ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

গল্পই স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রাণ

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১২ জানুয়ারি ২০১৭

গল্পই স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রাণ

একটি চলচ্চিত্র একটা সমাজের দর্পণ। কোন একটা দেশকে জানার সহজ উপায় হলো সেই দেশের চলচ্চিত্র। কারণ একটা চলচ্চিত্রের মাঝেই দেখা যায় সেই দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, জীবনধারা। চলচ্চিত্রের দায়িত্ব কি দর্শককে শুধুই বিনোদন যোগানো? কাহিনীতে বিনোদনের প্রাধান্য না থাকলে কি চলচ্চিত্রের বক্তব্যের প্রতি দর্শকের কোন আগ্রহ তৈরি হবে না? প্রশ্ন দুটির উত্তর সচেতন মানুষের অজানা নয়। বিশ্বচলচ্চিত্রের ইতিহাসে যে পরিচালকরা খ্যাতিমান তাঁরা চলচ্চিত্রকে মুনাফা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে চটক আর চাকচিক্য-সর্বস্ব বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি। বরং তারা এমন ছবির গতানুগতিক ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের ছবিতে প্রকাশ করেছেন সমাজসচেতন বক্তব্য এবং তাদের ছবির নির্মাণশৈলী হয়ে উঠেছে প্রথাবিরোধী, নান্দনিকভাবে আকর্ষণীয়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ভারতীয় চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের কথা। ভারতে জনপ্রিয় বিনোদনধর্মী ছবি তৈরি হচ্ছে নিয়মিতভাবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলচ্চিত্রবোদ্ধা এবং সচেতন দর্শকদের কাছে ভারতের চলচ্চিত্র সুপরিচিত এবং তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছিল সত্যজিৎ রায়ের ছবির মাধ্যমে যিনি কখনও আর্থিক মুনাফা অর্জনের জন্য নিজের ছবিতে বিনোদনধর্মী উপাদান ব্যবহার করেননি। একজন লেখক ও চলচ্চিত্রকারের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। একজন কলম দিয়ে গল্প তৈরি করেন এবং অন্য জন্য ক্যামেরা দিয়ে গল্প তৈরি করেন। দু’জনের কাজ একই- গল্প তৈরি করা। সুতরাং ভাল গল্পকার না হলে ভাল চলচ্চিত্রকার হওয়া সম্ভব না। পৃথিবীর সব ভাল ভাল সিনেমা কোন না কোন ভাল উপন্যাস বা গল্প থেকে নির্মিত। সত্যজিৎ রায়, জহির রায়হান ও হুমায়ুন আহমেদ- একই সঙ্গে ভাল গল্পকার ও ভাল চলচ্চিত্রকার ছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছে তারা ভাল গল্পকার ছিলেন বলেই। তারা গল্প বলার গ্রান্ড মাস্টার ছিলেন বলেই ভাল শিল্পগুণসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। উদ্দেশ্যের দিক থেকে একজন গল্পকার ও চলচ্চিত্রকার একই কাজে জড়িত- গল্প বলা। তারা দু’জনই গল্প বলেন। কেবল তাদের মাধ্যমটা ভিন্ন। সুতরাং মানসিক গঠনের দিক দিয়ে একজন গল্পকার ও চিত্র পরিচালকের একই জায়গায় থাকাটা জরুরী। চিত্র পরিচালক যদি গল্পকারের মতো একই রকম গুণসম্পন্ন না হন তাহলে তিনি কিভাবে বুঝবেন ভাল গল্প কোনটা? সুতরাং তাকে প্রথমে গল্প লেখার কৌশল জানতে হবে, গল্প বলার নানা