ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলাম প্রচারের নিয়মনীতি

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলাম প্রচারের নিয়মনীতি

আল্লাহ জাল্লা শানুহু মানব জাতির জন্য যে দীন অর্থাৎ জীবন ব্যবস্থা দিয়েছেন সেটাই ইসলাম। ইসলাম কোন আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ গতানুগতিক এবং অনর্থক ধর্ম নয়। ইসলাম হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ প্রগতিশীল, সর্বকালীন শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ইন্নাদ দীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম- নিশ্চয়ই আল্লার্হ নিকট একমাত্র দীন হচ্ছে ইসলাম (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৯)। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিজনকে দোজখের আগুন থেকে রক্ষা কর (সূরা তাহরীম : আয়াত ৬)। এই আয়াতে কারিমার ব্যাখ্যা জানবার জন্য হযরত উমর রাদিআল্লাহ তায়ালা আনহু প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন : হে রসূল, নিজেকে দোজখের আগুন থেকে রক্ষা করবার বিষয়টি তো বুঝলাম কিন্তু পরিবার পরিজনকে কিভাবে বাঁচাব? তিনি বললেন : আল্লাহ যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন সেই সব নিষিদ্ধ কাজ করতে তাদের নিষেধ করবে আর যা করতে আদেশ করেছেন তা করতে বলবে। আমরা জানি ৬১০ খ্রিস্টাব্দের রমাদানের শেষ দশকের কোন এক বেজোড় রাতে, অধিকাংশের মতে, ২৭ রমাদান রাতে প্রিয়নবী (সা.) প্রথম ওহী লাভ করেন। সেই রাতেই তিনি গৃহে ফিরে এসে তাঁর সম্মানিতা স্ত্রী হযরত খাদিজা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহার কাছে এ সম্পর্কে বললে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ইমান আনলেন। এইভাবে নিজের গৃহ থেকে ইশাআতে ইসলাম বা ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হলো। তারপর ইমান আনলেন হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু এবং হযরত যায়দ ইবনে হারিছ রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু। এ দু’জনই ছিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের পরিবার পরিজনের অন্তর্ভুক্ত। বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাদি) প্রথম ওহী নাজিলের প্রায় তিন বছর পর থেকে নিয়মিত ওহী নাজিল হতে থাকে বিভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে। ওহী নাজিলের এই পর্যায়ে আল্লাহ জাল্লা শানুহু প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করার নির্দেশ দিলেন। এরশাদ হলো : (হে রসূল), আপনি উঠুন এবং সতর্ক করুন আর আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। (সূরা মুদাস্সির : আয়াত ২-৩), (হে রসূল), আপনার নিকটাত্মীয়গণকে সতর্ক করে দিন। (সূরা সু’আরা : আয়াত ২১৪)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইশাআতে ইসলামের জন্য আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু যেসব নির্দেশনা নাজিল করেছেন সেই মুতাবিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ইশাআতে ইসলাম বা ইসলাম প্রচার করা বলতে প্রধানত ইসলামের বাইরের লোকজনের মধ্যে প্রচার করাকে বোঝায় এবং ইসলামের ভেতরে থেকে যারা ইসলামের বিধিনিষেধ অমান্য করে, গোমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে যারা পথভ্রষ্টতার আবরণে নিজেদের আচ্ছন্ন করে ফেলে তাদের সংশোধন করার মধ্যেও ইশাআতে ইসলামের আবেদন অনুরণিত হয়। এক্ষেত্রে হিদায়াতের আবেদন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর এসব কাজ যারা করবেন তাদের অবশ্যই ইসলাম সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান থাকা এবং সেই অনুযায়ী নিজের আমল-আখলাক গড়ে ওঠা মানুষ হতে হবে। আমরা যদি ইসলামের ইতিহাসের দিকে নজর দেই তাহলে দেখতে পাব, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচারককে বিধর্মীদের ইসলামের দিকে আহ্বান করার জন্য পাঠিয়েছেন, তারা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত সাহাবী। আল্লাহ জাল্লা শানুহু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলিফা প্রতিনিধি করে। