ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

পপুলিজম ॥ পুঁজিবাদী অর্থনীতির রাজনৈতিক ভেক

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

পপুলিজম ॥ পুঁজিবাদী অর্থনীতির রাজনৈতিক ভেক

দু’হাজার ষোলো সালে রাজনীতিতে পপুলিজম টার্মটি বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হয়ে নতুন বছর সতেরোয় ছড়িয়ে পড়ছে। পশ্চিমা পুঁজিবাদের মুখপত্র বাঘাবাঘা সব পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হওয়ার বিভ্রান্তিও বাড়ছে সমান্তরালভাবে। এবং এসব তথাকথিত ‘তত্ত্ব’ আমদানির আসল উদ্দেশ্য এটাই- বিভ্রান্তি ছড়ানো পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার প্রচ- সঙ্কট আড়াল করতে কিছু দিন পর পর এ ধরনের সংস্কারবাদী ফর্মুলার প্রয়োজন হয়। উনিশ শ’ বিরানব্বই সালে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ‘দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি এন্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ বইয়ে তত্ত্ব দিয়েছিলেন- সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ এবং পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয় হয়েছে। শ্রেণী সংগ্রামের অবসান হয়েছে। তিনি মার্কসকে পরাজিত এবং হেগেলের ভবিষ্যদ্বাণীকে বিজয়ী ঘোষণা করে বলেছিলেন, পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্রই হচ্ছে সভ্যতার চূড়ান্ত রূপ। বর্তমান সভ্যতা সেই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানুষের এখন সুখের দিন শুরু হলো। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়ার জোর প্রচারে ফুকুয়ামার তত্ত্ব যতই ঝড় তুলুক বাস্তবে দেখা গেল ‘উদার নৈতিক গণতন্ত্রের’ স্বর্গরাজ্যে বেশিরভাগ মানুষের জীবনে সুখের নহর বইছে না। একটা বিকল্প ব্যবস্থা অনুসন্ধান তারা করেই চলল। এবং দু’হাজার আট থেকে চৌদ্দর অর্থনৈতিক মন্দা সেই বিকল্প হিসেবে সমাজতন্ত্র বা অন্য কোন ফর্মে বৈষম্যহীন সমাজকেই বার বার তাদের মননে ও মগজে মূর্ত করেছে। একে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স পুঁজির পক্ষে। তাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্করা থেকে থেকে তাই এমন সব ‘তত্ত্ব’ হাজির করে যা শুনলে হঠাৎ মনে হয় এরা বুঝি পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলছে। তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলছে। কিন্তু বিভ্রান্তি কাটিয়ে স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে তাকালে দেখা যাবে এর পুরোটাই অন্তসারশূন্য। ধূর্ততায় ভরা কিছু অর্থহীন কথামালার সমষ্টি। ‘তত্ত্বগুলো’ এসেছে বিভিন্ন ফর্মে। ধাপে ধাপে। কখনও সমান্তরালভাবে। সহস্রাব্দের প্রথমদিকে ‘ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম’ নামে একটি প্ল্যাটফরম আন্তর্জাতিকভাবে গলা চড়িয়ে ‘বিকল্প নতুন বিশ্ব’ গড়ার আওয়াজ তুলে তৃতীয় ধারা বা বিকল্প পৃথিবী গড়ার কথা বলেছিল। নয়া উদারনীতিবাদী বিশ্বায়নের বিপরীতে এরা সংহতির অখ- বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো শোষনমূলক সংস্থাগুলোর শান্তিপূর্ণ বিরোধীতা করে সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য সমালোচনা ও সুপরামর্শ দেয়া এদের লক্ষ্য। উল্লেখিত সংস্থাগুলোর শান্তিপূর্ণ বিরোধীতা করে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির প্রতিপক্ষ এরা কীভাবে হবে তা বিশাল গবেষণার বিষয়। তাছাড়া শুরুতে এদের অর্থের যোগানদার ছিল ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও চার্লস-স্টুয়ার্ট মট ফাউন্ডেশনের মতো মার্কিন বৃহৎ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। সুতরাং লম্বা চওড়া কথার আড়ালে আসল উদ্দেশ্য যে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার ক্ষতগুলো আড়াল করা, ঢাল হিসেবে একে রক্ষা করা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ‘পপুলিজম’ও এরকম বাগড়াম্বরপূর্ণ চাতুরি। ডিকশনারিতে এর বাংলা প্রতিশব্দ করা হয়েছে ‘লোকরঞ্জনবাদ’। এদের বক্তব্য এরা যা করে তা সবই জনগনের স্বার্থে। বিশ্বায়নের কারণে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে যে জনগোষ্ঠী, যারা চাকরি হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত, সামাজিক গঠন বদলে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ প্রান্তিক মানুষ, যারা অসহায় ও মর্যাদা হারানোর আতঙ্কে ভোগে সব সময়, পপুলিস্টরা তাদের জন্য কাজ করে। শুনলে মনে হয় বুঝি দুনিয়ার সব গরীব মানুষের অবস্থা পরিবর্তনের মহানব্রত নিয়ে মাঠে নেমেছে এরা। অনেকটা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকারীদের মতো। