ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিউটি পারভীন

রঙ্গিন পোশাকের লজ্জায় দায়ী কি কেবল কন্ডিশন?

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

রঙ্গিন পোশাকের লজ্জায় দায়ী কি কেবল কন্ডিশন?

ম্যাচশেষে হিসাবটা হয় জয়-পরাজয়ের। প্রস্তুতি ম্যাচটাকে হিসেবে আনলে এবার নিউজিল্যান্ড সফরে টানা ৭ ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ। ওয়ানডে ও টি২০ সিরিজে সমান ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে বাংলাদেশ দল। কোন প্রকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাও দেখা যায়নি। সহজেই হেরে গেছে বাংলাদেশ দল। এর পেছনে নিউজিল্যান্ডের অচেনা কন্ডিশন ও উইকেট পরিস্থিতিকেই আগে আনছেন সবাই। ২০১০ সালের পর এই প্রথম আবার দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে নিউজিল্যান্ডে গেছে মাশরাফি বিন মর্তুজা ও মুশফিকুর রহীমের দল। ওয়ানডে ও টি২০ ক্রিকেটে ক্রমেই উন্নতির গ্রাফটা উর্ধমুখী হচ্ছে। এমন অবস্থান নিয়েও কিউইদের গায়ে বিন্দুমাত্র কোন আঁচড় কাটতে পারেনি বাংলাদেশ। ব্যর্থতার পেছনে কি শুধুই অচেনা কন্ডিশন? খাপ খেয়ে উঠতে না পারা? এর সঙ্গে ব্যাটসম্যানদের ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতাটাকেও কাঠগড়ায় তুলছেন অনেকে। কোন ব্যাটসম্যানই তাদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। অথচ স্বাগতিক ব্যাটসম্যানরা রানের ফুলঝুড়ি ছুটিয়েছেন। এর মধ্যেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু লড়াই ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। সে লড়াইগুলো ঢাকা পড়ে গেছে দুই সিরিজেই হোয়াইটওয়াশ হওয়ার কারণে। ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই তিন শতাধিক রান করে বাংলাদেশকে চাপে ফেলেছিল নিউজিল্যান্ড। তারা যখন ব্যাট করেছে মনে হয়েছে ক্রাইস্টচার্চের উইকেট ব্যাটসম্যানদের জন্য স্বর্গ। কিন্তু ৩৪১ রানের বিশাল চাপটা নিতে পারেনি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। ২৬৪ রানেই গুটিয়ে গেছে। ওই ম্যাচে অবশ্য ইতিবাচক মনোভাবটা দেখিয়েছিলেন ক্রিকেটাররা। কিন্তু পরের দুই ওয়ানডেতে সেটাও দেখা যায়নি। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং সব বিভাগেই ছিল বেহাল দশা। দ্বিতীয় ম্যাচে কিউইদের ২৫১ রানে গুটিয়ে দেয়ার পরও মাত্র ১৮৪ রানে গুটিয়ে গেছে বাংলাদেশের ইনিংস। তৃতীয় ওয়ানডেতে ৯ উইকেটে মাত্র ২৩৬ রানের এক মামুলী সংগ্রহ গড়েছিল বাংলাদেশ দল সেটা ২ উইকেট হারিয়ে মাত্র ৪১.২ ওভারে টপকে যায় নিউজিল্যান্ড। আড়াই বছর পর আবার ওয়ানডে ক্রিকেটে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার লজ্জা সঙ্গী হয়। টি২০ সিরিজেও উন্নতির ছাপ দেখা যায়নি। শেষ ম্যাচে অবশ্য ব্যাটসম্যানরা ভাল করেছেন, কিন্তু ফলাফল আবার ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ। সফরের শুরুতে নিউজিল্যান্ড একাদশের বিরুদ্ধে বড় পরাজয়টাই ইঙ্গিত দিয়েছিল এ কন্ডিশনে দুর্দশায় পড়তে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ধারেকাছেও না ঘেঁষা ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া দলটির কাছে ৩ উইকেটে হেরে