ধরন সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। আধুনিক গল্প বলার নতুন নতুন টেকনিক নিয়ে ভাবতে হবে। এই একই কাজ গল্পকারও করেন এবং চিত্র পরিচালককেও করতে হবে। গল্পকারের মতো গল্প বলার গুণ অর্জন না করলে ভাল চিত্র পরিচালক হওয়া সম্ভব না। শুধু তা-ই নয়, এক চলচ্চিত্র পরিচালক অন্যের লেখা গল্প নিয়েও চলচ্চিত্র নির্মাণ করে থাকেন। তিনি যদি ভাল গল্প না বোঝেন, তাহলে কিভাবে ভাল গল্প নির্বাচন করবেন? এ জন্যও তাকে গল্প সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট যদি আমরা বাংলাদেশের সত্তর কিংবা আশির দশকের দিকের সিনেমার দিকে তাকাই তাহলে কিন্তু আমরা বাংলাদেশকে দেখতে পাব, দেখতে পাব বাংলাদেশের সময়সাময়িক বিষয়কে। কিন্তু নব্বই দশক থেকে বাংলা সিনেমায় ছন্দপতন ঘটেছে। তখন বাংলাদেশের পরিচালকরা কপি সিনেমায় আগ্রহী বেশি হল আর আমরা হারাতে লাগলাম আমাদের বাংলাদেশকে। বর্তমানের প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে আমরা দেখি যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ সিনেমা হয়তো তামিল, তেলেগু, হলিউড কিংবা কোরিয়ান সিনেমার কপি। মৌলিক গল্পের ছবি নেই বললেই চললে। আবার কিছু কিছু মৌলিক গল্পের সিনেমায় থিম কপি কিংবা চিত্রনাট্যে বেশকিছু বিদেশী ছবির ছাপ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে কেন মৌলিক গল্পের সিনেমা হচ্ছে না? ঝুঁকিমুক্ত থাকা বর্তমানে আমাদের দেশীয় প্রযোজকরা ঝুঁকি মুক্ত থাকতে চান। তাই তারা একটা হিট তামিল কিংবা তেলেগু সিনেমা দেখে নকল করে একটা সিনেমা বানান যাতে ব্যবসায়িক সফলতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু সমস্যা হলো এই ছবিগুলো বস্তাপচা তামিল, তেলেগু থেকে কপি করা হয়। তবে এর ব্যতিক্রম ও আছে আগুনের পরশ মনি, গহীনের শব্দ, খেলাঘর, নন্দিত নরকে, অন্তর্যাত্রা, সীমানা পেরিয়ে, মেঘের অনেক রঙ, জয়যাত্রা, দিপু নাম্বার টু এরকম অনেক নাম। বর্তমানে আয়না বাজি মুক্তি পাবার পর দর্শকরা আবার হলমুখী হতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু আয়নাবাজি কাহিনী আমাদের চেনা জগতে অচেনা কিছু কথা নিয়ে। সাধারণ চোখে তা কমই ধরা পড়ে। আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অভিনেতা! একদম জ্যান্ত অভিনয়। আয়নার ভাষায়- প্রতিটি রাজনৈতিক নেতাই এক একজন অভিনেতা। সেখানে হাজার হাজার মানুষ হচ্ছেন দর্শক, আর নেতারা অভিনেতা। অভিনেতারা সবসময় মিথ্যা কথা বলেন। আমাদের যাপিত জীবনে এইরকম অভিনেতার সংখ্যা কী কম? নিজেকে প্রশ্ন করে দেখতে পারেন। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আইনের/নীতি নৈতিকতার ফাঁক দিয়ে দুর্নীতি নামক ক্যান্সার কিংবা অনৈতিক চরিত্র ধারণ করে আমরা ধ্বংসের অতলে ক্রমাগত নিয়ে যাচ্ছি সেটা সুনিপূণভাবে তুলে ধরেছেন নির্মাতা! স্বার্থের জন্য কিংবা ভালবাসার জন্য মানুষের বিবেক/আবেগের প্রভাব কোথায় নিয়ে যেতে পারে আমাদের? বঞ্চিত মানুষদের জীবন নিয়েও চমকপ্রদ উপস্থাপন আছে এই চলচ্চিত্রে!!
×