ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিপিডির ব্রিফিং

প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, সুদ হার ও রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক অবস্থানে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৮ জানুয়ারি ২০১৭

প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, সুদ হার ও রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক অবস্থানে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, সুদ হার, ঘাটতি অর্থায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছে। তবে রাজস্ব আয় কাক্সিক্ষত হারে বৃদ্ধি না পাওয়ায় বছর শেষে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে প্রথাগত শক্তির তিনটি জায়গা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সরকার দারিদ্র্য দূরকরণ ও উন্নয়নে যে সব ব্যয় করছে সেখানে অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। এই পরিস্থিতি আর্থিক খাতে বেশকিছু সংস্কার জরুরী। কিন্তু নানা অনিয়মের কারণে খেলাপী ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাত ধুকছে। শনিবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মিডিয়া ব্রিফিংয়ের এসব তথ্য জানিয়েছে। রাজধানী মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৬-১৭ এর প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা শীর্ষক এ মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে সিপিডি। এতে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ব্রিফিংয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের অর্থনীতির প্রথাগত তিনটি শক্তির জায়গা দুর্বল হচ্ছে। এগুলো হলো রেমিটেন্স, রফতানি আয় ও কৃষি উৎপাদন। রেমিটেন্স ও রফতানি আয় কমছে। কৃষি উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি কমে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে এসেছে। তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ভাল হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে আরও উন্নতির জন্য সংস্কারের প্রয়োজন। কিন্ত সংস্কার বাস্তবায়ন দুর্বল পর্যায়ে রয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমাতে হবে, বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার সামঞ্জস্য করতে হবে এবং তেলের দাম কমাতে হবে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে সংস্কারে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা দরকার। সরকারের বিনিয়োগের গুণগত মান বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে যে অপচয় রয়েছে তা রোধ করতে হবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। এই তিনটি কাজের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা দরকার। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে বাড়ছে না। গত বছরে রাজস্ব আয়ে ৩৭ হাজার ৫৭ কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে। ৩৮ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হবে বলে আমরা বলেছিলাম। চলতি বছর শেষে রাজস্ব আয়ে ঘাটতি ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে ভ্যাট আইন কার্যকর জরুরী। মাঠ পর্যায়ে প্রস্তুতি শেষ হয়নি। ধীরে ধীরে ঘোষণা দিয়ে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে কথা বলেন তিনি। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিশ্ব বাজার সামনের বছরগুলোতে আরও খারাপ হতে পারে। রফতানি খাতের ওপর নির্ভরশীল না থেকে অভ্যন্তরীণ বাজার বাড়াতে হবে। ভারত-বাংলাদেশ ট্রানজিট সুবিধা ভারত কম মাশুলে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাচ্ছে। বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে এই মাশুল আরও ২ থেকে ৩ গুণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এতের সরকারের আয় বাড়বে। যেখানে কোর কমিটি প্রতি টনে ১ হাজার ২৪৫ টাকা মাশুল আদায়ে সুপারিশ করে সেখানে বাংলাদেশ পাচ্ছে মাত্র ১৯২ টাকা। এই ট্রানজিটের সুবিধার সমবণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা চলছে। বিনিয়োগের মন্দার কারণে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। সুদ হার কমলেও ঋণ বিতরণ বাড়ছে না। আবার কু ঋণ বাড়ছে। সুশাসনের অভাবে অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। ব্যাংকগুলোর মূলধনের পরিমাণ কমে আসছে। তাই নতুন মুদ্রানীতিতে ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেন, ব্যাংকিং খাত বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়ানোর অন্যতম নিয়ামক। কিন্তু এতে জাল-জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। আগের ঘটনার কোন বিচার না হওয়ায় পরবর্র্তীতে একই ঘটনা ঘটছে। ব্যাংকিং খাতকে পুনর্গঠনে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে স্থিতিশীল রেখেছে। কিন্তু সম্প্রতি ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের দাম ৪ থেকে ৫ টাকা কমবেশি রয়েছে। যার ফলে রেমিটেন্স হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। মূল প্রবন্ধে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ১০ টাকায় চাল কর্মসূচীতে তিন মাসে যেখানে প্রতি পরিবার ৯০ কেজি চাল পাওয়ার কথা সেখানে গড়ে ৭৯ কেজি চাল পেয়েছেন। প্রতি সুবিধাভোগী ১১ কেজি করে কম পেয়েছেন। নরসিংদীতে জরিপ চালিয়ে সিপিডি দেখেছে সেখানে গড়ে প্রতি পরিবার ৮২ কেজি করে চাল কিনতে পেরেছেন। কোন কোন পরিবার ১০০ কেজির বেশি চাল পেলেও কোন কোন পরিবার পেয়েছেন ৭০ থেকে ৮০ কেজি। গার্মেন্টস শ্রমিদের এই কর্মসূচীর আওতায় আনার দাবি জানায় সিপিডি। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, সামষ্টিক অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ এখন খেলাপী ঋণ। ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব ও মূলধন কমে যাওয়া। গত বছরে বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়লেও ব্যাংকিং খাতে বড় দুর্বলতা দেখা দেয়। এটিএম জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুরক্ষিত সুইফট সিস্টেম থেকে রিজার্ভ চুরি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম বেড়ে যাওয়ার কারণে মূলধন শূন্য হয়ে পড়ছে। ফলে গত বছর সরকার ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ভাল হওয়া, মূল্যস্ফীতি কম, সুদ হার কমছে, বৈদেশিক মুদার রিজার্ভ বাড়ছে, বাজেটের মানেজমেন্ট ও পুঁজিবাজারে গতিশীলতা আসছে। তবে বাজেট বাস্তবায়ন, এডিপি বাস্তবায়ন, বৈদেশী আয়-ব্যয়, বেসরকারী বিনিয়োগ ইত্যাদি খাতগুলো ভাল করলেও কাক্সিক্ষত হারে উন্নতি করতে পারেনি।
×