ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নারী নেত্রী ও সমাজবিজ্ঞানীদের আশঙ্কা

বিয়ের বয়স কমলে মাতৃমৃত্যুর হার বাড়বে

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

বিয়ের বয়স কমলে মাতৃমৃত্যুর হার বাড়বে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’-এর যে খসড়া মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে তাতে বিশেষ ক্ষেত্রে বিয়ের প্রসঙ্গটি ১৯ ধারায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিশেষ প্রেক্ষাপটে আদালতের নির্দেশ ও মা-বাবার সম্মতিতে অনুষ্ঠিত বিয়ে বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ এবং বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে আদালত ও পরিবারের অনুমতি সাপেক্ষে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। তবে ১৮ বছরের নিচে কত বছরে বিয়ে হতে পারে তা এই খসড়া আইনে নির্দিষ্ট করে বলা নেই। এই আইন কার্যকর হলে ধর্ষণসহ মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নারী নেত্রী ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নতুন আইনে বিয়েতে রাজি না হলে জোর করে যৌন সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে বিয়ের সুযোগ তৈরির প্রবণতা বাড়বে। নতুন বছরে নারী নির্যাতনের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে এটি মোকাবেলাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবেই দেখছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, বহুদিনের চেষ্টায় মাতৃমৃত্যুর হার কমানো গেলেও বিয়ের বয়স কমে গেলে আবারও এই হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। কারণ ১৮ বছরের আগে নারীর শারীরিক গঠন সন্তান ধারণের জন্য প্রস্তুত হলেও তার নিজের শরীরের জন্য তা ক্ষতিকর। কিন্তু কোনো শঙ্কাই কানে নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, ধর্ষণের কারণে জন্ম নেয়া সন্তানদের বৈধতা দেয়াও সমাজের দায়িত্ব। ফলে একটু কম বয়সে বিশেষ ক্ষেত্রে বিয়ের বিধান রাখা যেতেই পারে। মানবাধিকার এবং নারী সংগঠন, চিকিৎসক এবং নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা দেশী-বিদেশী এনজিওগুলো এর ঘোর বিরোধী। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম গত ৮ জানুয়ারি মহিলা পরিষদের এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বলেন, ‘বিশেষ ধারার সুযোগ নিয়ে আইনের অপব্যবহার করবে সমাজ, পরিবার ও সংশ্লিষ্টরা। তিনি বলেন, আদালত ও অভিভাবকের পরামর্শ ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বিয়ে দেয়া যাবে জানার পর জোরপূর্বক ধর্ষণ করে বিয়ের বৈধতা নেয়ার প্রবণতা বাড়বে। ভুলে গেলে চলবে না, কোন মেয়ের শিশু বয়সে বিয়ে হলে দ্রুত মা হওয়ার কারণে তার শারীরিক সুস্থতাও হুমকির মুখে পড়বে।’ ‘এছাড়া, কন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ এবং শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া বন্ধ করতে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমরা বিবিএস এবং ইউনিসেফের এক জরিপে দেখলাম যে, শুধু শহরেই ২৩% মেয়েদের ১৮ এর পূর্বে বিয়ে হচ্ছে। গ্রামের চিত্র আরও ভায়াবহ। এ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ বিধানে কন্যার ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে করা হলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে বিশেষ বিধান পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।’ মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল রোজিনা আক্তারের। দু’বছর না যেতেই সে এখন কন্যা সন্তানের মা। আর স্বামীও তাকে ছেড়ে গেছেন সন্তান জন্মের আগে। মেয়েকে নিয়ে রোজিনা ঢাকায় বস্তিবাসী। বাবা-মার কুঁড়েঘরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বলছিলেন, হতদরিদ্র পরিবারে শারীরিক মানসিক এক যন্ত্রণার জীবন এখন তার। ‘মেয়ে হওয়ার আগে আমার ওজন ছিল ৪৫ কেজি। বাচ্চা হওয়ার পর এহন ৩২ কেজি। আমার বাচ্চা হইছে সিজারে। অনেক ধরনের সমস্যা। মাজা কোমরে ব্যথা, শরীল দুর্বলতা সবই এখন দেখা যায়।’ রোজিনা বলছিলেন, তার অগোচরেই তিনি গর্ভবতী হয়েছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী রোজিনার অল্প বয়সে বিয়ে এবং গর্ভধারণের ফলেই এসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ১৮ বছরের আগে সন্তানের জন্ম দিলে একজন নারীর কী ধরনের শারীরিক সমস্যা বা ক্ষতি হতে পারে সে প্রসঙ্গে মনোয়ারা হাসপাতালের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ মোসাম্মৎ নুরুন নাহার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আঠারোর আগে শারীরিক মানসিক কোন দিক দিয়েই একটি মেয়ে বিয়ে এবং গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হয় না। যে বয়সে প্রথম পিরিয়ড হবে-তার পরে আস্তে আস্তে তার বডিটা ডেভেলপ করবে। এই ডেভেলপমেন্টের জন্য একটা সময় দিতে হয়। পনেরো থেকে আঠারো বছর পর্যন্ত এই শরীর গঠন চলতে থাকে। আঠারো বছরের আগে যদি মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয় তখন তার প্রপার গ্রোথ হয় না। এ ক্ষেত্রে গর্বধারণ করলে প্রিম্যাচিওর ডেলিভারির শঙ্কা থাকে। যেটি শিশুর মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করে।’ গত ২৪ নবেম্বর ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’-এর খসড়া মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে। এই খসড়া আইনে ১৮ বছরের নিচে বিশেষ ক্ষেত্রে আদালত ও অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে বিয়ে দেয়া যাবে শোনার পর সমালোচনার ঝড় ওঠে সংশ্লিষ্ট মহলে। তবে এই আইনের সমালোচনাকারীদের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি উল্টো আইন প্রণয়নের পক্ষেই মতপ্রকাশ করেন ভিন্ন মাধ্যমে। তার মতে, ‘কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটলে আদালত ও বাবা-মায়ের সম্মতি থাকলেই শুধু বিয়ে হতে পারবে। কোন কিশোরী পরিস্থিতির শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লে বা অভিভাবকহীন কিশোরী, প্রতিবন্ধী মেয়ের ক্ষেত্রে ১৮ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগেই বিয়ে দেয়ার বাধা না থাকার বিষয়টি বলা হচ্ছে।’ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিচালক জনা গোস্বামী আইনটির বিরুদ্ধে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’-এর খসড়া মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদন হয়েছে। এটি এখনও সংসদে পাস হয়নি। তবে আইনটি অনুমোদন পেয়েছে জেনে আমরা সকলেই উদ্বিগ্ন। নারী আন্দোলন ও উন্নয়ন সহযোগী সংগঠনগুলো প্রথম থেকেই একমত যে, আইনে এমন কোন ধারা বা উপধারা সংযোজন করা যাবে না যাতে করে বিয়ের বয়স কমানো যায়। সেখানে ব্যাখ্যাতেই সরকার বলছে, কোন কারণে একটি মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিয়ের অনুমতি মিলবে। এই অবস্থানও বিপজ্জনক।’ ইউনিসেফের তথ্য বলছে, কুড়ি বছরের আগে মেয়েরা সন্তান জন্ম না দিলে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৩ হাজার শিশুর জীবন রক্ষা পাবে। ইউনিসেফের সবশেষ হিসেবে বাংলাদেশে ৫২.৩% মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। আর ১৫ বছরের আগে বিয়ে হয় ১৮.১ শতাংশের। ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে পৃথিবীর শীর্ষে অবস্থানকারী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৫ম এবং ১৫ বছরের আগের তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ৬ষ্ঠ অবস্থানে। এ বিষয়ে সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘আইনে বলা হয়েছে, কন্যা শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতে যেতে হবে। সেখানে আদালত এবং বাবা-মা উভয়ের সম্মতি লাগবে। এটা বিধিতে বলা থাকবে যে কখন কোন প্রেক্ষাপটে আদালত থেকে বিষয়ের অনুমতি দেয়া হবে। এটা যেরকমভাবে বলা হচ্ছে যে, একেবারে অবাধ সুযোগ দেয়া হচ্ছে- তা নয়। আইনটি পাস হলে বাস্তবায়নের জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করা হবে এবং সেখানে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিধিমালা করার সময় সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ’
×