ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাহালুল মজনুন চুন্নূ

এক স্বর্ণোজ্জ্বল স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

এক স্বর্ণোজ্জ্বল স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ ২৯০ দিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ আর মৃত্যুর প্রহর গোনার পর অবশেষে বিজয়ী বেশে বাঙালীর কাছে ফিরে আসেন ১০ জানুয়ারি। তাঁর অনুপস্থিতি শেলের মতো বিঁধে চলছিল বাঙালীর বুকে, নিদারুণ পীড়া নিয়ে পিতার মঙ্গল কামনায় ব্রতী হয়েছিল তারা। তাই ১০ জানুয়ারিতে তিনি যখন বিজয়ী বেশে ফিরে এলেন এই বাংলায়, সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটি বাঙালীর জীবনে হাজির হলো এক অনিন্দ্য মহাকাব্যিক চিত্রপট এঁকে। আর এর মধ্য দিয়েই পূর্ণতা পেল স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ার্জন, বাংলার বুকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো সংগ্রামী মানুষের চূড়ান্ত বিজয়ের তূর্যনাদ। ভয়াল পঁচিশে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর প্রাক্কালে হানাদার বাহিনী জাতির পিতাকে তাঁর ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তান কারাগারে নিয়ে তাঁকে পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। কিন্তু সৌভাগ্য গ্রেফতার হওয়ার আগেই জাতির পিতা দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যেতে পেরেছিলেন, যার কারণে স্বাধীন দেশমাতৃকার সন্তানরা নিজ দেশ থেকে হানাদার হটানোর জন্য মরণপণ যুদ্ধ করে লাল-সবুজের বিজয়কেতন উড়াতে পেরেছিল। এজন্যই কবি শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় বলেছেন, ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো/ দুলতে থাকে স্বাধীনতা/ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর ঝরে/মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে বন্দী করে ইয়াহিয়া শুরু করেছিল তামাশার বিচার। উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে ভয় দেখিয়ে আপোসে বাধ্য করা আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে খুশি করা। বঙ্গবন্ধুকে মানসিক চাপে ফেলার জন্য তাঁর সেলের পাশে তাঁর জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অন্য ধাতুতে গড়া। বিচারে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে চাইলে তিনি নির্ভয়চিত্তে বলেছিলেন, আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিও’। পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালীদের কাছে নাকানিচুবানি খেতে খেতে যখন পুরো বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল তখন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ইয়াহিয়া ১৫ ডিসেম্বর বাঙালী জাতির পিতার ফাঁসির আদেশ কার্যকরের আদেশ দেয়। কিন্তু জাতির পিতা ছিলেন নির্ভয়। তিনি শুধু ভাবছিলেন তাঁর বাংলার জনগণের মুক্তির কথা। ১৬ ডিসেম্বর তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানী সৈন্য মাথা নত করে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো আন্তর্জাতিক নেতাদের চাপের কারণে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। ৮ জানুয়ারি বিবিসিতে প্রচারিত হলো বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর। আর সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠল পুরো জাতি। সমগ্র বাঙালী জাতির প্রাণোচ্ছ্বলতায় ঝলমলে হয়ে উঠল স্বাধীনতার স্বর্ণ-সূর্য, লাল-সবুজের বিজয়পতাকা। পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধু লন্ডন-দিল্লী হয়ে ঢাকায় পৌঁছেন এর দু’দিনপরের রৌদ্র ঝলমলে দুপুরের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে। যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত দেশে অস্থির, অনিশ্চিত ও অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। চারদিকে ধ্বংস আর বিনাশের চিহ্ন। সর্বত্র হাহাকার, ক্রন্দন ধ্বনি। নেতৃত্ব সঙ্কটে অমানিশার অন্ধকারে সদ্য স্বাধীন দেশের সবাই দিশাহারা। চারদিকে নেই, নেই আর নেই। এমনতর পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যায়। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সেই সময়টায় এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিল যে, তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর এবং সেটার গুরুত্ব ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল দেশী-বিদেশী প্রায় সকল গণমাধ্যমে। কাব্য, মহাকাব্য রচিত হয়েছিল পত্রপত্রিকাগুলোতে। টাইম ম্যাগাজিন লিখেছিল, নয় জানুয়ারি দিনটি ছিল রবিবার। বাংলাদেশের সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যে সারাদেশ আনন্দ উল্লাসে উত্তাল। অধীর আগ্রহে সবাই অপেক্ষা করছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের। বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যেও লোকজন ছুটতে শুরু করেছে ঢাকার দিকে। ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয়তে লেখে, ‘বঙ্গবন্ধুর মুক্তি বাংলাদেশকে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছে।’ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় লেখা হয়, ‘আজ বহু প্রতীক্ষিত সেই শুভদিন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর আস্থা ও ভালবাসা, ত্যাগ-তিতিক্ষার স্বর্ণসিঁড়িতে হাঁটিয়া হাঁটিয়া স্বাধীন বাংলা ও বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুদীর্ঘ নয় মাস পরে আবার জননী বাংলার কোলে ফিরিয়া আসিতেছেন।’ দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, আজাদী থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব পত্রিকায় প্রধান প্রতিবেদনই ছিল বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে। আর অন্যদিকে প্রাণপ্রিয় নেতাকে বরণের জন্য, একনজর দেখার জন্য, তাঁর ধ্রুপদি বাণী শোনার জন্য ব্যাকুল আকাক্সক্ষা নিয়ে লাখ লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিল সেদিন রেসকোর্সের ময়দান, এয়ারপোর্ট রোড আর তেজগাঁও বিমানবন্দরে। ‘তোমার পথের প্রান্তে মনের মণিদীপ জ্বেলে রেখেছি’ এই সুর যেন বেজে চলছিল অপেক্ষমাণ সকল জনতার হৃদয়ের গহীনে। বঙ্গবন্ধুর জন্য মানুষের অন্তরে কী প্রগাঢ় ভালবাসা জমে উঠতে পারে, ওই দিনের জনসমাগমের ব্যাকুলতা-ব্যাগ্রতার সে দৃশ্য না দেখলে বোঝানো দুষ্কর। দুপুরের দিকে ঢাকার আকাশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট জেট চক্কর খেল। জাতির পিতা আকাশ থেকে তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিকে দেখতে চাওয়ায় পাইলট প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাংলার আকাশ তাঁকে ঘুরিয়ে দেখান। এরপর বিমানটি তেজগাঁ বিমানবন্দর স্পর্শ করে বিকেল ৩টার দিকে। একুশবার তোপধ্বনি আর লাখো মানুষের আনন্দোল্লাসের মধ্য দিয়ে জাতির পিতাকে বরণ করল তাঁর অতি প্রিয় মাতৃভূমি। বঙ্গবন্ধু যখন বিমান থেকে বের হয়ে এলেন, তখন তাঁকে দীর্ঘ কারাবাসের কারণে রোগাটে, ক্লান্ত কিন্তু আশ্চর্যরকম প্রাণবন্ত মনে হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানালেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিপরিষদ। হাত মেলালেন ভারত ও ভুটানের হাইকমিশনারদ্বয়, ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার, রাশিয়ার কনসাল জেনারেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ড ডি স্পিভাক এবং অন্যান্য দেশের কূটনীতিকরা। এরপর বঙ্গবন্ধু হেঁটে গেলেন ছোট একটি মঞ্চে। প্রাক্তন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টস ও মুক্তিবাহিনী তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করল। বিমানবন্দরে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখার কর্মসূচি ছিল, কিন্তু প্রবল ভিড়ের কারণে সেই কর্মসূচীটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু লাল-নীল রঙের একখানা খোলা ট্রাকে উঠে পড়েন। বাঙালী জাতির প্রাণোচ্ছ্বাস দেখে আবেগে আপ্লুুত তিনি রুমাল বের করে চোখ থেকে আনন্দাশ্রু“মুছতে লাগলেন। হাসলেন। খুব হালকা করে জনতার দিকে হাত নাড়তে লাগলেন। ট্রাকটি অতি ধীর ও শান্তভঙ্গিতে রমনা রেসকোর্স মাঠের সংবর্ধনা সভার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। তেজগাঁ থেকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের দূরত্ব খুব বেশি নয়। অথচ এই অল্প একটু পথ অতিক্রম করতেই লেগে গেল প্রায় ঘণ্টা দুয়েক। রাজপথজুড়েই জনতার ঢল। কেউ বাদ্যি বাজাচ্ছে। কেউ নাচছে। কেউ গান গাইছে। মুহুর্মুহু সেøাগান আর জনতার ছুড়ে দেয়া পুষ্পবৃষ্টিতে জাতির পিতার হাস্যোজ্জ্বল মুখটিই বলে দিচ্ছিল, তিনি পরিপূর্ণ তৃপ্ত এক মানুষ। বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ গঠনের কাজে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই মিত্রবাহিনীর সৈন্য প্রত্যাহার, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিকসহ সার্বিক পুনর্গঠন, শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, সংবিধান প্রণয়ন, জাতিসংঘের সদস্য লাভসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিশ্বের দরবারে দেশকে মাথা তুলে দাঁড়াবার পথ প্রশস্ত করেন। আর এসব কারণেই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল বাঙালীর জীবনে এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। অথচ এই নেতাকেই সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র সাড়ে তিন বছর পর। আর তা করেছিল পাকিস্তানপন্থী মেজর জিয়ার অঙ্গুলি হেলনে কয়েকটা নরাধম পাপিষ্ঠ। তারা চেয়েছিল জাতির পিতাকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে, বাঙালীর মনন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলে দেশকে পাকিস্তানের করতলগত করতে। কিন্তু ‘মোর লাগি করিও না শোক/আমার রয়েছে কর্ম/আমার রয়েছে বিশ্বলোক।’- কবিগুরুর এই কয়টি ছত্রের মতোই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কর্মের কারণে কেবল বাঙালীই নয়, সারাবিশ্বের মানুষের কাছে আজও অনুপ্রেরণা, শ্রদ্ধা-ভালবাসার এক নাম, থাকবেন চিরকাল অনির্বাণ। লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
×