ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণই বোঝা বাড়িয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৯ জানুয়ারি ২০১৭

রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণই বোঝা বাড়িয়েছে

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নির্যাতন পরিস্থিতি আপাতত শান্ত থাকলেও বাড়িঘর, স্বজন হারানোদের দুর্গতির শেষ নেই। বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার পর ওরা এখন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। সীমান্তের ওপার থেকে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য থেকে এসব জানা গেছে। সে দেশের একটি সীমান্ত চৌকিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলায় হতাহত ও অস্ত্রশস্ত্র লুটে নেয়ার ঘটনার পর গত অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে যৌথবাহিনীর অমানবিক নির্যাতনে কত রোহিঙ্গার প্রাণহানি ঘটেছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান সরকারীভাবে বলা হয়নি। তবে বেসরকারী পরিসংখ্যানে দু’শতাধিক। উক্ত পরিস্থিতিতে প্রাণ রক্ষার্থে সেখান থেকে অবৈধপথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৫০ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। একান্ত মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রতি সহনাভূতিশীল আচরণ করার নীতিতে রয়েছে। কিন্তু ইতোপূর্বে শরণার্থী হিসেবে এসে নিবন্ধিত এবং অবৈধভাবে আসা রোহিঙ্গারা যেখানে এ দেশের বোঝা ও উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে, সেখানে গত তিন মাসে আরও বিপুলসংখ্যকের আগমন যুক্ত হয়েছে নতুন বোঝায়। জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশসমূহের সকল আবেদন-নিবেদন উপেক্ষা করে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর যে বর্বরতম নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে তা বর্তমান সভ্য দুনিয়ার জন্য ন্যক্কারজনক রেকর্ডে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনার অবসান কখন হবে এবং আদৌ হবে কি-না সে পরিস্থিতির ইঙ্গিত এখনও মিলছে না। তবে মানবাধিকার প্রতিনিধিদের একটি দল এ মাসে বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পরিদর্শনের পাশাপাশি মালয়েশিয়ার আহ্বানে আগামী ১৯ জানুয়ারি সেখানে ওআইসির একটি জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকারের তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর সে দেশের সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেও সামান্যতম দুঃখ প্রকাশ তো দূরের কথা, উল্টো তাদের আগের অবস্থান থেকে এখনও সরে আসেনি। অর্থাৎ রোহিঙ্গারা যে সে দেশের নাগরিক তা তারা মানতে নারাজ। এখনও তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বাঙালী অভিবাসী বলে অভিহিত করে আসছে। এদিকে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) আবারও তৎপর হয়ে উঠছে। এদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম সীমান্ত এলাকার দু’দেশেই বিস্তৃত। মিয়ানমার সরকারের দাবি, আরএসও সন্ত্রাসীরাই তাদের সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালিয়ে ৯ পুলিশকে হত্যার পাশাপাশি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করেছে। এর পরই তাদের যৌথবাহিনী সন্ত্রাসী গ্রেফতারে অভিযান শুরু করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে নাফ নদী দু’দেশের স্থলসীমান্তকে বিভাজিত করেছে, সেই নাফ নদীর রূপ সকাল ও বিকেলে বদলে যায়। সাগরে জোয়ারের সময় এর প্রশস্ততা বৃদ্ধি পায় আর ভাটার সময় রূপ নেয় খালের। ওই সময়ে রোহিঙ্গা সদস্যরা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে হেঁটেই পেরিয়ে আসে বাংলাদেশে। এ কাজে রয়েছে দু’দেশেরই দালাল সিন্ডিকেট। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতোমধ্যে এ চক্রের মধ্যে ৫১ জনপ্রতিনিধিকেও চিহ্নিত করেছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও তা অদৃশ্য শক্তির কারণে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এদিকে, গত কয়েকদিনে উখিয়ার বালুখালী, রহমতের বিল, পালংখালী, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, জলপাইতলী, তুমব্রু, টেকনাফের হোয়াইকং, হ্নীলা, নাইটংপাড়া, কেরনতলী, জাদিমোড়া, লেদা, চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া ও শাহপরীর দ্বীপসংলগ্ন সীমান্তের একাধিক পয়েন্ট দিয়ে আরও বহুসংখ্যক রোহিঙ্গা অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। ইতোমধ্যে নতুন করে উখিয়ার বালুখালী পাহাড়ে রোহিঙ্গা বস্তি নির্মিত হচ্ছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, ১৩৪ কিলোমিটারজুড়ে সীমান্ত অঞ্চলে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর দফতর অনুমোদন দিলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। জেলা প্রশাসক জানান, রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ‘জিরো লেবেল’-এ নিয়ে আসার জন্য সরকারী সকল সংস্থা তৎপর। তবে বেসরকারী বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, বাস্তবতার সঙ্গে এর কোন মিল নেই। আর এ কথাও সত্য যে, এত দীর্ঘ সীমান্তের ইঞ্চি ইঞ্চি এলাকা পাহারায় রাখা এখনও সম্ভব হয়নি। এর ফলে দালাল চক্রের সদস্যরা ফাঁক-ফোকর দিয়ে কক্সবাজার অঞ্চলে ও বান্দরবানে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। তবে নাফ নদী দিয়ে নৌকাযোগে ইতোমধ্যে অসংখ্য নৌকাবোঝাই রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে আটকে দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি সদস্যরা। উল্লেখ্য, মিয়ানারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার পরিমাণ ২৭১ কিলোমিটার। এ এলাকার কিছু অংশে মিয়ানমার কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। কিন্তু এ কাঁটাতারের বেড়া কোন কাজে আসছে না। কেননা, সে দেশের সরকার রোহিঙ্গাদের সীমান্ত গলিয়ে এ দেশে চলে আসতে কোন বাধা দেয় না। অপরদিকে, টেকনাফ ও উখিয়ায় দুটি শরণাার্থী আশ্রয় ক্যাম্পে ইতোপূর্বে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আত্মীয়স্বজনরা যারা নতুন করে আসছে তারা সহজভাবে বসবাসের সুযোগ করে নিচ্ছে। শরণার্থী ক্যাম্প উখিয়া, কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩২ হাজার। এর পাশাপাশি দুটি বস্তি ও এর আশপাশে আরও তিন লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও ৫০ সহস্রাধিক। তবে এরা খুব দ্রুত কক্সবাজার ও বান্দরবান এলাকা ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকার সুযোগ করে নিচ্ছে। মানবিক কারণে এদের সহযোগিতার হাত সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও বাড়িয়েছে। কিন্তু পরোক্ষভাবে দেশের জন্য যে বোঝায় পরিণত হয়েছে সে বোঝা হ্রাস আদৌ সম্ভব হবে কি-না তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে।
×