ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এমপি লিটন হত্যার রহস্য নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন

কোন্ পরিচয়ে নির্বিঘ্নে এমপির ঘরে ঢুকল হত্যাকারী

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

কোন্ পরিচয়ে নির্বিঘ্নে এমপির ঘরে ঢুকল হত্যাকারী

নিজস্ব সংবাদদাতা, গাইবান্ধা, ৯ জানুয়ারি ॥ সুন্দরগঞ্জের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যার ঘটনায় রবিবার রাতে আরও ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে পুলিশ সূত্রে দু’জনার নাম জানা গেছে। তারা হলো-ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের কিশামত হলদিয়া গ্রামের মহর উদ্দিনের ছেলে সাজু মিয়া (৩৬), দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামের নিজাম উদ্দিনের ছেলে আশরাফুল আলম (৩৭)। বাকি তিনজনের নাম পুলিশ জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। এদিকে রোববার গ্রেফতারকৃত শ্রীপুর ইউনিয়নের উত্তর শ্রীপুর গ্রামের আব্দুল সাত্তার ম-লের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৫০) কে গাইবান্ধার অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সুন্দরগঞ্জ) বিচারক মইনুল হাসান ইউসুফের আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে শুনানি শেষে পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তার ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড আদেশে বিচারক রিমান্ডের আগে এবং রিমান্ডের পরে সিভিল সার্জন কর্তৃক ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দেন। সুন্দরগঞ্জের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও তারাপুর ইউপি চেয়ারম্যান নজরদারিতে ॥ সুন্দরগঞ্জ উপজেলার জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধী মামলার অন্যতম আসামি মাওলানা আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়া আজিজের ঘনিষ্ঠ সহযোগী তারাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নুরন্নবী প্রামাণিককে লিটন হত্যায় সন্দেহভাজন হিসেবে গোয়েন্দা নজরদাড়িতে রাখা হয়েছে। পুলিশের একটি বিশেষ সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। উল্লেখ্য, ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ১২টি ব্রিজ নির্মাণের অনুকূলে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্পের আওতাধীন এই ব্রিজগুলো নির্মাণ না করেই সমুদয় টাকা আত্মসাত করেন পিআইও নুরুন্নবী প্রামাণিক। এই তথ্য জানার পর এমপি লিটন ডিও লেটারের মাধ্যমে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পিআইও’র বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এ বিষয়টি নিয়ে এমপির সঙ্গে পিআইও’ সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে এবং সে এমপির উপর রুষ্ট হয়। যেহেতু নুরুন্নবী প্রামাণিকের বাড়ি সুন্দরগঞ্জের পার্শ্ববর্তী পীরগঞ্জ উপজেলায় এবং যেহেতু তার ঘনিষ্ঠ জামায়াত কানেকশন রয়েছে সুতরাং সেও এই কিলিং মিশনের পরিকল্পনাকারী এবং অর্থ যোগানদাতা হিসেবে সন্দেহভাজনদের তালিকায় রয়েছে। হত্যার রহস্য নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ॥ এমপি লিটন হত্যাকে কেন্দ্র করে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়লেও হত্যার দিনের অনেক রহস্যই যা সুন্দরগঞ্জের গোটা উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। সেই রহস্য বা খুনকে ঘিরে জনমনে উত্থিত যে প্রশ্নগুলোর এখনও কোন সুরাহা করতে পারেনি পুলিশ। সেগুলো হচ্ছে দুটি পালসার মোটরসাইকেলে এসে খুনীরা মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই একজন সরকারী দলের এমপির ঘরে নির্বিঘেœ ঢুকে তাকে গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে গেল। অথচ কেউ তাদের দেখল না বা চিনল না বা তাদের বাঁধাও দিল না। তার স্ত্রী, শ্যালক, গাড়ির ড্রাইভার, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, বাড়ির