ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

পুরুষদের পেছনে ফেলে অনন্য উচ্চতায় দেশের নারী ফুটবলাররা

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

পুরুষদের পেছনে ফেলে অনন্য উচ্চতায় দেশের নারী ফুটবলাররা

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। একসময় বাংলাদেশের এক নম্বর খেলাও ছিল এ খেলাটি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। কাজী মো. সালাউদ্দিন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হবার পর এ ক্রীড়াটি বলতে গেলে রসাতলেই চলে গেছে। ছেলেদের ফুটবল রসাতলে গেলেও মহিলা ফুটবল ঠিকই সাফল্যের হাসি হেসেছে। দেশে হওয়া এএফসি অনুর্ধ-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে অপরাজিত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশের কিশোরীরা। এর আগে নেপালে ও তাজিকিস্তানে গিয়ে তারা জেতে এএফসি অ-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপেরও অপরাজিত শিরোপা। ২৯ ডিসেম্বর। ভারতের শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে গ্রুপ পর্বে আফগানিস্তানকে ৬-০ গোলে বিধ্বস্ত করে সেমিতে নাম লেখায় বাংলাদেশ। জয়ী দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন একাই করেন ৫ গোল। এরপর বছরের শেষদিন ৩১ ডিসেম্বর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে শক্তিশালী ও স্বাগতিক ভারতের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে গ্রুপসেরা হয়ে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ দল। কেননা ভারতের সঙ্গে আগের পাঁচ মোকাবেলায় প্রতিটিতেই বড় ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ। এরপর নতুন বছরের ২ জানুয়ারি সেমিতে মালদ্বীপকে ৬-০ গোলে প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠে আরেকটি ইতিহাস গড়ে সাবিনারা। ৪ জানুয়ারি অবশ্য ফাইনালে ভারতের কাছে ৩-১ গোলে হেরে রানার্সআপ হয় বাংলার বাঘিনীরা। আসলে হারানোর কিছুই ছিল না বাংলাদেশের। এই হারে লজ্জা বা অগৌরবের কিছু নেই, বরং আছে মাথা উঁচু করা সম্মান। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশিই পায় ছোটনের শিষ্যারা। যদিও ভারতের জয়ে অবদান ছিল রেফারির। তার দেয়া একটি ‘অন্যায়’ পেনাল্টির সিদ্ধান্ত যায় ভারতের পক্ষে। যাহোক, যাদের প্রাথমিক লক্ষ্যই ছিল সেমিফাইনাল খেলা, সেখানে রার্নাসআপ হতে পারাটা ছিল নিঃসন্দেহে বাড়তি অর্জন। বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর তারিখটি চরম লজ্জার। ভুটানের কাছে হেরে ওইদিন শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের ‘এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে’ ওঠার আশা। যে কারণে আগামী তিন বছর বাংলাদেশ ফিফা ও এএফসি স্বীকৃত কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ বা টুর্নামেন্ট খেলতে পারবে না। এই হারে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেন দেশের ফুটবলপ্রেমীরা। ক্ষমাহীন ব্যর্থতার জন্য বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিনসহ কমিটির সবাইকে পদত্যাগের আহ্বান জানান সবশ্রেণীর ফুটবলপ্রেমীরা। সেই সঙ্গে সালাউদ্দিন ও বাফুফের সমালোচনা মুখর হন সাবেক জাতীয় ফুটবলাররা। তবে এসব কোন কিছুকেই পাত্তা দেননি বাফুফে বস। বরং তিনি আরেকবার দেশের ফুটবলকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়ার সাফাই গান! এর আগে এপ্রিলে বাফুফে সভাপতি হিসেবে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন সালাউদ্দিন। ব্যক্তিগত অর্জনে নিজেকে ভাস্বর করলেও দেশের ফুটবলের অধঃপতন ঠেকাতে পারেননি তিনি। এসবেরই প্রভাব পড়ে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে। টানা ব্যর্থতায় রেকর্ড অবনমন হয় লাল-সবুজ জার্সিধারীদের। অক্টোবর মাসে প্রকাশিত ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১৮৫তম। