ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে হাইপারটেনশন রক্তে ফ্যাট আর ডায়াবেটিস ॥ গবেষণা রিপোর্ট

টিভি দেখাসহ ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনে চোখ, মুটিয়ে যাচ্ছে শিশু-কিশোর!

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৮ জানুয়ারি ২০১৭

টিভি দেখাসহ ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনে চোখ, মুটিয়ে যাচ্ছে শিশু-কিশোর!

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ সিনথিয়ার বয়স ১২ বছর। ঢাকার একটি স্বনামধন্য স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। ক্লাসে সে সবার চেয়ে মোটা, বাড়ন্ত শরীর। তার ওজন ৬০ কেজি। অল্প বয়সে এই মোটা শরীর নিয়ে তাকে মাঝেমধ্যেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। সিনথিয়ার এই স্থূল শরীরের জন্য তার বাবা-মাকেও সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। তার মায়ের কাছ থেকে জানা গেল, স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময় সে হয় টিভি দেখে নয়ত মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে ইন্টারনেটে গেম খেলে ও কার্টুন দেখে। সঙ্গে খাবার খাওয়ার অভ্যাসও আছে। শুধু সিনথিয়া নয়, সিনথিয়ার মতো বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিশু-কিশোর আজকাল ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনের সঙ্গে ওতপ্রোতভবে জড়িয়ে গেছে। এজন্য অল্প বয়সেই ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের (কানাডা) গবেষকরা জানান, অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখাসহ ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনে চোখ রাখার প্রভাবে শিশুরা মুটিয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা মারাত্মক রোগের শিকারও হচ্ছে। আজকাল বেশিরভাগ শিশু প্রতিদিনই খেলার মাঠ ছেড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেটে। ফলে শারীরিক দিক দিয়ে তারা দুর্বল হয়ে পড়ছে। গবেষকরা ১২-১৯ বছরের সাত হাজার ৯৮২ শিশুর ওপর গবেষণা চালান অতিমাত্রায় টেলিভিশন দেখার শারীরিক প্রভাব সম্পর্কে। ভিডিও গেম ও এ জাতীয় অন্যান্য গেম শিশুদের মস্তিষ্কের বিশেষ একটি অংশকে উত্তেজিত করছে। একনাগাড়ে টেলিভিশন দেখা এবং সঙ্গে বিভিন্ন রকম সুস্বাদু খাবার গ্রহণ অতিরিক্ত মেদের সৃষ্টি করে থাকে। দেখা যায়, অনুষ্ঠানের আকর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে মুখরোচক খাবারে আসক্তিও তৈরি হয়। আর এখান থেকেই শুরু হয় প্রাণঘাতী রোগের আক্রমণ। যেমনÑ রক্তে ফ্যাট, হাইপারটেনশন, হাইব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস প্রভৃতি। গবেষকরা বলছেন, কিশোর-কিশোরীরা যখন খেলাধুলা বা স্বাভাবিক অন্যান্য কর্মকা-ের বদলে ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনে অনেক বেশি সময় কাটায়, দৈনন্দিন জীবনযাপনের ধরনের কারণেই তাদের মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বেশি। যুক্তরাজ্যের একটি বার্ষিক জরিপ প্রতিবেদন বলছে, টিভির প্রতি শিশুদের আগ্রহ আগের মতো নেই। তারা এখন অনেক বেশি ঝুঁকছে ইন্টারনেটের দিকে। জরিপটি পরিচালনা করেছে যুক্তরাজ্যের চাইল্ডওয়াইজ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে শিশুদের টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতি আগ্রহ পরিবর্তনের ধরন যাচাই করতে প্রতিষ্ঠানটি এ জরিপ চালায়। সর্বশেষ ‘চাইল্ডওয়াইজ মনিটর রিপোর্ট ২০১৬’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত ইন্টারনেটই এখন টিভির জায়গা দখল করে নিচ্ছে। জরিপে অংশ নেয় ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী দুই হাজারের বেশি শিশু-কিশোর। দেখা গেছে, ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুরা প্রতিদিন গড়ে তিন ঘণ্টা সময় কাটাচ্ছে অনলাইনে। আর টিভি দেখছে গড়ে দুই ঘণ্টার বেশি সময়। ২০০০ সালে দৈনিক গড়ে তিন ঘণ্টা সময় টিভি দেখত তারা। আগের চেয়ে টিভি দেখা কমেছে গড়ে এক ঘণ্টা। ১৫-১৬ বছর বয়সী কিশোররা দৈনিক প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় অনলাইনে কাটাচ্ছে। আবার তাদের বই পড়ার অভ্যাসও অনেক কমেছে। ২০১২ সালে শিশু-কিশোররা যেখানে গড়ে দৈনিক এক ঘণ্টা বই পড়ে কাটাত, তা এখন আধা ঘণ্টায় নেমে এসেছে। চাইল্ডওয়াইজের গবেষণা পরিচালক সাইমন ল্যাগেটে বলেন, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় এ পরিবর্তন হয়েছে। ইন্টারনেটে নিজেদের পছন্দমতো অনুষ্ঠান বাছাই করে দেখার ব্যাপারেই তাদের বেশি আগ্রহ। গবেষণায় দেখা যায়, অনলাইনে শিশু-কিশোরদের বেশি সময় কাটে ইউটিউবে। শিশুরা মূলত বিভিন্ন গেম খেলা, ভিডিও দেখা ও গান শোনার জন্য ইন্টারনেটে প্রবেশ করে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আসাদুজ্জামান খান ও নিকোলা বার্টন ঢাকার আটটি স্কুলের ৭৫৮ শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছেন, যাদের ৫২ শতাংশ ছিল কিশোরী। তাদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ দিনে চার ঘণ্টারও বেশি সময় ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনে চোখ রেখে কাটায়। এই হার স্পেন (৩৫ শতাংশ) বা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে (১৬ শতাংশ) বেশি। তারা বিনোদনের জন্য ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিনে কতটা সময় কাটায় জরিপে তা জানতে চেয়েছিলেন গবেষকরা। সেই সঙ্গে তাদের অন্যান্য অভ্যাসের বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়, যেগুলো মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসম্পর্কিত বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। জরিপে অংশগ্রহণকারী কিশোর-কিশোরীদের ৭৯ শতাংশ বলেছে, তারা দিনে দুই ঘণ্টার বেশি সময় কোন না কোন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিনে চোখ রেখে পার করে। এ সংখ্যা অনেকে দেশের চেয়েই বেশি। ভারতে এ হার ৩১ শতাংশ, চীনে ৩৪ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৫৯ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ৬৩ শতাংশ ও মালয়েশিয়ায় ৬৮ শতাংশ। বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীরা প্রতিদিন গড়ে অন্তত চার ঘণ্টা সময় কাটায় ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের পর্দায়। এক্ষেত্রে ছেলেদের স্ক্রিন আসক্তি মেয়েদের তুলনায় বেশি। মেয়েরা যেখানে দিনে গড়ে ৩ দশমিক ৬ ঘণ্টা স্ক্রিনে চোখ রাখার কথা বলেছে, সেখানে ছেলেরা বলেছে ৪ দশমিক ৩ ঘণ্টার কথা। যারা স্ক্রিনে অনেক বেশি সময় কাটায়, তাদের জীবনযাপনের ধরনে আরও কিছু বিষয়ের যোগাযোগ দেখতে পেয়েছেন গবেষকরা।
×