ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এম. নজরুল ইসলাম

১০ জানুয়ারি স্বাধীনতা পূর্ণতার দিন

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

১০ জানুয়ারি স্বাধীনতা পূর্ণতার দিন

১০ জানুয়ারি। ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। ১৯৭২ সালের এই দিনটিতে সত্যি রোমাঞ্চ লেগেছিল বাংলাদেশের ‘দিকে দিকে, ঘাসে ঘাসে’। সে এক ‘মহাজšে§র লগ্নই’ ছিল বাঙালীর জন্য। সেদিন ভেঙে গিয়েছিল ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ’। বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীল ধারার প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়ে চূর্ণ হয়ে যায় এই উপমহাদেশের যুগ-যুগান্তরের চিন্তার অস্থিরতা ও মানসিক অচলায়তন। তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের মানুষ যেমন ফিরে পায় সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রেরণা, তেমনি তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালীর আশা ও আকাক্সক্ষার প্রতীক। একই সঙ্গে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অন্ধকারের শক্তির সর্বনাশের সূচনাও তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়ে। আজকের এই দিনে দেশে ফিরে আসেন বাঙালী জাতির পিতা, বাংলাদেশের মহান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালী ফিরে পায় নবজীবনের আশ্বাস। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের পরও বিলম্বিত হয় তাঁর মুক্তি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ ছিল। ভারত, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ, জাতিসংঘের মহাসচিব ও আন্তর্জাতিক আইনজীবী সমিতি পাকিস্তানের কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি জানালে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ৪ জানুয়ারি ১৯৭২ করাচীর এক জনসভায় জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ বিকেলে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে তাঁর ইচ্ছায় রাতে একটি চার্টার্ড বিমানে করে লন্ডনের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উক্ত বিমানটি ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সকাল সাড়ে ছয়টায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছে। বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ অফিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে হোটেল ক্ল্যারিজে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ঐ দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে লন্ডন থেকে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধু কথা বলেন বেগম মুজিবসহ বাড়িতে উপস্থিত সবার সঙ্গে। সেদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করেন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দুপুরে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমান ‘কমেট’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ওখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান, শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ, বৈদেশিক কূটনীতিকবৃন্দ ও হাজার হাজার জনতা বঙ্গবন্ধুকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জানান। অভ্যর্থনা পর্ব শেষে সেখানে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। তারপর দিল্লী থেকে ব্রিটিশ ‘কমেট’ রওনা দিয়ে বিকেল তিনটায় ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে সমবেত লাখ লাখ জনতা আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে। ওখানে বিমান থেকে অবতরণের সিঁড়ির মুখে কোনরকমে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ, ছাত্র, যুব, রাজনীতিকবৃন্দ। বিমানের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ ছাত্রনেতা এক এক করে বিমানে উঠে বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে তাঁকে মাল্যভূষিত করেন। ঐ সময় বঙ্গবন্ধুসহ সবাই ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন। বিমানবন্দর থেকে একটি ডজ ট্রাকে বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ড. কামাল হোসেন ও ছাত্রনেতাসহ পঁচিশজনের মতো ট্রাকের ওপর বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ছিলেন। লোকের প্রচ- ভিড়ে গাড়িটি অতি মন্থর গতিতে চলছিল। তখন চারদিকে হৃদয়ের গভীর থেকে জনতার আনন্দ ও উচ্ছ্বাস-উল্লাসের শুভাশীষ ধ্বনি ‘জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা’ শোনা যাচ্ছিল। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত এতটুকু রাস্তা যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বিকেল পৌনে পাঁচটায় বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে জনসভাস্থলে পৌঁছেন। বঙ্গবন্ধুর শুভাগমনের খবর শুনে সকাল থেকেই দলে দলে কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, ফেস্টুন ও ব্যানারসহ রেসকোর্স ময়দানে আসতে থাকে। দুপুরের মধ্যে লাখ লাখ জনতার সমাগমে রেসকোর্স ময়দান কানায় কানায় ভরে যায়। সভামঞ্চে উঠে তোফায়েল আহমেদ বললেন, ‘ভাইসব, বঙ্গবন্ধু মঞ্চের দিকে আসছেন।’ একটু পরেই বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন। পুরো রেসকোর্স ময়দান ভরা জনতা উত্তেজনায় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, সামনে তারা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখছেন। উত্তেজনায় উদ্বেল আনন্দধ্বনি ক্রমশই বেড়ে চলছিল। এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এই ময়দানে আমি আপনাদের বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাস স্বাধীনতার সংগ্রাম। আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতা জয় করে এনেছেন। আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই এই ঐক্য বজায় রাখুন। ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালীর প্রাণ থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে।’ এরপর বঙ্গবন্ধু ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আজ সোনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশ্রয়হারা। তারা নিঃসম্বল। আমি মানবতার খাতিরে বিশ্ববাসীর প্রতি বাংলাদেশের এই দুঃখী মানুষদের সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছি।’ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের জনসভা শেষে বিকেল সাড়ে ছয়টায় প্রথম ওঠেন ধানম-ির ১৮ নম্বর রোডের ২৬ নম্বর বাড়িতে। ঐ রাতেই সামনের বাড়ি অর্থাৎ ধানম-ির ১৮ নম্বর রোডস্থ ২৩ নম্বর দোতলা বাড়িটিতে ওঠেন। ৪ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর বেগম মুজিব এই বাড়িটি ভাড়া নেন। ধানম-ির ৩২ নম্বর রোডস্থ তাঁদের নিজের বাড়িটি পাকিস্তানী আর্মিরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করেছিল। বাড়িটি মেরামত করে বাসোপযোগী করতে প্রচুর টাকা ও সময় দরকার হবে এইসব বিষয় ভেবে বেগম মুজিব এ বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন। আগেই বঙ্গবন্ধুর বাবা-মা, ভাই-বোন ও তাঁদের সন্তানরা এবং তাঁর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন ঐ বাড়িতে এসে অপেক্ষা করছিলেন। সাড়ে ছয়টায় তিনি সেখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সবাই তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুও সারাক্ষণ কাঁদছিলেন। সে বাড়িতে তখন নতুন আর এক অতিথির আগমন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার ছেলে জয়। বঙ্গবন্ধু বাড়িতে ফিরলে যে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারির ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার রিপোর্টে সেই দৃশ্যের বর্ণনা আছে এভাবে, ‘বিশাল জনসভা শেষে ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে একটি গৃহে ঘটে বর্ণনাতীত এক আবেগপ্রবণ পুনর্মিলন। বন্ধুদের শুভেচ্ছাসূচক ফুলের পাপড়িতে শোভিত শেখ মুজিব তাঁর দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। ঘটনা এর চেয়েও এগিয়ে যায় যখন শেখ মুজিব তাঁর ৯০ বছরের পিতার পা স্পর্শ করে ৮০ বছরের মাকে বুকে জড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন।’ এরপর ঐ বাড়ির ড্রইং রুমে শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসেন। ঐ সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর তারার নেতৃত্বে সৈন্যরা এই বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেজর তারাকে ডেকে বললেন, ‘আমি এখন নিজের দেশে ফিরেছি। আমার দেশে আমার নিরাপত্তার জন্যে আপনাদের দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে আপনাদের লোকজন নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়েছেন। এখন তাঁদের বিশ্রামের প্রয়োজন। অতএব এখনই আপনি আপনাদের লোকজনদের এই বাড়ির ডিউটি থেকে প্রত্যাহার করে নিন।’ প্রথমে একটু আপত্তি করলেও বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় নির্দেশ মতো মেজর তৎক্ষণাৎ তাঁর বাহিনীর সৈন্যদের ঐ বাড়ি থেকে প্রত্যাহার করে নেন। এই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সবসময় জনগণ তাঁর প্রথম চাওয়া ও পাওয়া। ৯ মাস ১৬ দিন কারাবাস শেষে যেদিন দেশে ফিরলেন তিনি সেদিন প্রথম গেলেন জনগণের কাছে। প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ কি তাঁর মনে পড়েনি? মনে পড়েনি সন্তানদের কথা? বাড়িতে বৃদ্ধ পিতা, বৃদ্ধা মা। কাউকে কি মনে পড়েনি তাঁর? পড়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু জনগণের নেতা জনগণের কাছেই আগে ফিরেছেন। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এলেও এ দেশের কিছু মানুষের চক্রান্তে শেষ পর্যন্ত দেশের মাটিতেই জীবন দিতে হয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদের এই মহান নেতাকে। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর নীতি ও আদর্শ রয়ে গেছে। বাঙালী জাতি বহন করছে তাঁর উত্তরাধিকার। বহন করবে যতদিন বাংলাদেশ আছে, আছে বাঙালী জাতি, বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারও ততদিন থাকবে। আজ ১০ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের এই দিনে পূর্ণতা পেয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা। ইতিহাসের এই স্মরণীয় দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, জাতির জনকের যোগ্য কন্যা তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে অবিচল থাকবেন। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক [email protected]
×