যায় সফরকারীরা। সবমিলিয়ে টানা ৭ পরাজয়ে মুষড়ে গেছে বাংলাদেশ দল। এ বিষয়ে অধিনায়ক মাশরাফি বলেন, অন্তত একটি ওয়ানডে ও একটি টি২০ আমাদের জেতা উচিত ছিল। আর সেটি জিতলে হয়ত সিরিজও জিততে পারতাম। দ্বিতীয় ওয়ানডে যদি আমরা জিততে পারতাম, তাহলে পুরো সিরিজ অন্যরকম হতে পারত। নিউজিল্যান্ডে এসে কোন দলই ভাল করে না। তবে আমরা চেয়েছিলাম যদি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারি, সেটা নেব। কিন্তু বারবার সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেছি। মাশরাফির কথাটা মিথ্যা নয়। বেশকিছু ক্ষেত্রে দারুণ লড়াই করেছিলেন ক্রিকেটাররা। বিশেষ করে প্রায় সবগুলো ম্যাচেই বোলাররা দারুণ শুরু এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু সবই পর্যবসিত হয়েছে সেটা ধরে রাখতে না পারা এবং বাজে ফিল্ডিং ও ক্যাচ মিসের মহড়ায়। ব্যাটসম্যানরাও দুয়েকজন দারুণ জুটি গড়ে জয়ের আশা জাগিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু দলের বাকি ব্যাটসম্যানরা হয়েছেন ব্যর্থ। ধারাবাহিকভাবে ভাল ইনিংস খেলতে পারেননি কোন ব্যাটসম্যানই। কাগজে-কলমে বাংলাদেশের জন্য সফরটি ভুলে যাওয়ার মতোই। কিন্তু লড়াইটা ছিল ভেতরে ভেতরে যা নজরে পড়েনি সামগ্রিক ব্যর্থতার কারণে। এ সিরিজে বাংলাদেশের বিপক্ষে ছয়টি জয় যে খুব সহজে আসেনি, সেটির সাক্ষ্য দিচ্ছেন নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যান কোরি এ্যান্ডারসনই। তিনি জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত সিরিজের ‘স্কোর লাইন’ বাংলাদেশের লড়াইটাকে ঠিকমতো তুলে ধরতে পারছে না। ওয়ানডে ক্রিকেটে এক সময়ের দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান (৩৬ বলে) সিরিজে এখন পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচেই নিউজিল্যান্ডের জয়ে সন্তুষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশের লড়াইটাকেও বাহবা জানিয়েছেন, ‘প্রতিটি ম্যাচে জয় পাওয়াটা দারুণ সন্তুষ্টির ব্যাপার। কিন্তু আমার মনে হয় সিরিজের ফল, স্কোর ঠিক বোঝাতে পারছে না তা কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল এটা।’ ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে টানা তিন ওয়ানডেতে হারের অভিজ্ঞতা হয়েছিল এ্যান্ডারসনের। সেটি ছিল তার ক্যারিয়ারের প্রথম পূর্ণ সফর। ওই সফরে টেস্ট অভিষেকও হয়েছিল। এ্যান্ডারসন বলছেন, বাংলাদেশের উন্নতির গ্রাফটা উর্ধমুখী, ‘গত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ দল হিসেবে অনেক বদলে গেছে। তারা এখন প্রতিটা ম্যাচেই লড়াই করে।’ তিনি মনে করেন, এই সিরিজে বাংলাদেশের খেলা দেখে সমর্থকেরা হতাশ, এটাও দলের ক্রমোন্নœতির একটা লক্ষণ। দলের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। অতীতে নিউজিল্যান্ড সফরগুলোতে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে লড়াইয়ের তৃপ্তিটাও খুব বেশি আসেনি। এখন পর্যন্ত ওয়ানডে ও টি২০ সিরিজের এমন অনেক মুহূর্ত এসেছে, যেখানে ছিল বাংলাদেশের দাপট। জয়ের সম্ভাবনা তৈরি করেও সমীকরণ শেষ পর্যন্ত মেলাতে না-পারা। কিছু ভুল সিদ্ধান্তে ছিটকে পড়া ম্যাচ থেকেই। দলগত নৈপুণ্যে একসঙ্গে জেগে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। সেটাই কাল হয়েছে। এর সঙ্গে ছিল নিউজিল্যান্ডের তীব্র শীত। এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান বলেন, ‘আমরা যদি জিততে চাই শুধু সিনিয়র ক্রিকেটারদের দায়িত্ব নিলেই চলবে না। আমরা ৫/৬ জন সিনিয়র ক্রিকেটারই যদি সবসময় খেলি তাহলে দলে বাকিরা আছে কিজন্য? জিততে হলে ১১ জন ক্রিকেটারকেই ভাল খেলতে হবে। এটাই জরুরী। সেটা হয়নি বলেই আমরা জিততে পারিনি।’ আর মাশরাফি বলেছেন, ‘আমাদের বোলাররা ভাল বোলিং করেছে। কিন্তু এখানে গতিময় ও বাউন্সি উইকেটে ওরা খেলে অভ্যস্ত। আমাদের পেসাররা যখন শর্ট অব লেন্থে বল ফেলেছে তারা খুব সহজেই খেলেছে বুক সমান উচ্চতায় যাওয়া বলগুলো। কিন্তু ওদের পেসাররা যে বলগুলো করেছে সেসব আমাদের মাথা পর্যন্ত উঠে গেছে। আমরা সেসব ভালভাবে মোকাবেলা করতে পারিনি। এখানকার প্রচ- শীতও আমাদের স্বাভাবিক খেলার ওপর প্রভাব ফেলেছিল।’ বাংলাদেশের টানা পরাজয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে মুশফিকুর রহীমসহ তামিম ইকবাল, মাশরাফি ও ইমরুলের ইনজুরিতে পড়ার ধাক্কা। মুশফিক একটা ওয়ানডে খেলে আর নামতেই পারেননি। তবে ভাল কিছু ব্যাপারও ছিল এ সিরিজে। যেমন টি২০ সিরিজের শেষ দুই ম্যাচে ওপেনার সৌম্য সরকার দারুণ ব্যাটিং করে রানে ফিরেছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ছিলেন পুরোপুরি ব্যর্থ। আর এ সিরিজেই আবার পুরনো ছন্দে ফিরেছেন পেসার রুবেল হোসেন। টি২০ সিরিজে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন তিনি। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বাঁহাতি পেস স্তম্ভ মুস্তাফিজুর রহমানের ফিরে আসা। ইনজুরির কারণে কাঁধে অস্ত্রোপচার করানো হয়েছিল মুস্তাফিজের। এরপর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শেষে তিনি প্রথম ওয়ানডেতেই ফেরেন দীর্ঘ ৫ মাস পর। সেটি ছিল ৯ মাসের মধ্যে তার প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ওই ম্যাচে দুই উইকেট নেয়ার পরের ম্যাচে বিশ্রাম দেয়া হয়। তৃতীয় ওয়ানডেতে আবার দুই উইকেট শিকার করেন দারুণ বোলিং করে। টি২০ সিরিজেও দুই ম্যাচ খেলেছেন। তবে তেমন উজ্জ্বলতা ছড়াতে পারেননি। এ বিষয়ে মাশরাফি অবশ্য আগেই বলেছিলেন, ‘অনেকদিন পর ফিরে আবার পুরনো ছন্দে বোলিং করাটা কঠিন। মুস্তাফিজ যেভাবে ফিরেছে সেটাতে আমি সন্তুষ্ট। যত ম্যাচ খেলবে ওর উন্নতি ঘটবে।’ কিন্তু যেটাই হোক, টানা দুই সিরিজে হোয়াইটওয়াশের গ্লানি আবার কাঁধে চেপেছে। অথচ গত দুই বছরে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ দল। ঘরের মাটিতে টানা ৬টি ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে। সর্বশেষটা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২-১ ব্যবধানে হারলেও পুরোপুরি ইতিবাচক ছিল দল। আবার টি২০ ক্রিকেটেও উন্নতির ছাপ দেখা গেছে গত বছরের শুরুতে এশিয়া কাপ টি২০ আসরে রানার্সআপ হওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু সেই সুন্দর সময়গুলো বড় ধাক্কা খেয়েছে এবার নিউজিল্যান্ড সফরে। বিপর্যস্ত আর দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশের চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে গেছে বিদেশের মাটিতে।
×