কেয়ারটেকার, কাজের লোক কেউ কিছুই জানে না বা চেনে না। কোন পরিচয়ে কিভাবে এতো নির্বিঘেœ একজন এমপির ঘরে ঢুকল, তাকে গুলি করল এবং মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে গেল কিলাররা। কেন বাড়িতে তার সার্বক্ষণিক বডিগার্ড হিসেবে যে ৫ জন দলীয় কর্মী তার কাছে থাকত তারা কেন সেদিন ছিল না। এমপি লিটনের ঢাকা যাওয়ার কর্মসূচী বাতিল হলো সে খবর কারা জানালো কিলারদের। হত্যার সময়টিতে এই যে সেদিন এমপি লিটনের বাড়িতে কোন লোকজন ছিল না এটা কি একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র নয়? তবে এমপি লিটন বা তার স্ত্রী, শ্যালক কি, কিলারদের চিনত বা জানত? গুলিতে আহত হওয়ার পর থেকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার সময় পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে লিটন কি কিলারদের সম্পর্কে তার স্ত্রী বা শ্যালককে কিছুই বলেননি? গাড়ির ড্রাইভার যে বলছে গাড়ি নিয়ে কিলারদের তাড়া করেছিল সে কি তাদের চিনতে পেরেছিল? এসব নানা প্রশ্ন এখন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সরেজমিনে সোমবার বামনডাঙ্গা এলাকায় গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। পরিচিত সাংবাদিকদের দেখে সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব প্রশ্ন তুলে ধরেন। লিটন বিরোধী দলীয় কট্টর গ্রুপ প্রসঙ্গ ॥ সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি কট্টর বিরোধী গ্রুপ সক্রিয় ছিল। শিশু শাহাদত হোসেন সৌরভকে গুলি করাকে কেন্দ্র করে এমপি লিটনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের, তার বন্দুক, রিভলবার বাজেয়াফত করাসহ যখন তিনি প্রচ- চাপের মধ্যে ছিল। তখন এই বিরোধী গ্রুপটি এমপি লিটনের বিরুদ্ধে লাগাতার বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন করে তাকে উৎখাত করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। সেই কট্টর বিরোধী গ্রুপের অনেক নেতাকর্মীদের সঙ্গে সেসময় থেকে শুরু করে এখনও জামায়াত-শিবিরের গোপনে যথেষ্ট সখ্যতা রয়েছে। তাদের ভূমিকা নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। তবে আশার কথা যে, এই কট্টর বিরোধী গ্রুপের স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্যতম নেতা সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আহসান হাবীব মাসুদকে পুলিশ গ্রেফতার করে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। আশা করা হচ্ছে তার কাছ থেকে এই হত্যাকা- সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে এবং সেক্ষেত্রে বিরোধী গ্রুপটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাই হত্যাকা-ে জড়িয়ে যেতে পারেন। বামনডাঙ্গা শহীদ লিটন মঞ্চের বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ ॥ সুন্দরগঞ্জে এমপি লিটনের এই মর্মান্তিক হত্যাকা- স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষসহ সর্বস্তরের মানুষকে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে। সেজন্য লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করতে সর্বস্তরের মানুষের সমন্বয়ে বামনডাঙ্গা রেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহীদ লিটন মঞ্চ। এই লিটন মঞ্চের উদ্যোগে সোমবার বামনডাঙ্গায় এমপি লিটনের হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সমেস উদ্দিন বাবু, মঞ্চের আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম রাসেল, যুগ্ম আহ্বায়ক আশিকুর রহমান শাওন, খালেদ দাফলাদার, ফয়সাল শাকিদার আরিফ প্রমুখ। বক্তারা অবিলম্বে প্রকৃত খুনীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। বামনডাঙ্গা বহুমুখী জনকল্যাণ সমিতির শোক সভা ॥ বামনডাঙ্গা বহুমুখী জনকল্যাণ সমিতির উদ্যোগে সংগঠন কার্যালয়ে এমপি লিটনের মৃত্যুতে এক শোক সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এসময় এই এলাকার সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশ নেয়।
×