ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অনুবাদ : এনামুল হক;###;মূল : ফরিদ জাকারিয়া

প্রযুক্তি ও শিল্পকলার বন্ধনে হৃদয়ে সুর মূর্ছনা জাগে

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

প্রযুক্তি ও শিল্পকলার বন্ধনে হৃদয়ে সুর মূর্ছনা জাগে

উদার চিন্তাধারানির্ভর শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এমন শিক্ষার মূল্য সম্পর্কে সূক্ষ্ম উপলব্ধি থাকাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে সর্বাগ্রে এর একটা ব্যাখ্যা থাকা দরকার। বাম-ডান অর্থে উদার চিন্তাধারার সঙ্গে উদার চিন্তানির্ভর শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই। তাই বলে এই শিক্ষা বিজ্ঞানকেও উপেক্ষা করে না। গ্রীক সভ্যতার সময় থেকে ইতিহাস ও সাহিত্যের মতো পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র ও উদার চিন্তানির্ভর শিক্ষার অবিভাজ্য অঙ্গ। আমার নিজের ক্ষেত্রে আমি গণিত ও বিজ্ঞানে আমাদের আগ্রহ আজ অবধি জিইয়ে রেখেছি। উদার চিন্তানির্ভর শিক্ষা হলো জ্ঞানের বহিঃসীমা অবধি ব্যাপক সংস্পর্শ লাভ। এর অর্থ শুধু বিশেষ পেশা বা কাজ শেখার জন্য দক্ষতা অর্জন করা নয়। ইয়েলের প্রেসিডেন্ট প্রয়াত বার্ট জিয়ামাত্তি একদা জিজ্ঞেস করেছিলেন উদার চিন্তানির্ভর শিক্ষার পার্থিব ব্যবহার কি? আমি বলতে পারি যে শিল্পকলার ইতিহাস বা প্রত্মতত্ত্বের ওপর ডিগ্রী নেয়ার জন্য অনেক সময় বেশ কয়েকটি ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর পড়াশোনা থাকতে হয়, বিদেশে কাজ করার সামর্থ্য থাকতে হয়, নান্দনিক দিকের ওপর দৃষ্টি থাকতে হয় এবং কঠোর পরিশ্রম করার অঙ্গীকার থাকতে হয়। আজকের বিশ্বায়িত যুগে যে কোন পেশার জন্যই এসব প্রয়োজন। তবে আমার মনে হয় পার্থিব জগতে উদারনৈতিক শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারটা হলো এই যে, এটা আপনাকে কিভাবে লিখতে হয় শেখায়। উদারনৈতিক শিক্ষা আপনাকে চিন্তা করতেও শেখায়। তবে চিন্তা করা ও লেখা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কযুক্ত। কলামিস্ট ওয়াল্টার লিপম্যানকে একদা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর তার ভাবনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নাকি বলেছিলেন ‘ওই বিষয়ের ওপর আমার ভাবনা কি আমি জানি না। ও নিয়ে আমি এখনও কিছু লিখিনি। ভাবনা আগে না ভাষা আগে তা নিয়ে আধুনিক দর্শনে দারুণ বিতর্ক আছে। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। আমি কেবল এটাই জানি যে, আমি যখন লিখতে শুরু করি তখন লেখার কাজটাই আমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করে। আপনি ঔপন্যাসিক হোন, ব্যবসায়ী হোন, মার্কেটিং কনসালট্যান্ট হোন আর ইতিহাসবিদ হোন; লেখা আপনাকে বাছবিচার করতে এবং ভাবনাচিন্তার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ্বতা ও শৃঙ্খলা আনতে বাধ্য করে। যদি মনে করেন পার্থিব ক্ষেত্রে এর কোন ব্যবহার নেই তাহলে এ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসকে জিজ্ঞেস করুন। বেজোস জোর দিয়ে বলেছেন তার সিনিয়র এক্সিকিউটিভরা মেমো লেখেন যেগুলো অনেক সময় ছাপানো ৬ পৃষ্ঠা সমান লম্বা। জীবনে যা কিছুই করুন না কেন সুস্পষ্টভাবে, স্বচ্ছতার সঙ্গে ও দ্রুত লিখতে পারার ক্ষমতা অমূল্য দক্ষতা হিসেবে প্রমাণিত। আর নানাদিক দিয়ে এটাই হলো উদারনৈতিক শিক্ষার মৌলিক পাঠ। উদারনৈতিক শিক্ষার দ্বিতীয় মস্ত সুবিধাটা হলো এই যে, এটা আপনাকে কিভাবে