ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিভিন্ন বাহিনীর অভিযানেও সুফল মিলছে না

মহেশখালীতে বন্ধ হচ্ছে না অস্ত্র তৈরি, বিক্রি ও পাচার

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

মহেশখালীতে বন্ধ হচ্ছে না অস্ত্র তৈরি, বিক্রি ও পাচার

আবদুর রাজ্জাক, মহেশখালী ॥ দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীকে ঘিরে সরকারের যখন উন্নয়নের মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে, এরপরও কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে দেশীয় অস্ত্র তৈরি, বেচাকেনা ও পাচার। দ্বীপের বিভিন্ন পাহাড়ের জঙ্গলাকীর্ণ পয়েন্টে এ জাতীয় অস্ত্র উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব, নৌবাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ উদ্ধার হলেও অপরাধমূলক এ কর্মকা-ে জড়িতরা স্থান পাল্টে এ কর্মে লিপ্ত রয়েছে। গহীন জঙ্গলে দেশীয় অস্ত্র তৈরি ও নানা রকম সরঞ্জাম উৎপাদন কোনমতেই বন্ধ হচ্ছে না। বরং স্থান পাল্টে নিত্যনতুন কারখানায় অবাধে তৈরি হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। সম্প্রতি সারাদেশে জঙ্গী হামলা, নাশকতকা ও রোহিঙ্গা তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় এলাকার দাগী সন্ত্রাসী ও দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী দল ও গ্রুপগুলোর কাছে এসব অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে দাম। এখানকার কারিগররা সকাল থেকে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে পাহাড়ের গভীরে তাদের আস্তানায় বিভিন্ন রকমের দেশীয় অস্ত্র তৈরি করে যাচ্ছে। পুলিশ, র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করলেও কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না দেশীয় অস্ত্র তৈরি। কারিগররা সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেপরোয়া হয়ে বেশি অস্ত্র তৈরি ও সরবরাহ করে চলেছে। এলাকার কিছু মুখোশধারী জনপ্রতিনিধি ও কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এসব কারিগরকে অস্ত্র তৈরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বড় মহেশখালীর বড় ডেইল, ছোট মহেশখালী, হোয়ানকের কেরুনতলী পাহাড়, কালারমারছড়ার ফকির জুমপাড়া পাহাড়, শাপলাপুরের সোলতানÑকালাইয়া নামে পরিচিত পাহাড়ী জুম এলাকা, কড়ইবুনিয়া, পুঠিরঝিরি, সারসিয়া, গুলুরবরগুনা, মরাঝিরি, মুদিরছরাঢালা এলাকায় প্রায় ৩০টি অস্ত্র তৈরির কারখানা রয়েছে। অস্ত্র কারিগররা এসব স্থানের গহীন পাহাড়ে খোদাই করে দুই দিকে রাস্তা রেখে মনোরম পরিবেশে ওয়ার্কশপের মতো করে এ অস্ত্র তৈরির কারখানাগুলো স্থাপন করে সেখানেই এসব দেশীয় অস্ত্র তৈরি করে থাকে। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার লোহার পাত, স্টিলের নল, ড্রিল মেশিন, গ্যাসের চুলা, কয়লা, লেদ মেশিনসহ বিভিন্ন অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরির যন্ত্রপাতি। সকাল থেকে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে তারা তাদের আস্তানায় এসব অস্ত্র তৈরির কাজ করে। তারা দিনের বেলায় অস্ত্র তৈরি করাকে বেশি নিরাপদ মনে করে। কারণ এলাকার বিভিন্ন জায়গা ও বিভিন্ন স্থানে তাদের একাধিক সোর্স থাকায় র‌্যাব, পুলিশ আসার আগাম খবর তারা মোবাইলের মাধ্যমে সোর্সের কাছ থেকে পেয়ে সতর্ক অথবা পালিয়ে যায়। ফলে রাতে ঝুঁকি নিয়ে তারা অস্ত্র তৈরির কাজ করে না বলে জানায় সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী। আর এসব অস্ত্র তৈরির