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন শুধু তাঁরই ইবাদত করার জন্য, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, এই সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু মানুষকে দান করেছেন হিদায়াত, দান করেছেন সত্য পথে চলার দিশা। হযরত আদম আলায়হিস্্ সালাম থেকে সর্বশেষ নবী সাইয়েদুল ম্রসালীন নূরে মুজাস্্সাম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৃথিবীতে যত নবী রসূল আল্লাহ পাঠিয়েছেন তাঁরা সবাই আল্লাহর দেয়া দীন তথা জীবন ব্যবস্থা ইসলাম প্রচার করেছেন। এই ইসলামের পূর্ণতা লাভ হয় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে। তিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, বিশ্বজগতের জন্য রহমত, তিনি সিরাজাম মুনীরাÑ প্রদীপ্ত চেরাগ। অন্যান্য নবী-রসূলকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু প্রেরণ করেছিলেন নির্দিষ্ট কোন জনপদের পথহারা মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য কিংবা কোন নবীর নিজ কওমকে পথভ্রষ্টতার হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য। আর সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করলেন সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য, সমস্ত মানব জাতির জন্য। তাঁকে আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু নবুওয়ত ও রিসালাত দান করেন মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলায়হিস্্ সালামের সৃষ্টির বহু পূর্বে, কিন্তু এ নবুওয়তের ধারায় তাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয় সবার শেষে, তিনি খাতামুন নাবিয়্যিনÑ নবীগণের সমাপ্তি বা সর্বশেষ নবী। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করতে যে নীতি পদ্ধতি অবলম্বন করেন তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তাঁকে প্রচ- বাধার মোকাবেলা করতে হয়। তাঁর পরিবার পরিজন ও নিজ গোত্রের লোকজনসহ তাঁকে বয়কট পর্যন্ত করা হয়। তাঁকে নানা রকম প্রলোভনও দেখানো হয়। কিন্তু তিনি বলেন, আমার এক হাতে চাঁদ আরেক হাতে সূর্যও যদি এনে দেয়া হয় তবুও আল্লাহ আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালন করা থেকে একটুও পিছপা হব না। তিনি ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য তায়েফ গিয়েছেন। তায়েফের মানুষ তাঁর আহ্বানে সাড়া তো দিলই না বরং পাথর মেরে তাঁর জিস্্ম মুবারক ক্ষতবিক্ষত করে দিল। তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করল। তাঁর জিস্্ম মুবারক থেকে খুন ঝরে তার নাল (জুতা) মুবারক ভরে তাঁর কদম মুবারক তাতে আটকে গেল। সে এক করুণ অবস্থা। তবু তিনি তায়েফবাসীর জন্য দোয়া করলেন এই বলে : আল্লাহ গো! আমার দুর্বলতা, আমার নিরুপায়তা এবং মানব দৃষ্টিতে প্রতীয়মানহেয়তার জন্য আপনার মহান দরবারে এই ফরিয়াদ করছি : হে রহমানুর রহীম, সমস্ত দুর্বলের রব আপনি। আপনিই আমার রব। যদি আমার ওপর ক্রুদ্ধ না হয়ে থাকেন তাহলে আমিও কারও পরোয়া করি না। আপনার শান্তি, আপনার আফিয়াত আমার আশ্রয়। আমি আপনার সেই নূরের কামনা করছি, যে নূর মুবারকে আসমান-জমিন রওশন হয়েছে, যে নূরের ছটায় অন্ধকার বিদূরিত হয় এবং যে নূরের ছটায় দুনিয়া ও আখিরাতের কর্ম সম্পাদন হয়। সেই নূর মুবারকের উসিলায় আপনি আপনার গজব নাজিল করবেন না। একমাত্র আপনার সন্তুষ্টি সাধন করাই আমার কর্তব্য, যতক্ষণ না আপনি সন্তুষ্ট হন। লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইন্না বিকা। সেদিন তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে অত্যাচারে জর্জরিত অবস্থায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ধৈর্য ধারণ করে যারা তাঁকে আঘাত করল তাদের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করে ইসলাম প্রচারের কী নীতিমালা হওয়া উচিত তাঁর অনুপম দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করলেন। তিনি সেদিন ক্ষমার পথ বেছে নিলেন। তিনি তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইলেন। তিনি বললেন : হয়ত আল্লাহ তায়ালা তায়েফবাসীদের কারও বংশে এমন মানুষ পয়দা করবেন যারা আল্লাহর ‘ইবাদত করবে এবং আল্লাহর সঙ্গে কারও শরিক করবে না। ইসলামের দিকে মানুষকে কিভাবে আহ্বান করতে হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : তোমার রবের পথে আহ্বান কর হিকমতের সঙ্গে এবং সুন্দর সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আর ওদের সঙ্গে বাক্যালাপ করবে সদ্ভাবে (সূরা নহল : আয়াত ১২৫)। এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে তিনটি পন্থা অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ জাল্লা শানুহু আর তা হচ্ছে : হিম্মত বা কৌশল সদুপদেশ ও সদ্ভাবে আলোচনা। এখানে উল্লেখ্য, আল্লাহ নিয়ামতপ্রাপ্তদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন আম্বিয়ায়ে কেরাম। তারপর তাদের উম্মতদের মধ্যে যাঁরা সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহ। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : যাঁদের মহান আল্লাহ্ নিয়ামতম-িত করেছেন তাঁরা হচ্ছেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালেহগণ (সূরা নিসা : আয়াত ৬৯)। এই সালিহীন বা সালেহদের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন সাহাবায়ে কেরাম, আওয়ালিয়ায়ে কেরাম ও মুত্তাকী-দীনদারগণ। ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম প্রচার করে আসছেন ইসলাম বিশেষজ্ঞগণ। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমাদের মধ্যে এমন এক গোষ্ঠী হোক যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে। এরাই সফলকাম (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১০৪)। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদিত হলে একটি স্বস্তির হাওয়া প্রবাহিত হয় আরব ভূখ-ে। বহু লোক এসে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকেন। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দল আসতে থাকে মদিনা মনোয়ারায়। প্রিয়নবী (সা) বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাদের কাছে পত্র পাঠান। ইসলাম প্রচারের সাড়া দিকে দিকে পড়ে যায়। আরব ভূখ- ছেড়ে অনেক উচ্চশিক্ষিত ও প্রিয়নবী (সা)-এর নিকট থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাহাবী সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ওপারের দেশগুলোতে যান। চীন-সুমাত্রাগামী বাণিজ্য নৌবহরে করে যাবার পথে কোন কোন সাহাবী বাংলাদেশে বন্দরে সাময়িক সফর বিরতি দিয়ে এখানে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। তাঁদের বেশ কয়েকজনের মাজার শরীফ চীনের ক্যান্টনের ম্যাসেঞ্জার মসজিদ আঙ্গিনায় আজও রয়েছে। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। এখানে ইসলাম প্রচারে ব্যাপক অবদান রাখেন পীর-আউলিয়াগণ, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন হযরত বায়েযীদ বোস্তামী, হযরত শাহ্ সুলতান রুমী, হযরত শাহ্ সুলতান বল্খী; হযরত শাহ মখদুম রুপোশ, হযরত শাহ দৌলা, হযরত বাবা আদম শহীদ, হযরত বাবা ফরীদ, হযরত আবুতাওয়াশা, হযরত শাহ্জালাল ও তাঁর ৩৬০ খলিফা, শাহ আলী বাগদাদী, শাহ আলাওয়াল, নূর কুদবুল আলম, আখি সিরাজ, মনসুর বাগদাদী, মুস্তফা মাদানী, মুজাদ্দিদে যামান আবু বকর সিদ্দীকী, আবদুল হামিদ বাঙালী, শাহ্ নেছারুদ্দীন আহ্মদ, মাওলানা শাহ্ আবদুল করিম, শাহ মোঃ আবু নঈম, শাহ্ মোঃ আবুল খায়ের, মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী, মাওলানা শাহ সুফী তোয়াজউদ্দীন আহমদ, মাওলানা রুহুল আমীন, মাওলানা আহমদ আলী এনায়েতপুরী (যশোর) প্রমুখ। ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারে তাঁদেরই অবদান স্বীকৃত হয়েছে যার ধারাবাহিকতা আজও রয়েছে। ইসলাম সংসার ছেড়ে বিবাগীর মতো ঘুরে বেড়াতে বলে না। যাঁরা ইসলাম প্রচারের জন্য যোগ্য তাঁরাই ইসলাম প্রচার করবেন এই নিয়ম চলে আসছে প্রাথমিক কাল থেকেই। পীর-আউলিয়াদের পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×