ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কেবল শাস্তি দিয়ে...

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

কেবল শাস্তি  দিয়ে...

অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী অপরাধীকে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় ও যথোপযুক্ত শাস্তি দেয়া হয়। সাধারণত এটা দৃশ্যমান প্রতিফলন। এতে কি অপরাধ বোধ বা অপরাধের সংখ্যা কমে? সভ্যতার শুরু থেকেই দেখা যায় শাস্তি দিয়েও অপরাধ দমানো যায়নি, এখনও যাচ্ছে না। বরং অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। নতুন নতুন অপরাধ সৃষ্টি হচ্ছে। যা এক সময় চিন্তাও করা যেত না। আসলে পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি থেকে একব্যক্তি অপরাধ বা সহিংসপ্রবণ হয়ে ওঠে। এর জন্য দায়ী মূল্যবোধের অবক্ষয়। এই অবক্ষয়ের জন্যই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই অপরাধ দমনই নয়, একইসঙ্গে অপরাধের কারণ, ধরন-প্রকৃতি বিশ্লেষণ এবং অপরাধ সংঘটনের ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে হবে। সমাজ অপরাধমুক্ত করতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি বিকল্প উপায় খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনিও মনে করেন, কেবল শাস্তি দিয়ে অপরাধ দমন করা যাবে না। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি অপরাধ দমনের বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। সাইবার অপরাধ বলে নতুন একটি অপরাধেরও সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য অভিনব আইন তৈরি করা প্রয়োজন রয়েছে বলে তার অভিমত। বর্তমানে নতুন নতুন যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সেটিকে অপরাধতত্ত্ব হিসেবে ধরে নিয়ে এর বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। আইন প্রয়োগ বা বিচারের পাশাপাশি অপরাধের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো খুঁজে বের করার ওপর জোর দেন মন্ত্রী। সে জন্য দরকার বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা। অপরাধ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও বিচারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্রাইম এ্যান্ড জাস্টিস স্টাডিজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে এসব মন্তব্য এসেছে। আসলে পরিবার হচ্ছে শিক্ষার মূল কাঠামো। বর্তমানে বিত্ত-বৈভবের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পরিবার ও সমাজ থেকে শিক্ষা নেয়ার বিষয়টি আগে ছিল, তা অনেকটা কমে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্যবোধ তৈরি করত। কিন্তু এখন পরিবার-সমাজের যোগসূত্রগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় এবং শক্তিশালী করতে হবে। একে সমুন্নত করতে হবে। বিচ্ছিন্ন বন্ধন আবার জোড়া লাগাতে হবে। তাহলে সামাজিক অপরাধ অনেক কমে আসতে পারে। অপ্রিয় হলেও সত্য, যে মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির অভ্যুদয়, তার অনেকটাই বর্তমানে বিস্মৃতপ্রায়। ইতোমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও দেশে একাধিক জঙ্গী সংগঠন গড়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোও জঙ্গীদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। দেশে ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট অপরাধ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি জঙ্গী সংগঠন আইনত নিষিদ্ধ হলেও অনেকেই নামে-বেনামে অবৈধ কার্যক্রম ও তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ক’বছরে বেশ কয়েকজন ব্লগার হত্যা, আলেম ওলামা হত্যা, বিদেশীদের ওপর হামলা ও হত্যা, মন্দির-মসজিদ-গির্জা-প্যাগোডাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে বোমা হামলা ও নাশকতা, বিদেশী নাগরিক হত্যা, সর্বোপরি টার্গেট কিলিং- এসবই প্রায় অবাধে চালিয়ে যেতে পারছে একাধিক জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় কেউ কেউ ধরাও পড়ছে, বিচার হচ্ছে, শাস্তিও পাচ্ছে। কিন্তু এতে সমূলে নির্মূল করা যাচ্ছে না। আইনমন্ত্রী হয়ত এই বিষয়টি লক্ষ্য করেই অপরাধ দমনে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি বিকল্প উপায় খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য মানুষকে অপরাধীকে কষ্ট দেয়া নয়। অপরাধপ্রবণতা নিরুৎসাহিত এবং অপরাধীর সামনে ভয়ের মাধ্যমে বাধা সৃষ্টিই এর লক্ষ্য। যাতে একজনের শাস্তি দেখে অন্যরা সংশোধন হতে পারে। এর পাশাপাশি সর্বস্তরে ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তোলা- যা কেবল সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই সংশোধন সম্ভব। সে অবস্থায় অপরাধ দমনে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
×