ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভবানীপুর জমিদারবাড়ি

অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে আত্রাইয়ের ঐতিহাসিক নিদর্শন

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে আত্রাইয়ের ঐতিহাসিক নিদর্শন

বিশ্বজিৎ মনি ॥ নওগাঁর আত্রাইয়ের ভবানীপুর জমিদার বাড়ির স্মৃতিচিহ্ন আজ বিলুপ্তির পথে। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। সৃষ্টি আর ধ্বংসের মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কেউ সৃষ্টিতে আবার কেউ ধ্বংসের খেলায় মত্ত। আবার কারও দায়িত্বহীনতায় কালের গহব্বরে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহাসিক নিদর্শন। বর্তমান যেমন গুরুত্ববহ, সোনালী অতীতও তেমনি অনুপ্রেরণা যোগায়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী মূল্যবান নিদর্শন। এসব ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থান আমাদের সত্তায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরকম ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান নওগাঁ জেলাধীন আত্রাই উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে ছোট যমুনা নদীর তীরবর্তী মনোরম পরিবেশের এই জমিদার বাড়িটি। স্থানীয় লোকজনের কাছে ‘ভবানীপুর রাজবাড়ি’ বলেই বেশি পরিচিত। এ জমিদার বাড়ি নওগাঁ শহর থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে আত্রাই উপজেলার ১নং শাহাগোলা ইউনিয়নের ভবানীপুর বাজার সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত। অযতœ ও অবহেলায় এ জমিদার বাড়িটি আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, জমিদার গির্জাশঙ্কর চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রিয়শঙ্কর চৌধুরী জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করে জমিদারি পরিচালনা করতে থাকেন। জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরীর স্ত্রীর নাম ছিল লাবণ্য প্রভা চৌধুরানী। তাদের ছিল ৬ পুত্র ও ৬ কন্যা। জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরীর আমলে জমিদারির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তিনি ভবানীপুর জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি, নাট্যশালা নির্মাণ ও প্রজা সাধারণের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট দূর করার জন্য প্রাসাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক পুকুর খনন করেন। ১৯১০ সালে জমিদার পরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে স্কুলটির নাম জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরীর বাবা গির্জাশঙ্কর চৌধুরীর ভবানীপুর জিএস উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ করা হয়। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর ১৯৬৮ সালের দিকে জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরী সপরিবারে কলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে জমিদারের চতুর্থ পুত্র প্রতাপশঙ্কর চৌধুরী কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। পরে জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরী পুত্রকে রেখেই কলকাতায় পাড়ি জমান। পরবর্তীতে প্রতাপশঙ্কর চৌধুরী তার স্ত্রী ও এক ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে হাতিয়াপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে ২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে তার পুত্র অভিজিৎ চৌধুরী এই জমিদার বাড়ির এক জরাজীর্ণ ভবনে বসবাস করছেন। কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে জমিদারের সুবিশাল অট্টালিকা। জমিদারি আমলে এ রাজবাড়ির মূল ফটকে ছিল দুই জন নেপালী প্রহরী। আজও প্রাসাদগুলোর দেয়াল দেখে বোঝা যায়, রোমান কায়দায় স্তম্ভগুলো জমিদারদের উন্নত রুচির পরিচয় বহন করে। জমিদার বাড়িতে সবমিলিয়ে কয়েকটি আঙিনা এবং অসংখ্য ঘর ছিল। প্রাসাদে ছিল জমিদার বাড়ির তিনটি নিজস্ব মন্দিরÑ দুর্গা মন্দির, গোপীনাথ মন্দির, বাসন্তি মন্দির, যেখানে পুরো বছরের জন্য একজন স্থায়ী পুরোহিত নিয়োজিত ছিলেন। সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো হতো প্রতি সন্ধ্যায়। শোনা যেত শঙ্খধ্বনি, যা কালের বির্বতনে আজ জনমানবহীন স্থানে পরিণত হয়েছে। জমিদার বাড়িটিতে এখন শান বাঁধানো একটি কুয়োর অস্তিত্ব রয়েছে। জমিদার বাড়ির সামনে শান বাধানো বড় একটি পুকুর, যার পাশে ছিল এলাকায় প্রচলিত ‘গান বাড়ি’ নামক ভবন যেখানে গান বাজনাসহ বিভিন্ন মনোরঞ্জনের কাজ চলত। গান বাড়ির নিকটেই ছিল একটি বৈঠকখানা, যেখানে প্রতিনিয়ত চলত বিচার-সালিশ। বৈঠকখানার সামনে ছিল বড় ফুলের বাগান। বাগান বাড়ির চারপাশে রকমারি দেশী-বিদেশী ফুলের সমারোহ দর্শককে মুগ্ধ করত । চারপাশ ছিল পাখির কলকাকলিতে মুখরিত। সেখানে আজ নির্মিত হয়েছে প্রতাপশঙ্কর চৌধুরীর নামকরণে ভবানীপুর পিএস ল্যাবরেটরি কিন্ডারগার্টেন এন্ড হাইস্কুল। বৈঠকখানার পশ্চিমে কিছুদূরে রয়েছে একটা ছোট পুকুর, যা আজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে দিনে দিনে জমিদার বাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুট হয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়। প্রাসাদের মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের তীর লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এখন দালানের ইট খুলে নিয়ে এলাকায় অনেকেরই বাড়ি তৈরি হবার কথাও প্রচলিত রয়েছে। অবহেলা অযতেœ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়িতে এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন দেখতে আসে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল অট্টালিকা। যেন কেউ দেখার নেই! কারও মাথাব্যথাও নেই? যার ফলে বর্তমানে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে ভবানীপুর জমিদার বাড়ি। বাড়িটিতে সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি কখনও। দিন দিন বাড়িটি তার সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হলে এই জমিদার বাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। জমিদার বাড়িটি শীঘ্রই সংস্কার প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই ঐতিহাসিক নিদর্শন, বাংলার গৌরব ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহাসিক ভবানীপুর জমিদার বাড়ি সংস্কারে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করছেন উপজেলার সচেতন মহল।
×