ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আস্থার সঙ্কট ॥ মিয়ানমারের সঙ্গে বাড়ছে টানাপোড়েন

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৯ জানুয়ারি ২০১৭

রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আস্থার সঙ্কট ॥ মিয়ানমারের সঙ্গে বাড়ছে টানাপোড়েন

তৌহিদুর রহমান ॥ মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) নেত্রী আউং সান সুচি ক্ষমতায় আসার পরেও দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে প্রত্যাশিত সম্পর্ক তৈরি হয়নি। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখনও আস্থার সঙ্কট রয়েছে। প্রধানত রোহিঙ্গা সমস্যাই প্রতিবেশী দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর গত অক্টোবরের পর থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট তৈরির পর থেকে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন আরও বেড়েছে। ২০১৫ সালের নবেম্বরের নির্বাচনে সুচির দল এনএলডি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এরপর ঢাকা-নেপি ডো’র মধ্যে নতুন সম্পর্ক গড়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হিসেবে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক গত বছর জুনে মিয়ানমার সফর করেন। সফরকালে মিয়ানমারের এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচির কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠি পৌঁছে দেন পররাষ্ট্র সচিব। প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো বার্তার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন গতি আসবে বলে আশা করা হয়েছিল। ঢাকার পক্ষ থেকেই নেপিডোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ জোর দেয়া হয়। বাংলাদেশ আশা করেছিল সুচি ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের বিশেষ অগ্রগতি হবে। তবে সেটা হয়নি। রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলেছে। তবে গত বছর থেকে রোহিঙ্গা সমস্যার মধ্যে আটকে না থেকে বহুমুখী সম্পর্ক গড়তে উদ্যোগী হয়েছিল উভয় দেশ। বিশেষ করে এনএলডি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশই বহুমুখী সম্পর্ক গড়ার প্রত্যাশা করেছিল। এই লক্ষ্যে দুই দেশই সড়ক ও বিমান যোগাযোগ, ভিসা সহজীকরণ, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, ভ্রমণসুবিধা ইত্যাদি ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে আসছিল। তবে অক্টোবরের পর থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট তৈরি হওয়ায় দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় শরণার্থী সমস্যা দু’দেশের সম্পর্কের মধ্যে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া আড়াই বছর আগে বাংলাদেশে এসে মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে দুই হাজার ৪১৫ নাগরিককে ফিরিয়ে নেবে। তবে গত আড়াই বছর ধরে ইস্যুটি ঝুলে আছে। তারা কাউকে ফিরিয়ে নেয়নি। এরই মধ্যে গত অক্টোবর থেকে রাখাইন সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করে। ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। এ বিষয়ে দুইবার ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থানকে তলব করা হয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়। অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে নতুন করে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশের পর এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমর্থনও আদায় করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে চাপও দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক চাপের ফলে এখন সুচির পক্ষ থেকে ঢাকায় বিশেষ দূত পাঠানো হচ্ছে। আগামী ১১ জানুয়ারি ঢাকায় সুচির দূত আসবেন বলে জানা গেছে। বিশেষ দূত আসার পরে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কতটুকু ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ৫ লাখ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্র্থী অবস্থান করছে। তবে কেউ কেউ মনে করেন এই সংখ্যা অনেক। কক্সবাজার সীমান্তে কুতুপালং ও নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় ৩২ হাজার তালিকাভুক্ত শরণার্থী রয়েছে। অবশ্য জাতিসংঘের শরণার্থী পর্যবেক্ষণ বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসেবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা দুই লাখ। এর আগে ১৯৯১-২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফিরিয়ে নেয় মিয়ানমার। তারপর থেকে এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ঢাকায় অষ্টম পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর প্রতিশ্রুতি দেয় মিয়ানমার। সে অনুযায়ী দেশটি দুই হাজার ৪১৫ রোহিঙ্গা নাগরিককে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়। তবে এখনও তারা কোন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়নি। সূত্র জানায়, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এখনও প্রত্যাশিত সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তবে ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমারের সফরের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের মধ্যে নতুন অভিযাত্রা সূচিত হয়। এছাড়া ২০১৪ সালে ঢাকায় দেশ দুটির পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের অষ্টম বৈঠক হয়। সেখানে উভয় দেশই পারস্পরিক সহনশীলতা ও সদিচ্ছার মাধ্যমে সীমান্ত রক্ষা, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, আন্তঃসংযোগ, জ্বালানি নিরাপত্তা, বিসিআইএম ও বিমসটেকের উদ্যোগগুলোতেও একত্রে কাজ করার জন্য আলোচনা হয়। তবে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে কোনভাবেই যেন গতি পাচ্ছে না। এদিকে বর্তমানে দেশটিতে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার জন্য অনেক দেশই অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি করলে উভয়দেশের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সুফল বয়ে আনতে পারে বলে কূটনীতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
×