কারখানাগুলোতে নিয়মিত আসা-যাওয়া রয়েছে হোয়ানক, নতুনবাজার, কালারমারছড়া, উত্তর নলবিলা এলাকার দাগী সন্ত্রাসী ও একাধিক মামলার ফেরারি আসামীদের। এখানে একটি অস্ত্র তৈরি করতে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা খরচ হলেও সেটি স্থানীয়ভাবে চার-পাঁচ হাজার টাকায় এবং জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭-৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তাদের রয়েছে একটি শক্তিশালী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। ওই নেটওয়ার্ক সাগরপথে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় লবণ ও বিভিন্ন মালামাল পরিবহনের কার্গো ট্রলার, ফিশিং ট্রলার, লবণবোঝাই ট্রাক ও লাকড়ির গাড়ির মাধ্যমে তারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এসব অস্ত্র সরবরাহ ও বিক্রি করে। অপরদিকে তাদের রয়েছে কিছু স্বামী পরিত্যক্ত ও বিপথগামী মহিলা সদস্য। বিশেষ করে সড়কপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র পৌঁছে দেয়াসহ বেচাবিক্রির ব্যাপারে তারা মহিলাদের বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কারণ মহিলাদের সাধারণত কেউ সন্দেহ করে না। এসব মহিলা বোরকা পরে মুখে নেকাব বেঁধে তাদের ভ্যানিটিব্যাগসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এসব অস্ত্র লুকিয়ে রেখে সহজেই স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়। সম্প্রতি মহেশখালী থানা পুলিশ কালারমারছড়া বাজার থেকে এ রকম এক মহিলাকে সিএনজি থেকে গ্রেফতার করেছিল। পরে তার দেহ ও ভ্যানিটিব্যাগ তল্লাশি করে তিনটি দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। গত ৪ জানুয়ারি বুধবার সকাল ৯টা হতে একটানা দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত র‌্যাব-৭-এর সিনিয়র এএসপি সোহেল মাহমুদের নেতৃত্বে র‌্যাব সদস্যরা উপজেলার বড় মহেশখালী ইউনিয়নের পাহাড়তলী গ্রামের গহীন পাহাড়ী জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে একটি অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পায়। অভিযানকালে ১৪টি একনলা বন্দুক, ছয়টি ওয়ান শূটারগান, একটি থ্রি কোয়ার্টার বন্দুক, একটি দেশীয় রাইফেল ও ১৭ রাউন্ড শটগানের তাজা গুলি, চার রাউন্ড ৩০৩ রাইফেলের গুলি, এক রাউন্ড শটগানের গুলির খোসা, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামাদি উদ্ধার হয়। সরঞ্জামের মধ্যে ছিল- ড্রিল মেশিন, বন্দুক তৈরির পাইপ, হেক্সো ব্লেড, র‌্যাত, এয়ার মেশিন, ছেনা ও শানপাথর। র‌্যাব ওই অভিযানে অস্ত্র তৈরির কারিগর বড় মহেশখালীর মুন্সির ডেইল, পাহাড়তলী এলাকার মোঃ আব্দুল মাবুদ (৪০) ও ছোট মহেশখালীর আহাম্মদিয়া কাটা এলাকার আবু তাহেরকে গ্রেফতার করে। বাংলাদেশের মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন মহেশখালী দ্বীপ পাহাড়ী জনপদ হওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসব অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান না জানলেও ওসব এলাকার স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিরা জানেন কোথায় কোন্্ স্থানে কোন্্ পাহাড়ে অস্ত্র কারিগররা এসব অস্ত্র তৈরি করছে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এসব অস্ত্র তৈরির কারখানার তথ্য দেয় তাহলে এক মাসের মধ্যেই মহেশখালীর সকল অস্ত্র তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে মূল কারিগরদের গ্রেফতার, তৈরি অস্ত্র উদ্ধার ও কারখানাগুলো ধ্বংস করা সম্ভব হবে বলে মনে করে এলাকার সচেতন মহল।
×