ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৪৬ জনের মধ্যে জীবিত আছেন ২২ জন ॥ ২৫ মার্চকে কালো দিবস ঘোষণার দাবি

রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বা খেতাব পাননি রাজারবাগের পুলিশ মুক্তিযোদ্ধারা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বা খেতাব পাননি রাজারবাগের পুলিশ মুক্তিযোদ্ধারা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বা খেতাব পাননি ঢাকার রাজারবাগের পুলিশ মুক্তিযোদ্ধারা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে বর্বর পাকবাহিনী প্রথম রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হামলা চালায়। তখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন পুলিশ সদস্যরা। জীবনবাজি রেখে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন ৬০০’র বেশি পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে ৪৬ জন তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে এখন জীবিত আছেন মাত্র ২২ জন, যারা রাজারবাগে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। অথচ তাদের কারও ভাগ্যেই এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতি জোটেনি। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্ষেপ, তাদের কেউই রাষ্ট্রীয় খেতাব বা কোন সম্মাননা এখন পর্যন্ত পাননি। মৃত্যুর আগে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ। তাদের বক্তব্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন ইপিআর কিংবা সেনা মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা সম্মাননা পেলেও এক্ষেত্রে বঞ্চিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। প্রতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে ‘বিজয় পদক’ চালুর দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই। তারা বলছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ইতিহাসের নৃশংসতম ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে আমাদের ওপর। তাই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ২৫ মার্চকে ‘কালো দিবস’ ঘোষণারও দাবি জানিয়েছেন পুলিশ মুক্তিযোদ্ধারা। বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোঃ শাহজাহান মিয়া। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে কর্মরত ছিলেন তিনি। পুলিশ লাইনসে পাকসেনাদের হামলার পর প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। হামলার সংবাদ পুলিশ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দেন। যুদ্ধের সময় রাজারবাগে তিন দিন বন্দী ছিলেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা। অবশেষে পাকিস্তানী সেনাদের কাছ থেকে পালিয়ে যান তিনি। এরপর ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন শাহজাহান মিয়া। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেয়ায় সারাদেশের পুলিশ সদস্য থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিলেন। সবার মধ্যে দেশপ্রেম কাজ করেছিল। আমাদের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি বলেন, আমরা প্রথম পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তাহলে আমাদের প্রতি রাষ্ট্রের এত অবহেলা কেন। একে একে রাজারবাগের সেই মুক্তিযোদ্ধারা চিরতরে বিদায় নিচ্ছেন। কমতে কমতে এখন মাত্র ২২ জন জীবিত আছেন। তাদের মধ্যে মাত্র চারজন ঢাকায় থাকেন। অনেকে অসুখ-বিসুখে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউই মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি পাননি। এ কারণে অনেকের মনে চাপা কষ্ট রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আশা করি প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে দৃষ্টি দেবেন। কারণ মরণোত্তর সম্মাননা দিয়ে কী লাভ? জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেলে অনেকে শান্তি পাবেন। তাদের দীর্ঘদিনের চাপা কষ্টের অবসান হবে। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় অবদানের জন্য ইপিআর ও সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ৯০ ভাগই এখন খেতাবপ্রাপ্ত। প্রতি বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভাগীয় পর্যায়ে এ দুই বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। যে কৃতিত্বের জন্য স্বাধীনতা পদক-২০১১ পেয়েছে পুলিশ ॥ ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকসেনারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে প্রথম প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এ কারণে বাংলাদেশ পুলিশকে স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। ওই প্রতিরোধযুদ্ধের বীরসেনানী ছিলেন অনেকেই। তাদেরই একজন প্রয়াত সার্জেন্ট মর্তুজা হোসেন, যিনি প্রতিরোধযুদ্ধে বিশেষ বীরত্বের কারণে প্রশংসিত হয়েছেন। তাকে পাকিস্তানী সেনারা নির্যাতনের সময় মর-তাজা বলে ডাকত। তাঁর এক লেখায় সে দিনের নানা ঘটনা প্রকাশ পায়। ওই লেখায় তিনি জানিয়েছেন, ২৫ মার্চ সন্ধ্যার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থেকে কয়েকজন ছাত্রনেতা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে গিয়ে রাতেই ঢাকায় আর্মিরা হামলা চালাতে পারে বলে জানান। এ খবরে বাঙালী পুলিশ সদস্যরা হামলা প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন। রাত পৌনে ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে ৪০টি সশস্ত্র সেনাভর্তি ট্রাক পুরনো এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরে শহরের দিকে এগোতে থাকে। কয়েকটি ট্রাক রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের দিকে যায়। পাকসেনারা পুলিশ লাইনসের পশ্চিমে মালিবাগ ও শান্তিনগর মোড়ে এবং শাহজাহানপুর ও ফকিরাপুল এলাকায় অবস্থান নেয়। তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের পুলিশ সদস্যরা শাবল দিয়ে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে অস্ত্র সংগ্রহ করেন আর ম্যাগাজিন গার্ডে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন। অস্ত্রসহ রাজারবাগের বিভিন্ন ভবনের ছাদে, কার্নিশে, গলিতে, রাস্তার মোড়ে অবস্থান নেন তারা। রাত ১২টার আগেই পাকসেনারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে মালিবাগের দিক থেকে প্রথম আক্রমণ চালায়। প্রতিরোধে গর্জে ওঠে বাঙালী পুলিশ সদস্যদের থ্রিনটথ্রি রাইফেল। বহু পাকসেনা হতাহত হয়। হতাহতদের ট্রাকে উঠিয়ে দ্রুত পিছু হটে পাকসেনারা। এরপর পাকসেনারা ট্যাঙ্কসহ ভারি অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ভবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আহত হন বহু পুলিশ সদস্য। রিজার্ভ অফিসের সব কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয়। রাত ৩টার দিকে রাস্তার পাশে থাকা ইপিআরপির (ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট পুলিশ) পাঁচটি টিনশেড ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। ব্যারাকে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে শহীদ হন বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এভাবেই প্রতিরোধযুদ্ধ চলে। এরপর পাকসেনারা ট্যাঙ্কের সহায়তায় পুলিশ লাইনসের ভেতরে ঢুকে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। তারা বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানী পতাকা ওড়ায় আর পৈশাচিক আনন্দে রাজারবাগে নারকীয় তা-ব চালায়। এ সময় বহু পুলিশ সদস্য সাধারণ পোশাকে ছদ্মবেশে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তাঁদের অনেকেই বিভিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বা ভারতে বা নিজ এলাকায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। সার্জেন্ট মর্তুজা হোসেন লেখেনÑ তিনিও পাকসেনাদের নির্যাতনের পর বন্দীদশা থেকে পালিয়ে পুরানা পল্টনে এক আত্মীয়র বাসায় এক মাস ২৩ দিন আত্মগোপনে ছিলেন। এরপর ছদ্মবেশে মুজিবনগর সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে পালিয়ে রাজশাহী হয়ে ভারতে যান। যোগদান করেন কলকাতা পুলিশ সদর দফতরে। সেখানে স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত বিভিন্ন অপারেশনের কৌশল ও পরিকল্পনা সম্পর্কিত অতিগোপনীয় কার্যক্রমে অংশ নেন। প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে বিশেষ বীরত্ব দেখানো ৩৬ জনকে সম্মানিত করা হয় বাংলাদেশ পুলিশের তরফ থেকে। রাজারবাগের আরেক মুক্তিযোদ্ধা আবু সামা জনকণ্ঠকে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। তাই আমরা চাই এ দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘কালো দিসব’ হিসেবে পালন করা হোক। পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব বা সম্মাননার দাবি জানিয়ে বলেন, আশা করি সরকার এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের রাস্তা, ভবন, মিলনায়তনসহ বিভিন্ন রকমের স্থাপনা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণেরও দাবি জানান তিনি। এদিকে নতুন করে নির্মাণ হচ্ছে রাজারবাগের পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার করা জিনিসপত্র, চিঠি, অস্ত্র, যন্ত্রপাতিসহ সবকিছুই স্থান পাচ্ছে এ জাদুঘরে। পাশাপাশি যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর রেখে যাওয়া জিনিসপত্রও জাদুঘরে সংক্ষণ করা হচ্ছে। আগামী ২৩ জানুয়ারি নতুন জাদুঘরটি প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
×