ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

রেজোয়ানের ‘নৌকা স্কুল’ এখন বিশ্বের মডেল

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

রেজোয়ানের ‘নৌকা স্কুল’ এখন বিশ্বের মডেল

পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরের তিন জেলাজুড়ে বিশাল একটি বিলের নাম ‘চলনবিল’। এই বিলে বছরের সাত মাস পানি থাকে। ফলে বছরের বেশিরভাগ সময় এই অঞ্চলের শত শত স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিবছর বন্যায় বিলের পানি লোকালয়ে উঠে গেলে এ অঞ্চলের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব শিক্ষার্থীর কথা বিবেচনা করে চলনবিল অঞ্চলের গুরুদাসপুরের এক যুবক রেজওয়ান তৈরি করেন একটি ‘ভাসমান স্কুল’, যা পরে পরিচিতি লাভ করে নৌকা-স্কুল নামে। তিনি এর প্রসার ঘটাতে সিঁধুলাই স্বনির্ভর সংস্থা নামে একটি অলাভজনক উন্নয়ন সংগঠন গড়ে তোলেন। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এখন গোটা বিশ্বের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব এখন আর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ নিয়ে শুধু পরিবেশ বিজ্ঞানীরাই নন, চিন্তিত বিশ্বনেতারাও। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপ কাক্সিক্ষত মাত্রার চেয়ে বেশ দ্রুত হারে বাড়ছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে ঝড়, বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে, ঘটছে সম্পদের বিনাশ; ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি। এদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেরু অঞ্চলের বরফ গলার হার ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের বিস্তৃত উপকূলীয় এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির লাগাম টানতে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার বিষয়ে এরই মধ্যে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। একে কার্যকর করার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়ানোর মতো নানা পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ বাস্তবায়নে তোড়জোড় চলছে। তবে এক্ষেত্রে এখন আমরাও একটু গর্ব করতে পারি বৈকি। পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ হিসেবে এরই মধ্যে বিশ্বের মনোযোগ কেড়েছে বাংলাদেশের ‘নৌকা স্কুল’। বর্তমানে এই স্কুলকে মডেল স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ভারত, চীন, কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম ও জাম্বিয়ার মতো দেশে চালু হয়েছে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সেøাভানিয়ার মতো উন্নত দেশের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমেও যুক্ত হয়েছে এই স্কুল ভাবনা। তবে শুধু ভাসমান স্কুলেই থেমে থাকেনি সংস্থাটির কার্যক্রম। এখন ভাসমান স্বাস্থ্য ক্লিনিক ও কৃষিবিষয়ক ট্রেনিং সেন্টারের কাজও করছে এই নৌকাগুলোতে। ২০০২ সালের কথা ওই সময়েই এই নৌকা স্কুলের যাত্রা। নৌকা স্কুলের যাত্রা শুরু হয় রেজওয়ান স্কলারশিপের মাত্র ৫শ’ মার্কিন ডলার ও একটি ল্যাপটপ দিয়ে। প্রথম এক বছর তিনি বিভিন্ন স্থানে ই-মেইল করতে থাকেন সাহায্যের আশায়। তার আইডিয়াটা চোখে ধরে যায় বিল এ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের। রসখান থেকেই পেয়ে যান ৫ হাজার মার্কিন ডলার অনুদান। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি রেজওয়ানকে। সাধারণ বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষের মতোই নৌকার ভেতরে শ্রেণীকক্ষ। পাঠাগার, কম্পিউটার ল্যাব সবকিছুই সংযুক্ত হয়। শুধু তাই নয়, এ নৌকা স্কুল চলনবিলের ভূমিতে স্থাপন করা সরকারী স্কুলগুলোর চেয়ে আরও বেশি আধুনিক হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে সিঁধুলাই স্বনির্ভর সংস্থার (এসএসএস) এখন ১১১টি নৌকা স্কুল চলনবিলের ঘাটে ঘাটে ভিড়ছে। অভিনব এ পদ্ধতি উদ্ভাবন ও বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই ১৪টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন স্থপতি মোহাম্মদ রেজওয়ান। সম্প্রতি বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ এলাকায় বছরজুড়ে শিক্ষাসুবিধা নিশ্চিত করে হাজারো মানুষের জীবন বদলে দেয়ায় ভারতে পুরস্কৃত হয়েছেন ‘ নৗকা স্কুলের’ উদ্ভাবক স্থপতি মোহাম্মদ রেজোয়ান। রেজোয়ান ভারতের মর্যাদাপূর্ণ ‘শ্রী সত্য সাঁই এ্যাওয়ার্ড ফর হিউম্যান এক্সেলেন্স-২০১৬’ পেয়েছেন। ছয়টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত সাতজনের একজন রেজোয়ান। পুরস্কারটি দেয় ‘শ্রী সত্য সাঁই লোক সেবা ট্রাস্ট’। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে এক অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। সারা বিশ্বের কয়েক শ’ আবেদনের মধ্য থেকে ১৩ সদস্যের বিচারকমণ্ডলী ছয়টি বিভাগে সাতজনকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন। অনুষ্ঠানে ‘শ্রী সত্য সাঁই লোক সেবা গ্রুপ অব এ্যাডুকেশনাল ইনস্টিটিউশনস’-এর প্রধান মেনটর বিএন নরসীমা মূর্তি বলেন, ‘মোহাম্মদ রেজোয়ানকে পুরস্কারটি দেয়া হয়েছে জীবন বদলে দেয়া কাজের জন্য। তার উদ্ভাবিত ভাসমান স্কুলের ধারণাটি বৈপ্লবিক এবং এটা বাস্তবায়নে তার দৃঢ়তা অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক।’ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক তারকা ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার, বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা, হরিহরণ ও শিবামানী প্রমুখ। মোহাম্মদ রেজোয়ানের উদ্ভাবিত ‘নৌকা স্কুল’ পদ্ধতিতে ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষার প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে ‘সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থা’। প্রতিষ্ঠানটি ভাসমান স্কুল, পাঠাগার, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ এলাকার ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়েছে, যাদের অধিকাংশই সুবিধাবঞ্চিত।
×