ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই কর্মকর্তা ওএসডি ;###;দুই মন্ত্রণালয়ের রেষারেষি ও সমন্বয়হীনতা ;###;রহস্য উন্মোচনে আরও একটি কমিটি ;###;এনসিটিবি কর্মকর্তা এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের অযোগ্যতা ও অবহেলা

কেলেঙ্কারির নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

কেলেঙ্কারির নেপথ্যে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের অযোগ্যতা, অবহেলা, শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রেষারেষি এবং সমন্বয়হীনতার ফলেই ঘটেছে নতুন পাঠ্যপুস্তকের মহাকেলেঙ্কারি। ভুলেভরা পাঠ্যবইয়ের জন্য যেমন সারাসরি এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অভিযুক্ত তেমনি হেফাজতসহ উগ্রবাদীদের দাবি মেনে বিশ্বকবি রবীদ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ূন আজাদের মতো ব্যক্তিদের লেখা বাদ দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল পাঠ্যক্রম তৈরির জন্য দায়ী দুই মন্ত্রণলয়ের প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান। কারণ কোন লেখা বাদ দেয়া হবে তার অনুমোদন দিয়েছিল দুই মন্ত্রণলয়ের দুটি কমিটি। এদিকে ভুলেভরা পাঠ্যবইয়ের রহস্য উন্মোচনে তিন তিনটি কমিটির পর আরও কটি কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণায়। ওএসডি করা হয়েছে দুই কর্মকর্তাকে। পাঠ্যপুস্তকে ভুলত্রুটির জন্য প্রাথমিক তদন্তের প্রেক্ষিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রধান সম্পাদক প্রীতিশ কুমার সরকার ও উর্ধতন বিশেষজ্ঞ লানা হুমায়রা খানকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অধীনে প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকে ভুলত্রুটি নির্ণয় ও এসব ভুলত্রুটির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে যথাযথ সুপারিশ প্রদানের লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রুহী রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব মাহমুদুল ইসলাম এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক)। এ কমিটি আগামী ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবে। পাঠ্যবইয়ের ভুল চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে এনসিটিবির একটি কমিটির আজ প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়াসহ সংকট নিরসনের বিষয়ে আজ সকাল এগারোটায় সবিচালয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। জানা গেছে, সোমবার শিক্ষামন্ত্রী এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বইয়ের সকল ভুল ও সমস্যা চিহ্নিত করে তথ্য হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সমস্যার জন্য যেই দায়ী হবে কারও রক্ষা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এনসিটিবির উচ্চ পদে থাকা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে সোমবার পর্যন্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভুলেভরা বইগুলোর বিষয়ে কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। প্র্থামিকের প্রায় প্রতিটি বই কেলেঙ্কারির জন্ম দিলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত সংকট সমাধান কিংবা দায়ীদের চিহ্নিত করার বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। সাংবাদিকরা চেষ্টা করলেও কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে পাঠ্যবইয়ের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভুলেভরা পাঠ্যবইয়ের জন্য সারাসরি এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ও এ কাজের জন্য নিয়োগ পাওয়া বিশেষজ্ঞ, যারা কাজের জন্য সব ধরনের সুবিধা নিলেও কাজে অবহেলা করেছেন নয়ত ইচ্ছে করেই পাঠ্যবইকে বিকৃত করেছেন। একটি বইয়ের লেখা চূড়ান্ত হওয়ার আগে বেশ কয়েক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞের হাত হয়ে এলেও বইয়ে রয়েছে ভুলের ছড়াছড়ি। এমনও হয়েছে যে, যে কবিতা এক বছর আগে সঠিক ছিল এবার এসব ব্যক্তিদের বদৌলতে ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ে কুসুম কুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতা এতদিন বইয়ে ঠিকভাবে থাকলেও এবার বেশ কয়েটি লাইন বিকৃত করা হয়েছে। মূল কবিতায় আছে ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’। আর বইয়ে ছাপা কবিতায় লেখা হয়েছে ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে?’ এছাড়া ‘মানুষ হইতে হবে- এই তার পণ’ এর বদলে লেখা হয়েছে ‘মানুষ হতেই হবে’। বিকৃতি কেবল এটুকুই নয়, কবিতার চতুর্থ লাইনে কুসুম কুমারী লিখেছেন, ‘মানুষ হইতে হবে’- এই তার পণ। বিকৃত কবিতায় ‘হইতে’ শব্দটিকে ‘পা-িত্য’ দেখিয়ে ‘সম্পাদনা’ করে ‘হতেই’ লিখেছেন পাঠ্য রচয়িতারা। সোমবার এনসিটিবির কর্মকর্তা ও বইয়ের লেখক অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঠ্যপুস্তক নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে কমিটি করা হলেও তাতে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তাদের কয়েকজনকে নিয়ে চরম বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এনসিটিবি সদস্য কারিকুলামের (প্রাথমিক) এবং সদস্য কারিকুলাম (মাধ্যমিক) দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কর্মকা- বইয়ের চলমান সংকটের জন্য দায়ী। সঙ্গে আছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তিন অতিরিক্ত সচিব। এই কর্মকর্তারা সকলেই বিএনপি-জামায়াত জোটের আস্থাভাজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। এছাড়া এনসিটিবি সাহিত্য, কবিতায় ভুল চিহ্নিত করতে যে কমিটি করেছে তাতে প্রধান হিসেবে বিশেষজ্ঞদের না নিয়ে অর্থ বিভাগের সদস্যকে রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বইয়ের এ সমস্যা চিহ্নিত করতে এ ধরনের কমিটি গঠন করার বিষয়টিতে অনেকে বলছেন নামকাওয়াস্তে কমিটি করে দায় এড়াতে চায় এনসিটিবি। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন শিক্ষক, কর্মকর্তারা। এনসিটিবিতে থাকা চিহ্নিত সরকারবিরোধী কয়েক কর্মকর্তার বিষয়েও আপত্তি তুলেছেন শিক্ষা ক্যাডারের প্রগতিশীল শিক্ষক-কর্মকর্তারা। সোমবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে এনসটিবিতে গেলেও নাম প্রকাশ করে কেউ কথা বলতে সাহস দেখালেন না। এক কর্মকর্তা বলছিলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব ডেকে শাসিয়েছেন যেন কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলেন। সকলেই বলেন, চেয়ারম্যান স্যার ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না। এরপর চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহার কক্ষের বাইরে গিয়ে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মচারীদের কাছে সাংবাদিকরা ভিজিটিং কার্ড দেন। ভেতর থেকে কর্মচারী এসে জানান, ‘স্যার বলেছেন উনি ব্যস্ত আছেন, কথা বলবেন না।’ এরপর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা ইতোমধ্যেই চিহ্নিত করতে পেরেছেন যে ঘটনার জন্য কারা কারা দায়ী। কাদের ব্যর্থতার জন্য পাঠ্য বইয়ের এবারের কেলেঙ্কারি। এক কর্মকর্তা বলছিলেন, লুকানোর কিছু নেই। কার কি কাজ তা অর্গানোগ্রামেই আছে। কে কোন বই লিখেছে? কে কোন বই সম্পাদনা করেছে? কে কোন বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছে সব লেখা আছে। তালিকা দীর্ঘ হলেও বের করা কঠিন কাজ নয়। তবে সব কিছু দেখার কথা দুই কারিকুলাম সদস্যের। একজন প্রাথমিক ও অন্যজন মাধ্যমিকের দায়িত্বে আছেন। এদিকে বই ছাপার কাজসহ সকল পদক্ষেপেই দুই মন্ত্রণালয়ের রেষারেষি নিয়ে উদ্বিগ্নœ অনেকে। বইয়ের কাজের সঙ্গে জড়িত লেখক ও প্রশাসকরাও বলছেন, কোন পদক্ষেপ দ্রুত নেয়া যায় না কেবল দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতবিরোধের কারণে। মিডিয়ার কাভারেজের জন্য দুই মন্ত্রণালয়ের পাল্টা যেমন আছে তেমনি পাল্টা পাল্টি অবস্থানের জন্য কোন বিষয়ে ঐকমত্যও