ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টেলিভিশন জাদুঘর

সোনালি দিনের স্মৃতি, সম্প্রচারের অতীত ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১২ জানুয়ারি ২০১৭

সোনালি দিনের স্মৃতি, সম্প্রচারের অতীত ইতিহাস

মোরসালিন মিজান ॥ টেলিভিশন এত যে, গুনে শেষ করা যায় না। তবে এটি আজকের কথা। কিছুকাল আগেও গল্পটা অন্য রকম ছিল। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিটিভি ছাড়া আর কোন টেলিভিশন তখন ছিল না। সীমিত সাধ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই টেলিভিশন নতুন যুগের সূচনা করে। আজ বিটিভি কেবল টেলিভিশন নয়, সম্প্রচার ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি। বহুকাল পর সেইসব স্মৃতি কুড়িয়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি জাদুঘর। বিটিভির উদ্যোগ। ‘টেলিভিশন জাদুঘর’ নামে গত বছরের ডিসেম্বরে উদ্বোধন করা হয়। পরিসর খুব বড় নয়। তবু চমৎকার পরিভ্রমণ সুযোগ। কত শত স্মৃতি সামনে এসে দাঁড়ায়! নিজের অজান্তেই আবেগাক্রান্ত হয়ে ওঠে দর্শক হৃদয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশে টেলিভিশন সম্প্রচারের ইতিহাসটি কেমন ছিল, জানা হয়ে যায়। পরিবর্তনের ধারায় বদলেছে রামপুরা টেলিভিশন ভবনের চেহারাও। এখন পুরনো বিল্ডিংয়ের পাশে নতুন ১২ তলা ভবন। ভবনের নিচতলায় গড়ে তোলা হয়েছে জাদুঘরটি। দুটি কক্ষ। প্রথমটি বেশ বড়। পুরোটা সাজানো হয়েছে দুর্লভ নিদর্শন দিয়ে। কিছু স্মারক রাখা হয়েছে ছোট কক্ষটিতে। জাদুঘরে প্রদর্শিত নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সময় ব্যবহৃত ক্যামেরা, টেপ, ক্যাসেট, স্টুডিও যন্ত্রপাতি, সম্পাদনা প্যানেল, কন্ট্রোলরুমের যন্ত্রপাতি, সম্প্রচার যন্ত্রপাতি, পা-ুলিপি ও স্থিরচিত্র। বুধবার জাদুঘরে প্রবেশ করতেই বিশেষ একটা অনুভূতি হয়। যা দেখা যায় সবই প্রায় লোহা লক্কর। বাক্স পেটরা। পুরনো। জীর্ণ। রং নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও চোখ কেমন আটকে যায়। সামনে এসে দঁাঁড়ায় অবাক করা অতীত। দুটি পেটমোটা টেলিভশন পাশাপাশি সাজানো। কাঠের বিরাট বাক্সের ভেতর থেকে ভুঁরির মতো উঁকি দিচ্ছে স্ক্রীন। ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের ২৪ ইঞ্চি টেলিভিশনের নিচের অংশে লেখা রয়েছে ‘এসি/ডিসি।’ অর্থাৎ বিদ্যুতে চলবে। ব্যাটারিতেও। সাদা কালো টেলিভিশনটি সত্তর দশকের সংগ্রহ। অন্যটি জার্মানির তৈরি ২৪ ইঞ্চি ‘রঙিন’ টিভি। আশির দশকের সংগ্রহ। দুটোই বৃদ্ধের ঘোলা চোখ হয়ে আছে আজ। জাদুঘরে রয়েছে টেলিভিশন ক্যামেরার বড় সংগ্রহ। আকারে প্রকা- হওয়ায় স্টুডিও ক্যামেরাগুলো সহজেই চোখে পরে। বিটিভিসহ বাংলাদেশে ব্যবহৃত প্রথম স্টুডিও ক্যামেরাটি এখানে রাখা হয়েছে। কেসিকে-৫০ মডেলের ক্যামেরাটি জার্মানির তৈরি। আশির দশকের সংগ্রহ। একই সময়ে