ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ওবামা কতটা সফল কতটা ব্যর্থ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

ওবামা কতটা সফল কতটা ব্যর্থ

আগামী ২০ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কার্যকাল। টানা আট বছর বিশ্বের এক নম্বর শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন শেষে হোয়অইট হাউস থেকে বিদায় নেবেন আমেরিকার প্রথম এই কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। রেখে যাবেন তার সমৃদ্ধ ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ কার্যকালের রেকর্ড। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ওবামা ছিলেন একমাত্র আফ্রিকান আমেরিকান সিনেটর। তথাপি তিনি সর্বদা বলতেন ‘আর্থার সর্বপ্রথম পরিচয় আমি একজন আমেরিকান।’ তার কার্যকাল যে সর্বদা সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত ছিল তা নয়। তথাপি তার কিছু কিছু অর্জন দীর্ঘদিন টিকে থাকবে। তিনি বেশকিছু সাহসী সংস্কারের প্রস্তাব করেছিলেন সেগুলোর কিছু কখনই আইনের রূপ লাভ করেনি। আবার অন্যগুলোকে আইনের রূপ নিতে দেয়া হয়নি। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা কিছু কিছু ভীরু পদক্ষেপের কারণে ম্লান হয়ে গেছে। তিনি বর্ণগত সংহতির প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। অথচ তার কার্যকালের শেষ দিকে কিছু কিছু আফ্রিকান-আমেরিকানের মনে হয়েছে যে নাগরিক অধিকারের বিজয় যেন সুদূর পরাহত। ওবামা কিছু কিছু কাজের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যেমন তিনি ইরাক হামলার বিরোধিতা করেছিলেন এবং নিজের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি ২০১১ সালে মার্কিন সৈন্যদের ইরাক থেকে স্বদেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন। লোকে ওবামাকে মনে রাখবে সেই সব যুদ্ধের জন্য সেগুলো তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও লড়েছিলেন এবং যেগুলো তিনি লড়তে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। লোকে ওবামাকে মনে রাখবে বিধ্বংসী ড্রোন অস্ত্র ব্যবহারে বিশেষ দুর্বলতার জন্য। ২০১৬ সালে তার আমেরিকা ৭টি দেশে বোমাবর্ষণ করেছিল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানবহীন ড্রোনের সাহায্যে। এই মানুষটিই লাদেনকে হত্যার জন্য এবোটাবাদ হামলার অনুমোদন করেছিলেন। ওটা ছিল তার কাছে এক বিশাল জুয়া খেলার ব্যাপার। পরিকল্পনাটি ভেস্তে গেলে তাকে প্রেসিডেন্ট পদটি হারাতে হতো। বিশ্বব্যাপী প্রেসিডেন্ট ওবামার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছাড়া অনেক দেশেই অর্ধেক কি তারও বেশি লোক ওবামার প্রতি সমর্থন পোষণ করে থাকে। বুশের আমলে বহির্বিশ্বে আমেরিকার ভাবমূর্তি যথেষ্ট বিনষ্ট হয়েছিল। ওবামা ক্ষমতায় এসে সেই ভাবমূর্তি অনেকটাই পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। তার প্রথম দফা কার্যকালে ওবামা বেশকিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন যার মধ্যে প্রধান ছিল মন্দাকবলিত অর্থনীতি, বিদেশে সামরিক দিক দিয়ে আমেরিকার জড়িত থাকা এবং দেশের ভবিষ্যত নিয়ে আমেরিকানদের নিজেদের মধ্যে প্রবল অবিশ্বাস। একজন বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে নেমে ওবামা অনেক কিছুই অর্জন করতে পেরেছিলেন যা আর কেউ পারতেন কিনা সন্দেহ। আয়ত্তযোগ্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা আইন বা ওবামা কেয়ার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় অর্জন বলে বিবেচিত। বীমার ছত্রছায়া না থাকা কোটি কোটি আমেরিকানকে আয়ত্তযোগ্য স্বাস্থ্য বীমা প্রমাণ করাই ছিল এর লক্ষ্য। বৈদেশিক ক্ষেত্রে