ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সরেজমিন গুলশান ডিএনসিসি মার্কেট;###;২৫ দোকান খুলেছে- তবে বিক্রির জন্য নয়, ধোয়ামোছা হচ্ছে

সর্বস্বান্ত ব্যবসায়ীরা এখন চারদিকে অন্ধকার দেখছেন

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৮ জানুয়ারি ২০১৭

সর্বস্বান্ত ব্যবসায়ীরা এখন চারদিকে অন্ধকার দেখছেন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ধসে পড়া গুলশানের ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন মার্কেটের ভবন সরানোর কাজ চলছে পুরোদমে। তিনটি বুলডোজার দিয়ে মার্কেটের পেছন দিক দিয়ে ইট, বালু, সিমেন্টসহ অন্যান্য আবর্জনা সরানোর কাজ চলছে। শনিবার পর্যন্ত ধসে পড়া মূল ভবনে হাতই দিতে পারেননি কর্মকর্তারা। ফায়ার সার্ভিসকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ভবনের ভেতরে পানি দিতে দেখা গেছে। তখনও আগুন জ্বলছিল। ধসে পড়া ভবনসহ সবকিছু সরাতে কমপক্ষে মাসখানেক সময় লাগবে বলে জানান সেখানে কর্মরতরা। একদিকে চলছে ধসে পড়া ভবন সরানোর কাজ, আরেকদিকে চলছে মাতম। চারদিকে দাঁড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ভবন সরানোর কাজ দেখছেন আর নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। অনেকেই হাউমাউ করে কাঁদছেন। আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে গুলশান থানায় শত শত সাধারণ ডায়েরি হচ্ছে। সাধারণ ডায়েরিতে ক্ষতিপূরণের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে। সরেজমিন এমন চিত্রই চোখে পড়েছে। গত ২ জানুয়ারি রাত দুটোর দিকে গুলশান-১ নম্বরে অবস্থিত ওই মার্কেটে আগুন লাগে। আগুনে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অধীন সাড়ে তিনতলা কাঁচাবাজার ধসে পড়ে। আগুনে পুড়ে যায় প্রায় চার শ’ দোকান। সরেজমিন দেখা গেছে, শনিবার বিকেল চারটা নাগাদও ধসে পড়া ভবনটির ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। পশ্চিম দিকে পাকা মার্কেট লাগোয়া একটি দোকান থেকে আবারও ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়। এ সময় ফায়ার সার্ভিস সেখানে প্রচুর পানি দেয়। কিন্তু তাতেও থামছিল না। পরে পেছন দিক থেকে সেখানে পানি দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সাড়ে তিনতলা কাঁচা মার্কেটটি ধসে পড়ে একতলার চেয়েও নিচু হয়ে গেছে। আর তার নিচে চাপা পড়ে আছে অসংখ্য মালামাল। ধসে পড়া ভবন আর সামনে থাকা ছয়তলা গুলশান শপিং কমপ্লেক্সের মধ্যে মাত্র ৬-৭ ফুট জায়গা রয়েছে। ওই জায়গায় ঢুকে বড় বুলডোজার দিয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালানো সম্ভব নয়। ছোট বুলডোজার দিয়ে উদ্ধারকাজ চালানো হলেও আবর্জনা রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এজন্য সামনের দিকে কোন উদ্ধার তৎপরতা চালানো হচ্ছে না। পেছন দিকে বড় তিনটি বুলডোজার দিয়ে ধসে পড়া ভবনের ইট, বালু, সিমেন্টসহ অন্যান্য মালামাল সরানোর কাজ চলছে। সরিয়ে ফেলা আবর্জনা দশ চাকার ট্রাক দিয়ে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। মার্কেটের পেছনের দিকে থাকা ১১ নম্বর সড়কটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মার্কেটের চারদিকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট কাজ করছে। এছাড়া মার্কেটের সামনে অবস্থান নিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। তারা চারদিকে দাঁড়িয়ে উদ্ধারকাজ দেখছেন আর চোখের জল ফেলছেন। কাউকে কাউকে হাউমাউ করে কাঁদতেও দেখা গেছে। মার্কেটের সামনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরিহিত মাথায় টুপি পরা একজন বিলাপ করে কাঁদছিলেন। বলছিলেন, আমাদের কী হবে? আমার পুরো পরিবার পথে বসে গেল। আমার ছেলেমেয়েদের আর লেখাপড়া হবে না। জানা গেল, তার নাম ইউসুফ আলী (৫৫)। বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল থানার নিজসরাইল গ্রামে। তিনি জানান, পেট চালানোর তাগিদে ১৯৮৩ সালের আগে কাঁচাবাজারের সামনে খাঁচিতে করে নানা ধরনের টুপি বিক্রি করতাম। এরশাদ সরকারের সময় তার নাম তালিকাভুক্ত হয়। পরে তার নামে একটি দোকানের জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়। পরবর্তীতে মার্কেট হওয়ার পর দোকানের জায়গায় ব্যবসা করার মতো টাকা ছিল না। তাই তিনি দোকানের জায়গাটি তার চাচাত ভাই রাজ্জাকের কাছে ভাড়া দেন। মাসিক ১২ হাজার টাকা ভাড়ায় রাজ্জাক দোকানটি করছিল। দোকান ভাড়া দিয়ে তিনি গ্রামে চলে যান। গ্রামে শুধু বাড়ির ভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। বড় মেয়ে ফারজানা বেগম এবার সরাইল পাইলট বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ছেলে জাহিদুল ইসলাম ফাহিম অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ছোট মেয়ে পান্নার বয়স পাঁচ বছর। সংসারের নির্ধারিত আয় বলতে দোকানের ভাড়ার ১২ হাজার টাকা। ওই টাকার পাশাপাশি তিনি যখন যে কাজ পান সে কাজই করেন। কোন সময় সবজি বিক্রি করেন। কোন সময় দিনমজুর হিসেবে কাজ করে কোনমতে সংসার চালান। দোকান পুড়ে যাওয়ায় পুরো পরিবার নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন। কারণ শীঘ্রই দোকানের