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এটাই সর্বনিম্ন র‌্যাঙ্কিং। ১৮ জানুয়ারি উইঙ্গার জাহিদ হোসেন নৈতিক স্খলন ও গুরুতর শৃংখলাভঙ্গের দায়ে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের প্রথম সেমিফাইনাল ম্যাচে (বাহরাইনের বিপক্ষে) দল থেকে বাদ পড়েন। জাতীয় দলের ক্যাম্প থেকে বহিস্কার করা হয় তাকে। ওইদিনই সেমিফাইনালেই থমকে যায় বাংলাদেশ ফুটবল দলের পথচলা। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম সেমির ম্যাচে বাহরাইন অনুর্ধ-২৩ ফুটবল দলের কাছে ১-০ গোলে হারে বাংলাদেশ। হারের দায়ভার নিয়ে কোচ মারুফুল হক দল থেকে দ্বিতীয়বার পদত্যাগ করেন। ফাইনালে বাহরাইন অলিম্পিক টিমকে ৩-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় নেপাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চ্যাম্পিয়ন দলকে ৫০ হাজার ইউএস ডলারের প্রাইজমানি দেবার ঘোষণা দিলেও সেই অর্থ আজও নেপালকে বুঝিয়ে দেয়নি বাফুফে, এমনটাই দাবী করে অল-নেপাল ফুটবল ফেডারেশন। ১৯ জানুয়ারি দলবদল ও খেলোয়াড় ফেরত দেয়া নিয়ে শেখ জামালে ধানম-ির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র রচিত হয়। বাফুফের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে অন্য তিন ক্লাব শেখ জামালের ১১ ফুটবলারকে তুলে নিয়ে তাদের চুক্তিবদ্ধ করে। ৩০ জানুয়ারি শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাবের সভাপতি মনজুর কাদের। পদত্যাগপত্রে পদত্যাগের কারণ তিনি স্বাস্থ্যগত হিসেবে উল্লেখ করেন। পরে শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা মনজুর কাদেরের পদত্যাগের খবরটি শুনে লন্ডন থেকে তাঁকে ফোন করে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করলে তা মেনে নেন কাদের। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভারতে অনুষ্ঠেয় এসএ গেমসে গৌহাটিতে বাংলাদেশ মালদ্বীপকে টাইব্রেকারে হারিয়ে জেতে তাম্রপদক। একই আসরে মহিলা দলও তা¤্রপদক জেতে। বাংলাদেশ সুপার লীগের লোগো উন্মোচনের ঘোষণার মাধ্যমে ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন দিগন্তের সূচনা হয় বলে ঘোষণা দেয় বাফুফে। ৩ মার্চ ন্যাশনাল টিমস্ কমিটির রায়ে জাতীয় দল থেকে মামুনুল ও জাহিদ এক বছর, ইয়াসিন-সোহেল রানাকে নিষিদ্ধ করা হয় ছয় মাসের জন্য। গোলরক্ষক সোহেল, ইয়ামিন ও মিশুকে সতর্ক করা হয়। অভিযুক্তদের কোন অর্থদ- না দেয়াতে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল এই রায়। ৭ মে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট’-এর ফাইনালে চট্টগ্রাম আবাহনী ২-০ গোলে ঢাকা আবাহনীকে হারিয়ে শিরোপা জেতে। ১৮ মে। শর্তস্বাপেক্ষে বাফুফেকে দেয়া ফিফার অনুদান বাড়ে। আড়াই লাখ থেকে বেড়ে সাড়ে ১২ লাখ ডলার করার ঘোষণা দেয় বাফুফে। ২৭ জুন। ফেডারেশন কাপের ফাইনালে আরামবাগকে ১-০ গোলে হারিয়ে ফেডারেশন কাপের নবম শিরোপা ঘরে তোলে ঢাকা আবাহনী। ১২ জুন। চুক্তি ছাড়াই