ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছাতক-ভোলানাথ রোপওয়ে ধ্বংসের পথে ॥ বিপুল পরিমাণ জমি বেদখল

রেলের সংরক্ষিত এলাকা থেকে শত কোটি টাকার পাথর লুট

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৯ জানুয়ারি ২০১৭

রেলের সংরক্ষিত এলাকা থেকে শত কোটি টাকার পাথর লুট

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ গত ২৫ বছরে ভোলাগঞ্জ রেলওয়ের সংরক্ষিত এলাকা থেকে শতকোটি টাকার পাথর লুটপাট হয়েছে। বেদখল হয়ে আছে রেলওয়ের বিপুল ভূমি। সংশ্লিষ্ট বিভাগের গাফিলতি, অব্যবস্থাপনা আর জনবলের অভাবে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম দৃষ্টিনন্দন ঐতিহ্যবাহী ছাতক-ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে লাইনটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে । যথাযথ উদ্যোগ ও সংস্কারের অভাবে ১৯ কিমি দীর্ঘ রোপওয়ে লাইনটি প্রায় দুই বছর ধরে বন্ধ। রোপওয়ে লাইন ছিঁড়ে ও ট্র্যাসেল পড়ে রোপওয়ে ব্যবস্থা এখন পুরোপুরি অচল হয়ে পড়েছে। ফলে পাথর সরবরাহ যেমন বন্ধ রয়েছে তেমনি অযতœ-অবহেলায় সরকারের কয়েক কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সারা দেশের রেললাইনে পাথরের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি এলাকায় ৩৫৯.৮৭ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। যেখান থেকে সংগৃহীত পাথর সারা দেশে সরবরাহের জন্য ১৯৬৫ সালে ছাতক-ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে লাইন স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ১১৯টি ট্র্যাসেলের ওপর ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রোপওয়ে লাইনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা ১৯৭০ সালে হলেও মুক্তিযুদ্ধের কারণে কিছুদিন বন্ধ ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ সাল থেকে এর কার্যক্রম আবার শুরু হয়। এ রোপওয়ে লাইন দিয়ে ভোলাগঞ্জ থেকে উন্নতমানের পাথর এনে প্রথমে ছাতকে রাখা হতো। পরে ছাতক থেকে সড়ক, রেল ও নৌপথে সরবরাহ করা হতো। জানা গেছে, সংস্কারের অভাবে রোপওয়ে লাইনটি এখনও অচল। লাইনটি সচলের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না উর্ধতন কর্তৃপক্ষ। পাথর পরিবহনের জন্য শুরুতে ৪২৫টি বাকেট থাকলেও ২৩৫টি বাকেট শেষ পর্যন্ত সচল ছিল। বর্তমানে অকেজো অবস্থায় ফেলে রাখা বাকেটগুলো চুরি হয়ে যাচ্ছে। ট্রাসেলগুলোও অনেক জায়গায় ভেঙ্গে গেছে। ফলে এগুলো চুরি করে নিয়ে বিক্রি করে ফেলা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা যায়, রোপওয়ে লাইনের অনেক ট্র্যাসেলের মাঝখানে তার ছিঁড়ে যাওয়ায় পাথর সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ৪৩নং ট্র্যাসেল ফাউন্ডেশনসহ উপড়ে পার্শ্ববর্তী হাওড়ের পানিতে পড়ে ল-ভ- হয়ে গেছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়া ট্র্যাসেল এলাকায় সতর্ক সঙ্কেত হিসেবে লাল পতাকা টানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। ভোলাগঞ্জ কোয়ারি এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলন করায় একটি ট্র্যাসেল প্রায় ৪৫ ডিগ্রী বাঁকা হয়ে পড়েছে। হাওড়ের পানিতে যত্রতত্র নিমজ্জিত, অর্ধনিমজ্জিত ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে আরও ৫০টি বাকেট। অরক্ষিত থাকার কারণে ট্র্যাসেলগুলোর সাপোর্ট এঙ্গেলও নিয়মিত চুরি হয়ে যাচ্ছে। ট্র্যাসেলগুলো ক্রমাগত দুর্বল হওয়ার কারণে গোটা রোপওয়ে ব্যবস্থা এখন হুমকির মুখে। রোপওয়ের এ বেহাল দশার কারণ জানতে চাইলে ছাতক রেলওয়ের প্রধান সহকারী সুরঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব ও জনবলের চরম ঘাটতির কারণেই রোপওয়ের এই বেহাল দশা। তিনি বলেন, পুরো রেলওয়ের নিয়োগকৃত চল্লিশ হাজার শ্রমিক ও কর্মকর্তার মধ্যে ছাতক রেলওয়ের জন্য ১৫৩ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার জন্য বরাদ্দ থাকলেও এখানে মাত্র ৫৮ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যারা বর্তমানে আছেন তাদেরও সময়ে সময়ে অন্যত্র বদলি করা হয়। নতুন নতুন কর্মকর্তা এখানে এসে অফিসের সবকিছু বুঝে উঠতে পারেন না। ফলে এখানে বিরাজ করছে চরম অব্যবস্থাপনা। বর্তমানে নিয়োগকৃত কর্মকর্তারা কিভাবে সময় পার করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনবলের অভাবে এখন পাথর সরবরাহ করা হচ্ছে না। রোপওয়ে লাইনটি সম্পূর্ণ বন্ধ। তাই বর্তমানে এখানে যারা কর্মরত তারা শুধু নিত্যদিনের অফিসিয়াল কাজকর্মই করে থাকেন। তিনি বলেন, এ রোপওয়ে লাইনটি বন্ধ থাকায় বর্তমানে জামালপুর থেকে দেশের রেললাইনগুলোতে পাথর সরবরাহ করা হয়। সিলেট-ভোলাগঞ্জ-ছাতক রোপওয়ে লাইনটি বাণিজ্যিকভাবে পাথর, চুনাপাথর সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা হলে সরকারের অনেক টাকা রাজস্ব আয় হতো। ভোলাগঞ্জ সীমান্ত পথ দিয়ে বর্তমানে ভারত থেকে চুনাপাথর আমদানি হয়ে থাকে। যে পাথর সড়কপথে দেশের বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করা হয়। রোপওয়ে ব্যবহার করে ছাতক থেকে নদীপথে দেশের বিভিন্নস্থানে এই পাথর সরবরাহ করা হলে পরিবহন খরচ অনেকটা কমে আসবে। সে সঙ্গে সচল থাকবে দেশের একমাত্র ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিনন্দন রোপওয়ে লাইনটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাতক রেলওয়েতে কর্তব্যরত এক ব্যক্তি জানান, এ রেলওয়েতে স্থায়ী কোন নির্বাহী প্রকৌশলী নেই। একজন আছেন অতিরিক্ত নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে। তিনি ঢাকা বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ এর মূল দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি সব সময় এখানে থাকেন না। তাই যারা কর্তব্যরত তারা আরও ঝিমিয়ে পড়েছে। কর্মকর্তারাও কেউ এখানে কাজ করতে চায় না। অফিস সূত্রে জানা যায়, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিতে রোপওয়ের অধিগ্রহণকৃত ভূমির মধ্যে ভাটরাই মৌজায় ২১৩.০৪ একর, কালাইরাগ মৌজায় ৩০.৫৪ একর ও কালাসাদক মৌজায় ৯৯.৮১ একরসহ ছাতক-ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত রোপওয়ের ট্র্যাসেল বরাবর আরও ১৬.৪৮ একরসহ মোট ৩৫৯.৮৭ একর। এসব জায়গা বর্তমানে পতিত অবস্থায়। রোপওয়ে লাইনের ভোলাগঞ্জ উর্ধতন উপসহকারী প্রকৌশলী মুকলেছুর রহমান বলেন, ভোলাগঞ্জ রোপওয়েতে যেখানে পাথর উত্তোলন করা হতো সেখানে মাত্র একজন কর্মকর্তা বর্তমানে কর্তব্যরত। তিনিও আগামী মার্চে অবসরে চলে যাবেন। সেখানে পাথর উত্তোলনে প্রায় ২০০ জনের মতো লোক কাজ করত। বর্তমানে সেখানে মাত্র ৫০-৬০ নিরাপত্তাকর্মী সেখানকার পতিত জমি দেখাশোনা করছে। ছাতক রেলওয়ের প্রধান সহকারী সুরঞ্জস পুরকায়স্থ বলেন, রোপওয়ে লাইনের মাধ্যমে ছাতক রেলওয়ের যেখানে পাথর রাখা হতো সেসব জায়গার বেশিরভাগই বর্তমানে প্রভাবশালীরা দখল করে আছে। বেশ কয়েক জায়গায় প্রভাবশালীরা বিল্ডিংও গড়ে তুলছে। উর্ধতন কর্মকর্তাদের গাফিলতির অভাবে এমনটা হচ্ছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক কর্মকর্তার অভিযোগ। রোপওয়ে লাইনের কাজ আবার শুরুর ব্যাপারে স্থানীয় কর্মকর্তাদের কিছুই জানা নেই। এ ব্যাপারে কর্মকর্তা বলেন, এটা উর্ধতন কর্তৃপক্ষ ভাল জানেন। তারা প্রতিমাসে আমাদের কাছ থেকে রোপওয়ে সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত জানতে চান। আমরা এগুলো সরবরাহ করি। সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ চাইলে এটা আবার শুরু করা সম্ভব। রোপওয়ে লাইন দিয়ে পাথর সরবরাহের ওপর নির্ভর করে এখানে হাজারও শ্রমিক-ব্যবসায়ী সংসার চালাত। সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে স্থাপনার ভূমি থেকে গত ২০ বছরে অবৈধভাবে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট শতকোটি টাকার পাথর লুটপাট করে নিয়েছে।
×