হয় না। এর ফলে বইয়ের যে কোন কাজে এক মন্ত্রণালয় এক অবস্থান নিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তার বিপরীতে অবস্থান নেন। এবার পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবসও আলাদা আলাদাভাবে আয়োজন করা হয়েছে রেষারেষির কারণেই কয়েক দিন আগে অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার দায়িত্ব নিয়েও শেষ পর্যায়ে প্রাথমিক মন্ত্রণালয় বলে বসে যে তারা এ পরীক্ষা নেবে না। অবস্থা সামাল দিতে শেষ পর্যায়ে এসে পরীক্ষা নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ অষ্টম শ্রেণীর দায়িত্ব ঠিকই নিয়েছে প্রাথমিক মন্ত্রণালয়। দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা দেখা গেল সোমবারও। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের পা-ুলিপি এত দেরিতে আসছে যে, তখন আর এগুলো পড়ে দেখার সময় ছিল না। পা-ুলিপি আসা মাত্রই প্রেসে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। কারণ ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পাঠ্যবই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হবে। ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উৎসব। এই ডেটলাইন ঠিক রাখার জন্যই তাড়াতাড়ি করে পাঠ্যবই ছাপাতে হয়েছে। তড়িঘড়ি করে পাঠ্যবই ছাপানোর কারণে কিছু ভুল থাকতে পারে। আমরা এখন এগুলো শুদ্ধ করার চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে কি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে ভুল শুদ্ধ করা হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমি বলেছিলাম, যৌথ আলোচনার মাধ্যমে একসঙ্গে বসে ভুলগুলো শুদ্ধ করি। কিন্তু মন্ত্রণালয়টি (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা) আগ্রহ দেখায়নি। মন্ত্রীর এমন প্রশ্নের জবাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এনসিটিবি হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান। তারা যা বলে এনসিটিবি তাই করে। এনসিটিবিতে প্রাথমিক শিক্ষার একটি উইং থাকলেও সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লোকজন কর্মরত। ফলে এনসিটিবিতে আমাদের লোকবল নেই। আমাদের লোকবল না থাকায় আমরা সেখানে কোন কাজই করতে পারি না। এক কথায় পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল। পা-ুলিপি পরে দেয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপানো হয় ন্যাশনাল টেন্ডারের মাধ্যমে। আর প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপানো হয় ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডারের মাধ্যমে। ফলে একটু সময় লাগেই। এটি বুঝতে হবে। তারমতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের খবরদারি এবং প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ের লোকবল এনসিটিবিতে না থাকার কারণেই প্রাথমিকের বইয়ে ভুল হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এনসিটিবির কর্মকর্তারা সোমবারও বলেছেন, কেবল আমাদের ওপর দায়িত্ব চাপালেই হবে না। কোন কাজ করা সহজ নয় দুই মন্ত্রণালয়ের রেষারেষি ও সমন্বয়হীনতার কারণে। কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিক হয়ে পড়েছে দুই মন্ত্রণায়ের কয়েক কর্মকর্তার কারণে। তবে এনসিটিবির কর্মকর্তরা নিজেরা ধোয়া তুলসীপাতা দাবি করলেও প্রকাশক ও শিক্ষকরা অভিযোগ করেছেন, আসলে বই ছাপার কাজে যারা আসছেন তারা কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন না। এখানে এসে কোনমতে সময় পার করেন নানা সুবিধা নিয়ে। প্রায় এক ডজন বোনাস আর গাড়িসহ নানা সুবিধা ভোগ করলেও ভাল মানের একটি পাঠ্যবই করার বিষয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। আছে ভাল মানের পাঠ্যবই তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কিছু উদ্যোগের অভাবও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলছিলেন, ভুলের বিষয়ে আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি