হয়ে গেল এবং আমি আমার সহকর্মী আর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের ছেলেমেয়েদের জন্য এক্সপেরিমেন্টের, একটা কিট তৈরি করার কাজ শুরু করেছিলাম। এসব ব্যাপারে আমি অসম্ভব ভাগ্যবানÑ কিছু একটা করতে চাইলেই আমি আমার সহকর্মী এবং ছাত্রছাত্রীদের পেয়ে যাই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের সংগঠনের মাঝে ‘বিজ্ঞানের জন্য ভালবাসা’ নামেও একটা সংগঠন আছে তাদের সব সদস্য মিলে দিনরাত খেটেখুটে বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য কিটগুলো তৈরি করে ফেলল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট দিনটি হচ্ছে জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ, আমরা বাস বোঝাই ভলান্টিয়ার নিয়ে একদিন আগেই সেখানে পৌঁছে গেলাম। আমরা গিয়ে দেখি বিশাল আয়োজন, এতবড় প্যান্ডেল আমি জীবনে দেখিনি, এক কোনায় দাঁড়ালে অন্য কোনা প্রায় দেখা যায় না! চারজন করে বসতে পারে সেরকম বেঞ্চ এবং টেবিল বসানো হয়েছে। একেক সারিতে ২৫টি করে বেঞ্চ এবং টেবিল, সারির সংখ্যা ৩২! আগামীকাল এখানে তিন হাজার দুইশত ছেলেমেয়ে এসে বসে আমার কাছে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করবে। চিন্তা করেই আমার মাথা ঘুরে যাবার অবস্থা! আমাদের জন্য ডাকবাংলোয় রাত কাটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরদিন ভোরে হঠাৎ শুনতে পেলাম পাশের রাস্তার ছোট শিশুদের কলরব। বারান্দায় এসে দেখতে পেলাম রীতিমতো উৎসবে যোগ দেয়ার আনন্দ নিয়ে কোন একটা স্কুলের ছেলেমেয়েরা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করতে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলো দেখে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। আমি জানি পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা আসবেÑ কিন্তু তারা যে এত ছোট সেটা আমি মোটেও অনুমান করিনি। এই ছোট বাচ্চারা কী প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে বসে চুম্বক তৈরি করে সেটা দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে পারবে? যাই হোক, নির্র্দিষ্ট সময়ে আমি মাঠে হাজির হয়েছি। প্যান্ডেলের চারপাশে দশটি গেট, এই দশটি গেট দিয়ে সারি বেঁধে ছেলেমেয়েরা ভেতরে ঢুকছে। তাদের নিশ্চয়ই এই বিশাল দক্ষযজ্ঞ নিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। তার কারণ এত কম বয়েসী ছেলেমেয়েদের এত কঠিন শৃঙ্খলা দিয়ে আমি এর আগে কোথাও ঢুকতে দেখিনি! অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার জন্য ঢাকা থেকে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং এমপি নাজমুল হোসেন পাপন হেলিকপ্টারে করে আসবেন। হেলিকপ্টারে তারা সময়মতো পৌঁছাতে পারবেন না বলে আমাদের নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস শুরু করে দিতে বললেন। অনেক ভোরেই ছেলেমেয়েরা চলে এসেছে, এটা পৌষ মাস কিন্তু পৌষের শীতের কোন লক্ষণ নেই। প্যান্ডেলের ভেতর গরমে সবাই ঘামছে। দুপুর বারোটা থেকে শুরু করে দেড় ঘণ্টার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হবার কথা, কাজেই আমরা যদি দেরি করি তাহলে বাচ্চাদের কষ্ট দেবার একটা বিশ্ব রেকর্ড হয়ে যেতে পারে! তাই আমরা ক্লাস শুরু করে দিলাম। এটা যদি সত্যি সত্যি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হিসেবে প্রমাণ করা যায় তাহলে আমিও নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের শিক্ষক হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারি! পৃথিবীর কতজন মানুষের এ রকম সৌভাগ্য হতে পারে? আমি মনে মনে যেই বয়েসী ছেলেমেয়ে আশা করেছিলাম এই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে ছেলেমেয়েরা তার থেকে অনেক ছোট। আমি খুব দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলাম তারা সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক্সপেরিমেন্টগুলো করতে পারবে কি-না। কিন্তু শুরু করার পর আমি মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম তাদের জন্য সেগুলো ডাল-ভাত! লোহার পেরেকে তার প্যাঁচাতে গিয়ে আমি আধা আধি আসার আগেই তারা পুরোটুকু শেষ করে চুম্বক তৈরি করে এক্সপেরিমেন্ট করতে শুরু করেছে! আমার বলতে দ্বিধা নেই, তিন হাজার দুইশ’ কম বয়েসী ছেলেমেয়েদের এই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নেয়াটি ছিল আমার জীবনের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দের মুহূর্ত! শিশুরা সেই কাক ভোরে হাজির হয়েছে, গরমে সিদ্ধ হতে হতে তারা বসে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে, আমি যখন যেটি বলছি তারা সেটি করছে এর চাইতে আনন্দময় দৃশ্য আর কী হতে পারে? এই বয়েসী ছেলেমেয়েদের চুপচাপ বসে থাকার কথা নয়, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমি যতবার তাদের চুপ করে যেতে বলেছি তারা ম্যাজিকের মতো নিশ্চুপ হয়ে গেছে! তিন হাজার দু’শ’ ছেলেমেয়ে এতটুকু শব্দ না করে প্রয়োজনে পুরোপুরি নিঃশব্দে বসে আছে, মনে হচ্ছে নিঃশ্বাসের শব্দটুকুও আলাদাভাবে শোনা যাবেÑ আমার মনে হয়েছে সেটাও নিশ্চয়ই একটা বিশ্ব রেকর্ড হতে পারে! যথাসময়ে ঢাকা থেকে অতিথিরা হেলিকপ্টারে কুলিয়ারচরের এই বিশাল দক্ষযজ্ঞে উপস্থিত হলেন। ছোট একটুখানি আলোচনাপর্ব হলো। সবাই ছোট স্টেজে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন, শ্রোতারা যেহেতু ছোট ছেলেমেয়ে কাজেই তাদের উদ্দেশ করেই কথাবার্তা বলা হলো এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকের একটা কথা আমার কানে মধু ঢেলে দিল! তিনি ছেলেমেয়েদের বলছেন, তারা কুলিয়ারচরের যে ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন স্কুল থেকে এসেছে সেই ২৮টি স্কুলের প্রত্যেকটিতে একটি করে কম্পিউটার ল্যাবরেটরি তৈরি করে দেবেন! গিনেস বুক অব রেকর্ড তৈরি করার জন্য অনেক চুলচেরা নিয়ম মানতে হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের আয়োজন করার সময় প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়েছে সেই নিয়মগুলো মানার। এখন তাদের কাছে আবেদন করা হবে এবং আগামী কয়েক সপ্তাহ পর আমরা জানতে পারব সত্যি সত্যি আমরা বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করতে পেরেছি কিনা। তবে আমার মনে হয় কুলিয়ারচরের ছেলেমেয়েরা বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করার থেকেও বড় একটি রেকর্ড তৈরি করে ফেলেছে! পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণীর ছোট ছোট শিশু সবাই তাদের নিজেদের স্কুলের জন্য একটা করে কম্পিউটার ল্যাবরেটরি উপহার দিয়েছে, পৃথিবীর কতজন শিশু এতবড় একটা অর্জন করতে পারে? সবকিছু দেখে আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়, আহা! বেঁচে থাকাটা কী আনন্দের! ১২-০১-২০১৭
×