আর ভাড়া পাচ্ছেন না। পরবর্তীতে সেখানে আদৌ দোকান থাকবে কি-না বা তার নামে দেয়া বরাদ্দ বাতিল হবে কি-না বা কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি বেশি টাকা দিয়ে তার দোকানটি ওই ব্যক্তির নামে বরাদ্দ করে নেবেন কি-না সে চিন্তায় তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে পুরো পরিবার নিয়ে দিশাহারা অবস্থা তার। বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন তিনি। তার মতো এমন অবস্থা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত দোকানি ও দোকান মালিকের। সরেজমিন দেখা গেছে, কাঁচাবাজারের আগুন দ্রুত পাশের পাকা মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ায় পাকা মার্কেটের শ’খানেক দোকান পুড়ে গেছে। বাকি ১৩৪টি দোকানের মধ্যে ৫০টি দোকান ছাড়া সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাকা মার্কেটের নিচতলার চেয়ে দোতলায় ক্ষতি হয়েছে বেশি। মার্কেটটির নিচতলায় থাকা আপন জুয়েলার্স ছাড়া দোতলায় থাকা সাতটি স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে কিছুই নেই। দোতলায় অবস্থিত আল মাদানী স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে কিছুই নেই। দোকানের শাটার থেকে শুরু করে সবকিছু গলে গেছে। দোকানের মালিক সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, অগ্নিকা-ের সময় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে কোন মানুষের পক্ষেই লুটপাট তো দূরের কথা, মার্কেটে প্রবেশ করাই কঠিন ছিল। আমি কয়েকবার ঢুকে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি। দোকানের শোকেসে থাকা সব স্বর্ণালঙ্কার গলে ছাই ও পানির সঙ্গে মিশে অন্যত্র চলে গেছে। শুধুমাত্র সিন্দুকের ভেতরে থাকা স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কার গলিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এছাড়া আর কিছুই নেই। আগুন আমাকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে। শুধু আমি নই, আমার মতো অবস্থা সবারই। আগুন লেগে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে তিনি সন্দেহ পোষণ করেন। বলেন, জীবনে এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে এত ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হতে দেখেননি। দোতলার একটি দোকানও খোলার মতো অবস্থা নেই। সব দোকান পুড়ে গেছে। দোকানে কয়েক ইঞ্চি কালি পড়ে আছে। নিচতলায় কাঁচাবাজার লাগোয়া শ’খানেক দোকান ছাড়া আর প্রায় সব দোকানই অক্ষত আছে। শুক্রবার থেকে শনিবার বিকেল চারটা নাগাদ টিএম ট্রেডার্স, শাইনপুকুর সিরামিকস, কেএম এন্টারপ্রাইজসহ অন্তত ২৫টি দোকান খুলেছে। তবে বিক্রির জন্য নয়, ধোয়া-মোছার জন্য। দোকান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ চলছে। কালিতে দোকানগুলোতে পুরো আস্তর পড়ে আছে। শনিবার ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি দ্রুততার সঙ্গে ধসে পড়া মার্কেটের আর্বজনা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাঁচাবাজারের সামনে থাকা ফাঁকা জায়গায় অস্থায়ীভাবে দোকান বসানোর ব্যবস্থা করছেন বলে আশ্বস্ত করেন। তবে কবে নাগাদ ব্যবসায়ীরা বসতে পারবেন তা মেয়র নিশ্চিত করেননি। কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান শের মোহাম্মদ বলেন, বিষয়টির সুরাহা করতে তারা চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি রবিবার বিকেল তিনটায় কাঁচাবাজারের সামনে তিনি আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। তিনি সার্বক্ষণিক সেখানে অবস্থান করে সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করছেন। তার পাশেই জমা পড়ে আছে শত শত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর সাধারণ ডায়েরি করার পূরণকৃত ফরম। ফরমগুলো গুলশান মডেল থানা পুলিশের তরফ থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। সাধারণ ডায়েরির পূরণকৃত ফরমের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত জিনিসপত্রের বিশাল ফিরিস্তিও তুলে ধরা হয়েছে আলাদা কাগজে। ফিরিস্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানে কমপক্ষে এক কোটি থেকে কয়েকটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। শের মোহাম্মদ বরাবরই দাবি করে আসছেন, ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে দুর্বলভাবে ভবনটি তৈরি করা হয়। দুর্বল অবকাঠামো আর গানপাউডার দিয়ে আগুন দেয়ার কারণে ভবনটি দ্রুত ধসে পড়েছে। এটি পরিকল্পিত নাশকতা। এমন নাশকতার সঙ্গে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কতিপয় কর্মকর্তা ও মেট্রো ডেভেলপার কোম্পানি জড়িত। আগুনে অন্তত হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আর বেকার হয়ে পড়েছেন অন্তত পনেরো হাজার ছোট-বড় ব্যবসায়ী। ফায়ার সার্ভিস বলছে, কাঁচাবাজারের ভবন অত্যন্ত দুর্বল ছিল। আগুন লাগার পর ভবন আরও দুর্বল হয়ে ধসে পড়ে। আর ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের গঠিত তদন্ত কমিটি বলছে, অগ্নিকা-ের ঘটনাটি নাশকতা কি-না তা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
×