যে, এনসিটিবিতে ল্যাংগুয়েজ এডিটর, প্রুফ রিডার দরকার। কিন্তু হয়নি। আমার মনে হয় বইয়ের এই কাজটা কখনই ঠিকভাবে হয় না। কারও কবিতা ইচ্ছে মতো লেখার ঘটনাকে হতাশাজনক ও শিক্ষার জন্য ভয়াবহ হিসেবে উল্লেখ করেন এ শিক্ষাবিদ। হেফাজতসহ উগ্রবাদীদের দাবি মেনে প্রতিক্রিয়াশীল পাঠ্যক্রম তৈরির অনুমোদন ছিল দুই মন্ত্রণালয়েরই। কোন লেখা বাদ দেয়া হবে- তার অনুমোদন দিয়েছিল দুই মন্ত্রণালয়ের দুটি কমিটি। এ বিষয়ে কথা বলতে এনসিটিবির সদস্য কারিকুলাম (প্রাথমিক) আবদুল মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের কথা বলা নিষেধ আছে। চেয়ারম্যান বা মন্ত্রণালয় কথা বলবেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এবারের পাঠ্যবইয়ের মলাটে কি কি সেøাগান ব্যবহার করা হবে তা এনসিটিবিকে ওপর থেকেই অনুমোদন করে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দু ধর্ম বইয়ের শেষ মলাটের সেøাগান ছিল-‘পরনিন্দা ভালো নয়’। কিন্তু পাঠ্যবই ছাপানোর পর দেখা গেছে-এই বইয়ের সেøাগানে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজীতে লেখা হয়েছে ‘ডু নট হার্ট এনিবডি’। মজার বিষয় হচ্ছে-প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অনুমোদিত এ সেøাগানটি কে বাদ দিল-তার নাম এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি, পাঠ্যবই থেকে বাদ দেয়া হয়েছে হিন্দু ও প্রগতিশীল লেখকদের অনেক রচনা। কেন এসব বাদ দেয়া হয়-তা নিয়ে কার্যত কেউ মুখ খুলছেন না। তবে অনেকেই বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এনসিটিবিতে অভিজ্ঞ কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেয়া হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের ভুল শোধরানো যাবে না। নতুবা গোড়ায় গলদই থেকে যাবে। শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপিয়ে দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এই প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এনসিটিবির নিয়োগ ও পদায়ন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই নিয়ন্ত্রণ করে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তা বছরের পর বছর এনসিটিবিতে প্রেষণে কাজ করছেন। তারা কেবল ঢাকায় থাকার জন্য তদ্বির করে এনসিটিবিতে পোস্টিং নিয়েছেন। পাঠ্যবইয়ের কারিকুলাম তৈরি, রচনা, মুদ্রণ বিষয়ের মতো টেকনিক্যাল কাজের সঙ্গে অতীতে তাদের কোন পরিচয়ই ছিল না। অনভিজ্ঞ এসব কর্মকর্তাই পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত এখন। এনসিটিবির ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, আগে এ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে পাঠ্যবই সংশ্লিষ্ট পূর্ব অভিজ্ঞতা আমলে নেয়া হতো। কিন্তু এখন আর সেটি হচ্ছে না। এ কারণে নির্ভুল পাঠ্যবই মুদ্রণের বিষয়টি বারবারই হোঁচট খাচ্ছে। সূত্রটির দাবি, একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট মূলত নেপথ্যে থেকে এনসিটিবিকে পরিচালনা করে। তারা সেখানে দুর্নীতির শক্তিশালী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। ফলে এনসিটিবির সকলের মূল নজর চলে গেছে পাঠ্যবই মুদ্রণের টেন্ডার, কাগজ ক্রয় আর বাণিজ্যিক খাতগুলোর দিকে। শিক্ষাক্রমের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থাকছে। যারা কাজ করেছেন তারাও অনেকটা দায়সারাভাবে দায়িত্ব সেরেছেন। জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, যাদের কাজ তাদের না দিয়ে অন্যদের দিয়ে কাজ করালে প্রাথমিকের বইয়ে ভুল থাকবেই। মূলত এনসিটিবিতে প্রাথমিক মন্ত্রণালয় তাদের কাজ করুক সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় চায়নি। অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল পাঠ্যক্রম তৈরির পেছনে কাজ করেছে দুই মন্ত্রণালয় কমিটি। কোন লেখা বাদ দেয়া হবে- তার অনুমোদন দিয়েছিল দুই মন্ত্রণালয়ের দুটি কমিটি। একটি কমিটি গত ১৬ সেপ্টেম্বর এক