কথা বলতে ও মনের ভাব প্রকাশ করতে হয়, তা শেখায়। আমার গ্রেডের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল কথা বলা। আমার অধ্যাপকরা আমার উচ্চকণ্ঠে বিষয়বস্তু উপস্থাপন,বিশ্লেষণ ও উপসংহার টানার বিষয়গুলোকে তাদের চিন্তার প্রক্রিয়ায় নেয়ার মধ্য দিয়ে আমাকে বিচার করতেন। সেমিনার নানাদিক দিয়ে উদারনৈতিক শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। এই সেমিনার আপনাদেরকে পড়তে, বিশ্লেষণ করতে এবং সর্বোপরি নিজেকে প্রকাশ করতে শেখায়। প্রতিটি উদারনৈতিক কলেজকে ঘিরে নানা ধরনের পাঠ্যক্রম বহির্ভূত ক্রিয়াকলাপ পরিচালিত হয়। যেমন থিয়েটার, বিতর্ক, রাজনৈতিক ইউনিয়ন, ছাত্রসংসদ ও প্রতিবাদী গোষ্ঠী। এগুলো উপরে বর্ণিত ক্ষমতা ও সামর্থ্যকে জোরদার করে তুলে। মানুষের মনোযোগ আপনাকে আকর্ষণ করতে হবে এবং আপনার উদ্দেশের যথার্থতা সম্পর্কে তাদের মনে প্রত্যয় উৎপাদন করতে হবে। সুস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্তভাবে বক্তব্য পেশ করার মস্ত একটা সুবিধা আছে জীবনে। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, যখনই ব্রিটেনের কেউ ক্লাসে কথা বলে সে তার স্রেফ উচ্চারণভঙ্গীর জন্যই বাড়তি পাঁচ পয়েন্ট পেয়ে যায়। বস্তুতপক্ষে ব্রিটিশ শিক্ষা ও ব্রিটিশ জীবনে কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতার দীর্ঘ ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে জনসমক্ষে বক্তব্য পেশ করার কৌশল শেখানো হয়েছে। উদারনৈতিক শিক্ষার চূড়ান্ত শক্তিটা হলো এই যে, এটা আপনাকে কি করে শিখতে হয়, তা শেখায়। আমি এখন বুঝতে পারি যে, স্কুল ও কলেজে সবচেয়ে মূল্যবান যে শিক্ষাটি আমি লাভ করেছি তা হলো কিভাবে জ্ঞানার্জন করতে হয়। আমি শিখেছি কতটা নিবিড়ভাবে একটা প্রবন্ধ পাঠ করতে হয়। কিভাবে নতুন নতুন উৎসব খুঁজে বের করতে হয়, একটা অনুসিদ্ধান্ত প্রমাণ করা কিংবা ভুল প্রতিপাদন করা এবং লেখক বিশ্বাসযোগ্য কিনা তা নির্ণয় করার জন্য ডাটা বা উপাত্তের সন্ধান কিভাবে করতে হয়। বই কিভাবে দ্রুত পাঠ করা যায় এবং তার পরও এর সারবস্তু আস্বাদন করা যায় তা শিখেছি এবং সবচেয়ে বড় কথা আমি শিখেছি যে শেখাটা একটা আনন্দ, অভিযাত্রার মতো একটা বিরাট এ্যাডভেঞ্চারের ব্যাপার। এগুলো হলো উদারনৈতিক শিক্ষার শক্তি এবং কর্মজীবনে চলার পথে এই শক্তি আপনাকে সাহায্য করবে। আমি ভারতে বেড়ে উঠেছি। আমার সেরা সেরা কিছু বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার, প্রযুক্তিবিদ, ডাক্তার ও এ্যাকাউন্ট্যান্টদের প্রতি আমার বিরাট শ্রদ্ধাবোধ ও মুগ্ধতা আছে। তবে আমাদের সবাইকে যে কথা স্বীকার করতে হবে, তা হলো শিক্ষা একটা শূন্য অংকের খেলা নয়। মানবতাকে বিসর্জন দিয়ে কারিগরি দক্ষতার প্রশংসা করা যায় না। কম্পিউটার বিজ্ঞান শিল্পকলার ইতিহাসের চাইতে ভাল কিছু নয়। সমাজের এই দুটো জিনিসেরই প্রয়োজন এবং প্রায়শই তা সমন্বিতভাবে। আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তা হলে স্টিভ জবসকে বিশ্বাস করুন, যিনি বলেছিলেন, ‘এ্যাপলের ডিএনএ’র মধ্যেই আছে যে প্রযুক্তি এককভাবে যথেষ্ট নয়। উদারনৈতিক শিল্পকলার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ, মানবতাবোধের সঙ্গে দাম্পত্যবন্ধনে যুক্ত প্রযুক্তিই সেই সুফল বয়ে আনে, যার কারণে আমাদের হৃদয় সঙ্গীতের সুরমূর্ছনায় ভরে ওঠে।’ প্রযুক্তি ও উদার শিল্পকলার মধ্যে সেই দাম্পত্যবন্ধন এখন সর্বত্রই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
×