সংগ্রহ করা সিটিসিএস-২০ মডেলের ক্যামেরাটি জাপানের তৈরি। এটি ‘সাদা কালো’ যুগের স্মৃতিকে তুলে ধরছে। আছে ছোট আকারের সহজে বহনযোগ্য কয়েকটি ফিল্ম ক্যামেরা। সত্তরের দশকে ব্যবহার করা এসব ক্যামেরা পুরনো আলোকচিত্রে কখনও সখনও দেখা যায়। ১৬ এমএম ফিল্ম ক্যামেরা, সিনেমা প্রোডাক্টস সাউন্ড ক্যামেরা ইত্যাদি নামে ক্যামেরাগুলোকে আলাদা করা হয়েছে। কোনটি কোন কাজে ব্যবহার করা হতো নাম দেখে সে সম্পর্কে একটি ধারণা নেয়া যায়। আছে পুরনো স্টিল ক্যামেরাও। জাদুঘর ভর্তি যন্ত্রপাতি। অধিকাংশই আকারে বিশাল। ভিএইচএফ টিভি ট্রান্সমিটারটি সংগ্রহ করা হয় ১৯৭৮ সালে। এটি অন্যতম পুরনো স্মারক। এএম সাইডব্যান্ড এনালাইজার, অসিলোস্কোপও সত্তরের দশকের স্মারক। আছে আশির দশকে সংগ্রহ করা শব্দ ধারণযন্ত্র, অডিও ডিস্ক প্লেয়ার, ভিডিও টেপ রেকর্ডার। সবই শক্ত ধাতু দিয়ে তৈরি। একটি অডিও স্পীকার দেখে তো মনে হয় লোহার বাক্স! টেলিসিন মেশিন, বহনযোগ্য ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার, ১৬ এমএম প্রোজেক্টর, ওয়েভ ফর্ম মনিটর, সিনক্রোনোস্কোপ ইত্যাদি যন্ত্রের শক্ত কাঠামো ফেলে আসা সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে। বর্তমানে টেলিভিশন সম্প্রচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এসব যন্ত্র দেখে অতীতটা জানতে পারবেন। এসবের বাইরে জাদুঘরের বিভিন্ন দেয়ালে আছে দুর্লভ আলোকচিত্র। সাদা কালো ছবিতে কত ইতিহাস যে হাসছে খেলছে! রঙিন ছবিতেও ইতিহাস। বাংলাদেশ টেলিভিশনের কালজয়ী নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, সঙ্গীতায়োজনÑ সবই মনে পরে যায় ছবির দিকে তাকিয়ে। একসময় টেলিভিশন মাতিয়েছেন, দর্শকের মুখে মুখে ছিল নাম, তারা নেই আর। ছবিতে সেইসব কীর্তিমানদের খুঁজে পাওয়া যায়। একটি গ্লাস শোকেসে দেখা গেল, বিটিভির বিপুল জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘বহুব্রিহী’র প্রথম পর্বের স্ক্রিপ্টের অনুলিপি। কিছু সংবাদের স্ক্রিপ্টও রাখা আছে। এভাবে বিটিভি যুগ ও টেলিভিশন সম্প্রচারের অতীত ইতিহাস অনেকখানি ফুটে উঠেছে জাদুঘরে। অবশ্য জাদুঘরটি নিয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে। সেটি সম্ভব হলে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশে টেলিভিশনের ইতিহাস আরও ভালবাবে জানা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিভির মহাপরিচালক হারুন-অর-রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, জাদুঘরটি আমাদের সচেতন প্রয়াস। এর আরও উন্নয়ন করা হবে। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। সবাইকে জাদুঘরটি পরিদর্শনের আহ্বান জনান তিনি। টেলিভিশন জাদুঘর শুক্র ও শনিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এবং দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত।
×