জাতীয় দলের কোচ হন বেলজিয়ামের টম সেইন্টফিট। ৫ সেপ্টেম্বর। ভুটানের বিপক্ষে এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে ওঠার প্লে-অফের প্রথম লেগের ম্যাচকে সামনে রেখে দল ঘোষণা করে বাফুফে। কিন্তু সেখানে জায়গা না পাওয়ায় অপমানিত বোধ করে মামুনুল ইসলাম অবসরের সিদ্ধান্ত নেন। ৭ সেপ্টেম্বর। এএফসি অ-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় স্বাগতিক বাংলাদেশ দল। খেলা শেষে ঈদের ছুটিতে দলের ৯ ময়মনসিংহের কলসিন্দুর স্কুলের শিক্ষার্র্থী-ফুটবলার নিজেদের গ্রামের বাড়িতে যাবার পথে বাসে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। তাদের একা বাড়ি পাঠানোর জন্য দারুণভাবে সমালোচিত হয় বাফুফে। ৮ সেপ্টেম্বর। জাতীয় দলে ডাক না পাওয়ায় মামুনুলের মতো অভিমানে আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানান লেফট ব্যাক ওয়ালী ফয়সালও। ১৬ সেপ্টেম্বর। অ-১৬ মহিলা দলের জন্য এক বছরের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাফুফে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দলে ফিজিক্যাল ট্রেনার, ফিজিওথেরাপিস্ট ও গোলরক্ষক কোচ, মেয়েদের পড়ালেখার জন্য বাফুফে ক্যাম্পে রাখা এবং মাসিক ভাতা চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর। অ-১৬ মহিলা দলকে দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ক্রীড়া উপমন্ত্রীর কেবলমাত্র ফুলের তোড়া দেয়াতে বিষয়টি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর। ভারতের দিল্লীতে সুব্রতকাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বিকেএসপি টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে ভারতের চন্ডিগড় সরকারী মডেল স্কুলকে হারিয়ে অপরাজিত শিরোপা জেতে। ৩ নবেম্বর। সাবেক ফিফা রেফারি মনিরুল ইসলাম ৫৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ৮ ডিসেম্বর। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সাবেক ফুটবলার, বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের গোলরক্ষক মেজর জেনারেল খোন্দকার নূরুন্নবী চৌধুরী (অব) ৭১ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। ১৪ ডিসেম্বর। ‘জেএফএ অনুর্ধ-১৪ জাতীয় মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ’-এর অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় ময়মনসিংহ জেলা। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে রংপুর জেলা দলকে ৬-০ গোলে হারিয়ে এই আসরে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জেতে তারা। ১৮ ডিসেম্বর। কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত সুপার মক কাপের প্লেট পর্বের ফাইনালে বাংলাদেশ অ-১৪ বালক দল ১-০ গোলে জাপানের শোনান বেলমারেকে হারিয়ে শিরোপা জেতে। ২৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত ফিফা র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দলের উন্নতি হয় সাত ধাপ (১২১ থেকে ১১৪ নম্বরে)। ২৬ ডিসেম্বর। বারিধারাকে ৪-০ গোলে হারিয়ে তিন মৌসুম পর এক ম্যাচ হাতে রেখেই লীগ শিরোপা জেতে ঢাকা আবাহনী। এটা তাদের চলতি মৌসুমের দ্বিতীয়, নবম পেশাদার লীগের পঞ্চম এবং সার্বিকভাবে দ্বাদশ লীগ শিরোপা। দ্বাদশবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা স্পর্শ করে মোহামেডানকে। এই লীগে মোহামেডান তাদের সর্বকালের বাজে লীগ নৈপুণ্য দেখায় ১২ দলের মধ্যে দশম হয়ে।
×