অর্জনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কিউবার সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের অবসান ঘটানো। ওবামা মার্কিন অহংবোধ ভেঙ্গে চুরমার করে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কিউবা সফরে যান এবং হাভানা ওয়াশিংটন কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান ৬০ বছরের উত্তেজনার সমাপ্তি টানেন। ওবামা নাজুক অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চারে আপ্রাণ প্রয়াস পেয়েছিলেন। তার একটা টার্গেট ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তিনি মোটরগাড়ি শিল্পে উদ্দীপনা যুগিয়ে বাড়তি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। ক্রিসলার ও জিএম মোটরস এরপর থেকে আড়াই লাখ চাকরির সৃষ্টি করে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় প্যারিস চুক্তি সম্পাদনে যে ক’জন বিশ্ব নেতা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ওবামা তাদের একজন। বলতে গেলে তিনিই ছিলেন এই চুক্তির মূল হোতা। ইরান পরমাণু চুক্তিও ওবামার অন্যতম অর্জন। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬ বিশ্ব শক্তি ইরানের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর মাধ্যমে পরমাণু অস্ত্র করায়ত্ত করা থেকে ইরানকে নিবৃত্ত রাখা হয়। চুক্তির অধীনে ইরানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কয়েক হাজার সেন্ট্রিফিউজ সরিয়ে ফেলে। ২০০৮ সালে মার্কিন অর্থনীতিতে যে ব্যাপক মন্দা শুরু হয়েছিল তা থেকে দেশকে উদ্ধার করা ওবামার এক বিরাট সফলতা। এর জন্য তিনি কর হ্রাস করেন, বেকার সুবিধা বাড়ান, গণপূর্ত প্রকল্পে অর্থায়ন করেন ও অন্যান্য ব্যবস্থা নেন। এর ফলে জিডিপি ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও সহযোগিতা জোরদার করে তুলতে নিজের অসাধারণ ভূমিকার জন্য ওবামা ২০১০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। এতসব অর্জনও শেষ পর্যন্ত ম্লান হয়ে যায় তার কিছু ব্যর্থতায়। ২০১৩ সালের এক জরিপে দেখা যায় যে আয়ত্তসাধ্য স্বাস্থ্যসেবা আইন তথা ওবামা কেয়ারই একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওবামার সবচেয়ে বড় সাফল্য ও সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবেলায় ওবামার অনেক অবদান সত্ত্বেও মার্কিনীরা মনে করে যে তার প্রশাসনের প্রস্তাবগুলো যথেষ্ট ব্যয়বহুল। তাছাড়া ওবামার এ ব্যাপারে আরও অনেক কিছু করা উচিত ছিল যা তিনি করেননি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কার্যসম্পাদন অর্ধেকেরও বেশি আমেরিকান সমর্থন করে না। এ ব্যাপারে তার অবস্থান জর্জ ডব্লিউ বুশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ক্লিনটন ও রিগ্যানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামার অনুসৃত নীতিগুলো দেশকে সঠিক পথে নেয়া তো দূরের কথা বরং ভ্রান্ত দিকে নিয়ে গেছে বলে বেশিরভাগ আমেরিকানের ধারণা। তার অর্থনীতি পরিচালনাকেও অধিকাংশ আমেরিকান সমর্থন করেনি। ইরান-মার্কিন সম্পর্ক তিনি যেভাবে পরিচালনা করেছেন সে ব্যাপারেও ৫৫ শতাংশ আমেরিকানের ঘোর আপত্তি। কারণ ইরান যে শেষ পর্যন্ত এই চুক্তি মেনে চলবে সে ব্যাপারে অনেক আমেরিকান দারুণ অবিশ্বাস পোষণ করে। বেশিরভাগ আমেরিকান চেয়েছে যে চুক্তিটা মার্কিন কংগ্রেসে প্রত্যাখ্যাত হোক। পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা নিয়ে ওবামার ওপর বিরক্ত সিংহভাগ আমেরিকান। তারা ইরাকে চলমান যুদ্ধ, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং আইসিসের উত্থান ও প্রসার নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওপর দারুণ অসন্তুষ্ট। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×