ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ময়নাতদন্তকারী বলেছেন, গুলিতেই দুই জঙ্গী নিহত হয়েছে

মারজান ও সাদ্দামের সঙ্গে থাকা এক জঙ্গী পালিয়ে গেছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৮ জানুয়ারি ২০১৭

মারজান ও সাদ্দামের সঙ্গে থাকা এক জঙ্গী পালিয়ে গেছে

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত দুই জঙ্গী নুরুল ইসলাম মারজান ও সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে মোটরসাইকেলে থাকা আরও এক জঙ্গী পালিয়ে গেছে বলে পুলিশের দাবি। জঙ্গীরা মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় হামলার পরিকল্পনা করেছিল বলে শনিবার মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করেছে পুলিশ। গুলিতেই জঙ্গী মারজান ও সাদ্দাম নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার সকল তথ্য পাওয়া গেছে বলে পুলিশের দাবি। এখন ব্লগার হত্যাকা-ের মাস্টার মাইন্ড সেনা বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও রাজধানীর আশকোনার সূর্য ভিলা নামের জঙ্গী আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া মাঈনুদ্দিন ও মুসাকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজছে পুলিশ। পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় নব্য জেএমবির চার সদস্য বাংলাদেশে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করছে বলে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দাবি। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ সব খবর জানা গেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেছেন, পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত দুই জঙ্গী নুরুল ইসলাম মারজান ও সাদ্দাম হোসেনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তাদের শরীরে একাধিক গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। জঙ্গী সাদ্দামের শরীর থেকে তিনটি গুলি বের করা হয়েছে। দুই জঙ্গীর ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। তাদের ভিসেরা, রক্ত ও ইউরিন সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলোও পরীক্ষা করা হবে। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দুই জঙ্গীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। দুই জঙ্গীর লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই জঙ্গী নিহত হয়। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় জঙ্গীদের অন্যতম সমন্বয়ক ছিল বন্দুকযুদ্ধে নিহত মারজান। আর সাদ্দাম রংপুরের জাপানী নাগরিক হোশিও কুনিসহ উত্তরাঞ্চলে একাধিক জঙ্গী হামলা ও হত্যাকা-ে জড়িত ছিল। সে পাঁচটি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি এবং আরও পাঁচটি হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলারও আসামি। গত ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আজিমপুরে জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার হয় মারজানের স্ত্রী আরেফিন প্রিয়তি। প্রিয়তির সম্প্রতি একটি সন্তান জন্ম হয়েছে। কারাগারে আটক আছে নিহত মারজানের স্ত্রী প্রিয়তি। মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়ের ॥ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই জঙ্গী নুরুল ইসলাম মারজান ও সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় শনিবার মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। ঘটনার পর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে পুলিশ বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেছে। মামলার বাদী ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক নম্বর টিমের উপপরিদর্শক (এসআই) মোঃ আজগর আলী। মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বন্দুকযুদ্ধে নিহত দুই জঙ্গীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে আরও একজন জঙ্গী ছিলেন। পুলিশ বলছে, তাদের সঙ্গে গোলাগুলির সময় ওই জঙ্গী পালিয়ে যায়। জঙ্গীদের মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় হামলার পরিকল্পনা ছিল বলে পুলিশের দাবি। মামলার এজাহার পুলিশ বলেছে, নব্য জেএমবির কয়েক সদস্য নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশে মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় জঙ্গী হামলা করতে পারে। এমন আশঙ্কার মধ্যে ওই এলাকায় গিয়ে ছদ্মবেশে পুলিশ অবস্থান নেয়। এরই মধ্যে খবর আসে, মোটরসাইকেলে করে জঙ্গীরা ওই এলাকা রেকি করতে বের হয়েছে। পুলিশ রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পাশে চেকপোস্ট বসায়। এজাহারে আরও বলা হয়, গত বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক পৌনে তিনটার দিকে কালো রঙের মোটরসাইকেলে করে চালকসহ তিনজন আরোহী চেকপোস্টের কাছে আসে। পুলিশ তাদের থামতে বললে পুলিশকে লক্ষ্য করে হ্যান্ড গ্রেনেড ও গুলি ছোড়ে তারা। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। গোলাগুলির একপর্যায়ে মোটরসাইকেল আরোহী এক জঙ্গী পালিয়ে যায়। নিহত হয় দুই জঙ্গী মারজান ও সাদ্দাম। ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশী পিস্তল, একটি চাকু, দুটি গুলিভর্তি একটি ম্যাগাজিন, বিস্ফোরিত দুটি গ্রেনেডের অংশবিশেষ, রেজিস্ট্রেশন নম্বরবিহীন টিভিএস স্টার মোটরসাইকেল ও কালো রঙের হেলমেট উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ ॥ পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় নব্য জেএমবির চার সদস্য বাংলাদেশে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করছে বলে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দাবি। তারা দাবি করেছেন, বাংলাদেশী গোয়েন্দাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য মিলেছে। নব্য জেএমবি বা নিউ জেএমবির এ চার সদস্য পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয়। তারা ভারত থেকে অস্ত্র ও অর্থ বাংলাদেশের অপারেশনার ইউনিটগুলোকে সরবরাহ করছে। বাংলাদেশী গোয়েন্দারা তাদের এ ধরনের তথ্য দেয়ার কথা জানিয়েছেন। গোয়েন্দাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় এ চারজনের মধ্যে সোহেল মাহফুজ ভারতের পূর্বাঞ্চল নিউ জেএমবির নেতৃত্ব দিচ্ছে। এছাড়াও শরিফুল ইসলাম, মামুনুর রশিদ ও জুনায়েদ খান তার সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। গত বছরের ১ জুলাই গুলশান হামলার পর বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায় এ চার জঙ্গী। বন্দুকযুদ্ধে নিহত মারজানও জঙ্গী কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী মারজানের সঙ্গে ভারতে তার সহযোগীদের যোগাযোগ ছিল। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগ বলেছিল, গুলশান হামলায় ব্যবহৃত একে-২২ রাইফেলগুলো ভারত থেকে এনেছিল নব্য জেএমবির জঙ্গীরা। জিয়া ও মুসা কোথায়? বন্দুকযুদ্ধে মারজান ও সাদ্দাম নিহত হওয়ার পর এখন পুলিশ খুঁজছে ব্লগার হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ড সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও রাজধানীর আশকোনার সূর্য ভিলা জঙ্গী আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গী মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসাকে। এই দুই জঙ্গী নেতাকে ধরতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া মেজর জিয়ার সন্ধানে পুলিশ ও গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন মাঠে রয়েছে। পুলিশ বলছে, ২ আগস্ট চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ সদর দফতর। গত দুই বছরে বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট, লেখক-প্রকাশক, বিদেশী নাগরিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু হত্যার প্রেক্ষাপটে আলোচনায় আসে মেজর জিয়ার নাম। এছাড়া গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরে ঘটনার মূলহোতাদের মধ্যে মেজর জিয়া অন্যতম। আর আশকোনা জঙ্গী আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া মুসা রয়েছে জঙ্গীদের সুসাইডাল স্কোয়াডের নেতৃত্বে। তবে আশকোনায় অভিযানের পর থেকে ভয়ঙ্কর জঙ্গী মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসাকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজছে পুলিশ। মুসার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন আশকোনায় আত্মসমর্পণ করা নারী জঙ্গী জেবুন্নাহার শিলা ও তৃষা মনি। নারী জঙ্গীরা পুলিশকে জানিয়েছে, সুসাইডাল স্কোয়াডের পুরো তত্ত্বাবধানকারী হলো মুসা। রাজধানীতেই রয়েছে তার কয়েকটি জঙ্গী আস্তানা। এসব আস্তানা কোন কোন এলাকায় তা নিশ্চিত হলেও ঠিক কোন বাড়িতে তা নিশ্চিত হতে পারেনি গোয়েন্দারা। মুসা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে সে জন্য দেশের সবকটি সমুদ্র, বিমান এবং স্থলবন্দরে তার বিভিন্ন ধরনের ছবি-বায়োডাটাসহ নানা ধরনের তথ্য দেয়া হয়েছে। যা বলেন পুলিশের আইজি ॥ পুলিশের আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, গুলশান হামলার অন্যতম হোতা নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান এবং জঙ্গী সাদ্দাম হোসেন নিহত হওয়ায় তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে না। শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব নবাব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষে এই দুই জঙ্গী নিহত হওয়ার বিষয়ে আইজিপির প্রতিক্রিয়া জানতে চান সাংবাদিকরা। আইজিপি বলেন, নুরুল ইসলাম মারজান গুলশান হামলার মাস্টার মাইন্ডদের একজন ছিল। একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গী ছিল। সে ছিল অপারেশন কমান্ডার। আরেকজন জঙ্গী সাদ্দাম, সেও দুর্ধর্ষ জঙ্গী ছিল, নর্থবেঙ্গলে যত ঘটনা ঘটেছে তার সবটাতেই নাম এসেছে। তার নামে পাঁচটি মামলার চার্জশীট চলছে এবং পাঁচটি মামলার তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, এই দুইজন নিহত হওয়ার পর গুলশান হামলার ঘটনার সঙ্গে যেহেতু তাদের সম্পৃক্ততা ছিল তাই অবশ্যই গুলশান হামলার তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। দুই জঙ্গী নিহত হওয়ায় মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন- ‘হবে না। কারণ আমাদের কাছে সব তথ্য আছে। মারজান এবং সাদ্দাম কিভাবে আসল, যা যা ঘটিয়েছে পুরো তথ্য আমাদের কাছে আছে। মামলার তদন্তে আর কোন তথ্যের প্রয়োজন নেই। এখন আমরা চার্জশীট তৈরি করব। আইজিপি বলেন, জঙ্গীদের টাকা দেশ ও বিদেশ থেকে আসত। সরাসরিও টাকা আসে, আবার বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের টাকা আসে। তারা হচ্ছে হাইলি মোটিভেটেড জঙ্গী। তারা যখন যেখানে যায় চার-পাঁচজনকে দলে ভেড়াতে পারে। তবে তাদের রিহ্যাবিলিটেশনের সুযোগ তৈরি করতে হবে, যাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। আইজিপি বলেন, ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম। কিন্তু কিছু তরুণ ডিমোটিভেটেড হচ্ছে, কিছু সোশাল মিডিয়ার প্রপাগান্ডার মাধ্যমে। প্রত্যেকটি পরিবারের সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। আইজিপি জঙ্গীবাদ দমনে জনগণের সহায়তা চেয়ে তিনি বলেন, শুধু পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়, আপনাদের সহায়তা প্রয়োজন আছে। আপনাদের আশপাশে জঙ্গী সম্পৃক্ত কোন তথ্য থাকলে পুলিশকে জানান, সহায়তা করুন।
×