ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আজ ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি। বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এক অনন্য দিন। স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী তথা বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের এদিনেই পাকিস্তানে দীর্ঘ কারাবাস শেষে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সদ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসেন বাঙালীর অবিসংবাদিত এই নেতা। স্বয়ং জাতির জনক তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা।’ ৯ মাসের সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়েই বাঙালীর বিজয় পূর্ণতা লাভ করে। জীবন্মৃত্যুর কঠিন চ্যালেঞ্জের ভয়ঙ্কর অধ্যায় পার হয়ে সারা জীবনের স্বপ্ন, সাধনা ও নেতৃত্বের ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মহান এ নেতার প্রত্যাবর্তনে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যও পূর্ণতা পায়। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার পর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। অপারেশন সার্চলাইট নামের এ অভিযানের শুরুতেই পাক হানাদাররা বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানম-ির বাসা থেকে বন্দী করে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। এ ঘোষণার মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই শুরু করারও ডাক দেন তিনি। গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করা হলেও তাঁর অনুপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নামেই পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালী যখন প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছে, বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সেলের পাশে তাঁর জন্য কবর পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু বাঙালীর স্বাধীনতা, মুক্তির প্রশ্নে ফাঁসির আসামি হয়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিচল, আপোসহীন। এদিকে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকেই রাষ্ট্রপতি করে গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে খ্যাত এ সরকারের নেতৃত্বে মরনপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালী জাতি। ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র সে যুদ্ধে বহু ত্যাগ আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতি বিজয়ের লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। স্বাধীনতাকামী জনতা দীর্ঘ নয় মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতেও বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও বাঙালী জাতির মনে ছিল না স্বস্তি, বিজয়ের আনন্দ। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী জাতির জনকের ভাগ্যে কী আছে- এ নিয়ে এ ভূখ-ের প্রতিটি মানুষ ছিল বিচলিত, আতঙ্কিত। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বিশ্ব নেতারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। পরাজিত পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বন্দীদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরাজিত পাকি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো নিজে বঙ্গবন্ধুকে বিমানে তুলে দেন অবনত মস্তকে। জাতির জনক পাকিস্তান থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোর রাতে। এদিন বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে পিআইয়ের একটি বিশেষ বিমানে তুলে দেয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তাঁরা পৌঁছান লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে। বেলা ১০টার পর থেকে তিনি কথা বলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দীন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে। ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিমানে পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন বঙ্গবন্ধু। লন্ডনে সাংবাদিকদের কাছে দেয়া এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হবার পর পাক কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করে। আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে মৃত্যুদ-ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর, আমার বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনও প্রকাশ করা হবে না। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর ফন্দী এঁটেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণের মতো এত উচ্চমূল্য, এত ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় জীবন ও দুর্ভোগ আর কোন দেশের মানুষকে ভোগ করতে হয়নি। বাংলাদেশে নির্মম হত্যাকা- ঘটানোর জন্য পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী দায়ী। হিটলার যদি আজ বেঁচে থাকত, বাংলাদেশের হত্যাকা-ে সেও লজ্জা পেত। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ লন্ডন থেকে রওনা হয়ে ১০ জানুয়ারি সকালেই বঙ্গবন্ধু নামেন দিল্লীতে। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, প্রধান নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। ১০ জানুয়ারি বিজয়ীর বেশে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসেন বাঙালীর নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লন্ডন-দিল্লী হয়ে তিনি ঢাকায় পৌঁছান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বিজয়ের মালা পরে। সেদিন বাংলাদেশে ছিল এক মহাউৎসবের আমেজ। বাঙালী জাতি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল কখন তাঁদের প্রিয় নেতা, স্বাধীন বাংলার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখবেন। পুরো দেশের মানুষই যেন জড়ো হয়েছিল ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায়। বিমানবন্দর থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত রাস্তা ছিল লোকেলোকারণ্য। অবশেষে বন্দীর নাগপাশ ছিন্ন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিজয়ের বেশে নামলেন বিমান থেকে। পা রাখলেন লাখো শহীদের রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। গোটা জাতি হর্ষধ্বনি দিয়ে তেজোদীপ্ত ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে তাঁদের অবিসংবাদিত প্রিয় নেতাকে স্বাগত জানায়। বিকেল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে ভাষণ দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। পরের দিন বিভিন্ন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে এভাবেই লেখা হয়- ‘স্বদেশের মাটি ছুঁয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতা শিশুর মতো আবেগে আকুল হলেন। আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা নামল তাঁর দু’চোখ বেয়ে। প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে বাংলার আকাশ বাতাস। জনগণ-মন-নন্দিত শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে তাঁর ঐতিহাসিক ধ্রুপদী বক্তৃতায় বলেন- ‘যে মাটিকে আমি এত ভালবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’ সশ্রদ্ধচিত্তে তিনি সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করেন এবং সবাইকে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ‘রক্ত দিয়ে হলেও আমি বাঙালী জাতির এই ভালবাসার ঋণ শোধ করে যাব’। কথা রেখেছেন জাতির পিতা। হিংস্র পাকহানাদাররাও যাঁর গায়ে আঁচড় দেয়ারও সাহস দেখাতে পারেনি, স্বাধীন দেশে বাঙালী নামক একশ্রেণীর কুলাঙ্গার-বিশ্বাসঘাতকের হাতেই তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালনে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন নিয়েছে বিস্তারিত কর্মসূচী। আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- ভোরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল সাতটায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন এবং বিকেল আড়াইটায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা। জনসভায় সভাপতিত্ব করবেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ ও তাদের সকল সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসংখ্য সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনে নিয়েছে বিস্তারিত কর্মসূচী। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভাসহ সব কর্মসূচী যথাযথভাবে পালনের জন্য দল ও সহযোগী-ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
×