সভায় অনুমোদন দেয় কোন বইয়ে কোন কবিতা লেখা থাকবে? কোনটা বাদ যাবে। সে অনুসারেই ছাপা হয় বই। জানা গেছে, প্রাথমিকের কমিটিতে আছেন সচিব। আছেন ড. আবু হেনা মোঃ মোস্তফা কামাল (অতিরিক্ত মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর), প্রফেসর মোঃ এলিয়াছ হোসেন (পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর), প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র পাল (চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড), মোঃ ফাইজুল কবীর (যুগ্ম সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়), মোঃ আব্দুল ওয়াহাব, (উপ-পরিচালক, জাতীয় শিক্ষা একাডেমি), একেএম ছায়েফ উল্যা (চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড), প্রফেসর মোঃ আবদুল মান্নান (সদস্য, এনসিটিবি), সরদার মোঃ কেরামত আলী (উপ-সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়), মুহাম্মদ আবদুল জাব্বার (পরিচালক (অব.), নায়েম), সেলিনা হোসেন (সভাপতি, শিশু একাডেমি), প্রফেসর কফিল উদ্দিন আহাম্মদ (সাবেক চেয়ারম্যান, এনসিটিবি), ড. আলী আসগর (ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়), প্রফেসর ড. এম এ মান্নান (উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়), লানা হুমায়রা খান (উর্ধতন বিশেষজ্ঞ, এনসিটিবি), খ. মোঃ মঞ্জুরুল আলম (বিশেষজ্ঞ, এনসিটিবি), মোঃ মোস্তফা সাইফুল আলম (বিশেষজ্ঞ, এনসিটিবি), মুশীদ আকতার (গবেষণা কর্মকর্তা, এনসিটিবি), বাবুল আকতার (সংযুক্ত কর্মকর্তা, এনসিটিবি)। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটিতে সচিব সভাপতি। আছেন অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক), অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি) অতিরিক্ত সচিব (মাদ্রাসা), যুগ্ম সচিব (কলেজ), যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক-১), যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক-২), মাউসি অধিদফতরের মহাপরিচালক, নায়েমের মহাপরিচালক, কারিগরি অধিদফতরের মহাপরিচালক, মাদ্রাসা অধিদফতরের মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক, এনসিটিবির চেয়ারম্যান, ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান, কারিগরি বোর্ডের চেয়ারম্যান, মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান, এনসিটিবির সদস্য কারিকুলাম (মাধ্যমিক)। এছাড়া আছেন, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান, ড. সিদ্দিকুর রহমান, শাহীন কবির, অধ্যপক কায়কোবাদ, এনামুল হক এবং এসইএসইপি প্রকল্পের পরিচালক। নির্ভুল পাঠ্যবইয়ের দাবিতে আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন ॥ অবিলম্বে শিশুদের নির্ভুল পাঠ্যবই দেয়ার দাবিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ঘেরাও করবে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। সভাপতি লাকী আক্তার জানিয়েছেন, পাঠ্যবইয়ের লেখায় বিকৃতি, ভুল বানান, সাম্প্রদায়িকতা ও লৈঙ্গিক বৈষম্য বাদ দিয়ে অবিলম্বে এসব পরিমার্জন করে শিশুদের হাতে নির্ভুল পাঠ্যবই তুলে দিতে হবে। আর এই দাবিতে আগামী ১৫ জানুয়ারি এনসিটিবি ঘেরাও কর্মসূচী পালন করা হবে। লাকী আক্তার বলেন, পাঠ্যবইয়ে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি পাতায় পাতায় অসংখ্য বানান ভুল রয়েছে। সরকার টাকা দিয়ে বইয়ের প্রুফ দেখায়। তাহলে কেন এত বানান ভুল রয়েছে। এটা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্টদের অবহেলা। এই অবহেলার জন্য আমরা তাদের অপসারণ চাই। তিনি আরও বলেন, হেফাজত, ওলামালীগ, চরমোনাইসহ অন্যদের পরামর্শ নিয়ে বই পরিমার্জন কর হয়েছে। তার মানে সাম্প্রদায়িক যে বিষয় বইয়ে ঢুকেছে তা কোনও অনিচ্ছাকৃত ভুল নয়। এগুলো সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করে ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে। ফলে যা পরিবর্তন করা হয়েছে তা পুনরায় পরিমার্জন করা হোক।
×