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে আন্দোলন সংগ্রাম করে। পপুলিস্টদের কোন রাজনৈতিক দর্শন নেই। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বা বিদ্যা বুদ্ধির বালাই নেই। যেসব পরিবর্তনের কথা তারা বলে সেসব বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা দিক নির্দেশনা নেই। নিছক আবেগী কথার মধ্য দিয়ে জনগনকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। যার বিষয়বস্তু প্রধানত তীব্র জাতীয়তাবাদ, অতীতের জন্য আক্ষেপ ইত্যাদি। পপুলিস্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন বলেন, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’। কিংবা হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান বা নেদার ল্যান্ডস এর পার্টি ফর ফ্রিডম দলের গির্ট ভিল্ডার্স মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়াতে জনগনের সামনে এমন এক খ্রিস্টীয় ইউরোপের ছবি তুলে ধরেন যা দলে দলে মুসলমানরা এসে দখল করে নিয়েছে। জনগনের মনে খ্রিস্টীয় ইউরোপের জন্য নস্টালজিয়া তৈরি হয়। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের ফলে উন্নত দেশগুলোতেও চাকরি হারাচ্ছে অনেক মানুষ। সম্পদের বৃহত্তর অংশ করপোরেশন আর ধনীদের দখলে। ‘আমরাই নিরানব্বই’ শতাংশের জীবনমান অব্যাহত খারাপের দিকে। পপুলিস্ট নেতারা এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট পথ দেখাচ্ছেন না। দেখানো তাদের উদ্দেশ্যও নয়। কেননা তারা এসবের সমাধান চান না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পপুলিজমের নামে এ ভেক টার্মের আবির্ভাব হলো কেন? পপুলিজম শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ দিকে আমেরিকায়। তখন এ শব্দটি যে তাৎপর্য বহন করতো এখন তা বদলে গেছে। আমেরিকান একচেটিয়া তন্ত্রের বিরুদ্ধে সেদেশের কৃষকদের সম্মিলিত প্রতিবাদ আন্দোলন কে সে সময় ‘পপুলিজম’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। এখন এ শব্দ দিয়ে বোঝানো হয় সরকারি, বেসরকারি, কর্পোরেট সুবিধাভোগী অভিজাতদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ক্ষোভ। যার প্রকাশ খুব ভাসা ভাসা। কারণ যাদের কাছ থেকে এ ক্ষোভের তীব্র বহিপ্রকাশ হওয়ার কথা সেই শ্রমিক ও কৃষকদের শক্তি কমে গেছে। বড় পুঁজির আক্রমন থেকে ছোট পুঁজিকে রক্ষা করতে রাষ্ট্র যে ভূমিকা নিত ফিনান্স পুঁজিকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে রাষ্ট্র তা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এতে হস্তশিল্পী, মৎসজীবি, কারিগরদের মতো ছোট উৎপাদকেরা বড় পুঁজির গ্রাসে চলে যাচ্ছে। ফলে শ্রমিকরা দূর্বল হয়ে আন্দোলনের ক্ষমতা হারাচ্ছে। ‘শ্রমবাজারের নমনীয়তা’ কেড়ে নেয়া শ্রমিকদের দূর্বল হয়ে পড়ার আরেক কারণ। এ ব্যবস্থায় শ্রমিকরা নুন্যতম যে সুরক্ষা পেতো শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে তা কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এতে শ্রমিকদের গঠনগত পরিবর্তন সহ শ্রমিক শ্রেনীর রাজনৈতিক ক্ষমতা কমে গেছে। একদিকে কর্পোরেট ফিনান্সিয়াল অভিজাতদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বেড়েছে, অন্যদিকে শ্রমিক কৃষকরা উৎপাদন থেকে ক্রমশ সরতে সরতে ব্যাপক দারিদ্রে নিমজ্জিত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যুগে শ্রেনী সম্পর্কের ভারসাম্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তাদেরকে নেতৃত্ব দেয়ার রাজনৈতিক দলও নয়া উদারবাদে আক্রান্ত হয়ে দূর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ শূন্যস্থানে পপুলিস্ট নামের ভেকধারীরা অনায়াসে জায়গা করে নেয়।
×