ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শুধু সুখপাঠ্য নয়

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

শুধু সুখপাঠ্য নয়

পাঠ্যপুস্তক সুখপাঠ্য হবে- সেটি নিশ্চয়ই প্রথম শর্ত। পড়তে সুখ, পড়েও আনন্দ পাওয়া যাবে- এটি জরুরী বটে। তবে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পশ্চাৎপদ বই, নীতিবর্জিত বইও সুখকর ভঙ্গির আবরণে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব। তাই বইকে শুধু সুখপাঠ্য হলে চলে না, হতে হয় শিক্ষামূলক, মানসিক বিকাশের জন্য উপকারী এবং দেশ ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববান করে তোলার প্রয়াসী তথা সমাজহিতৈষী। মুক্তিযুদ্ধের আগে একদল তথাকথিত শিক্ষাবিদ ছিলেন যারা সমাজগাড়ির চাকাকে পেছনের দিকে যাত্রার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল লেখকদের রচনা পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই দিতেন। স্বাধীনতার পরও একই প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি; পঁচাত্তরের পর আবার সেই পুরনো ভূত আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের ওপর চেপে বসতে শুরু করেছে। প্রাথমিকের বই নিয়ে যেসব তুঘলকি কাণ্ড আমরা অধুনা প্রত্যক্ষ করলাম তাতে দুশ্চিন্তার অবসান হচ্ছে না, বরং নতুন করে মাথা ব্যথা হচ্ছে। তার আলামত তো আমরা দেখতেই পেলাম পাঠ্যপুস্তক সুখপাঠ্য করার প্রয়াসে মাধ্যমিকের জন্য কমিটি গঠনে। প্রকৃত শিক্ষাবিদরা কি আছেন এই কমিটিতে? কলেজের শিক্ষক আর পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে অংশীদার হলেই যে শিক্ষাবিদ হওয়া যায় না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সে কথা কে বোঝাবে? আমরা স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করছি, পুরোপুরি জামায়াত-হেফাজতমুক্ত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটিই আমাদের দরকার। গো দুগ্ধে এক ফোঁটা বিশেষ তরল পদার্থ পড়লে যেমন তা পুরো পুষ্টিমানকে কলুষিত করে তেমনি যথার্থ শিক্ষাধর্মী পাঠ্যপুস্তক রচনা ও নির্বাচন কমিটিতে একজন প্রতিক্রিয়াশীল ও বিতর্কিত ব্যক্তি থাকলে সেটি কখনই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না। ড. হুমায়ুন আজাদের যে কিশোর কবিতাটি পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেয়া হয়েছে তাতে লেখা হয়েছে- ‘যে-বই জ্বালে ভিন্ন আলো/ তোমাকে শেখায় বাসতে ভালো/ সে-বই তুমি পড়বে/ যে-বই তোমায় অন্ধ করে/ যে-বই তোমায় বন্ধ করে/ সে-বই তুমি ধরবে না।’ এটা এখন স্পষ্ট যে শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তির উজ্জীবনকারী এ জাতীয় লেখা কেন পরিহার করা হচ্ছে। বিদ্যাসাগরের বই না পড়ে কীভাবে শিক্ষার্থীরা বিদ্বান হবে, এটা আমরা বুঝি না। বিচার-বিশ্লেষণজ্ঞানসম্পন্ন মুক্তমনের জাতি গঠনে তাই মানসম্পন্ন ও গভীর বোধসম্পন্ন বই পাঠের কোন বিকল্প নেই। পাঠ্যবইয়ের কেলেঙ্কারির নেপথ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্টদের অযোগ্যতা, অবহেলা, অব্যবস্থাপনা, বিএনপি-জামায়াত জোটের আস্থাভাজনদের সম্পৃক্তি এবং দুই মন্ত্রণালয়ের রেষারেষি। ব্যাধি যখন শনাক্ত হয়েছে তখন তার ব্যবস্থাপত্র পাওয়াও কঠিন হবে না। অসুখ সারাতে হলে সঠিক ওষুধ লাগবেই। রোগীকে গিনিপিগ বানানো চলবে না, কড়া ডোজের ওষুধই তাই প্রত্যাশিত। আমরা আগেও বলেছি, উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে নতুন বই দেয়ায় তাদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। এ কাজের জন্য সরকারের প্রশংসা প্রাপ্য। আমরা আশা করব, ভুলে ভরা পাঠ্যবই সংশোধন করে নতুনভাবে ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে পুনরায় বিতরণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, হেফাজতের চেতনায় নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে যাবে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ের ভুল ও বিকৃতির দায় কার? দায়ী সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। সেই সঙ্গে মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম পর্যালোচনার জন্য গঠিত কমিটিতে যোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি ও বিশেষ দায়িত্ব প্রদান অপরিহার্য।
×