ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট করে দেখার সুযোগ নেই যে ঘটনা

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৮ জানুয়ারি ২০১৭

ছোট করে দেখার সুযোগ নেই যে ঘটনা

পৃথিবী বদলাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ। চিন্তাধারায়ও এসেছে বৈচিত্র্য। কখনও মানুষের ভাবনাগুলো আমাদের আশান্বিত করছে, আবার কখনও করছে আশাহত। আর এর মাঝে কখনও তৈরি হচ্ছে অজানা আশঙ্কা, কখনওবা আতঙ্ক। তবে আতঙ্ক থাকলেও তা হয়ত সাময়িকভাবে আমাদের আলোড়িত করছে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক দুটো ঘটনার কথা বলছি। ঘটনাগুলো ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আসলে বিষয়টি এ কারণেই বলা হচ্ছে যে, অনেক বড় ঘটনাকে আজ ছোট করে দেখার বা দেখানোর একটা প্রবণতা সমাজে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের ভাবনা বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ ধরনের নজির আমাদের সমাজ ও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে অতীতেও ঘটতে দেখেছি। হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট জানোস এডারের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুদাপেস্ট পানি সম্মেলন-২০১৬-এ যোগদানের উদ্দেশ্যে বিমানের ভিভিআইপি ফ্লাইটে যাত্রা শুরু করলে মধ্য আকাশে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, আধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত বোয়িং ৭৭৭-ইআর ৩০০ ফ্লাইটটি পাকিস্তানের আকাশসীমা অতিক্রম করার সময় বিমানের মনিটরে বামদিকের অয়েল ট্যাঙ্কে তেলের পরিমাণে অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে মনিটরে লো অয়েল প্রেসার সঙ্কেতটি সতর্কবার্তা দিতে থাকে। এক্ষেত্রে এ ধরনের বিমানে এই সতর্কবার্তা পাওয়া গেলে জরুরীভিত্তিতে ইঞ্জিনটি বন্ধ করে দিতে হয় ও দ্রুত নিকটবর্তী বিমানবন্দরে অবতরণ করতে হয়। একটি ইঞ্জিন বন্ধ করার পর অপর ইঞ্জিনের সাহায্যেই বিমানটি আকাশে উড্ডয়ন করতে পারে। কিন্তু ফুয়েল সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকলে ইঞ্জিন দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে মুহূর্তে অগ্নিকা- ঘটতে পারে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে তা হলো ইঞ্জিনের নাট-বল্টু সঠিকভাবে লাগানো ছিল না। পরবর্তী সময়ে তুর্কমেনিস্তানের আশগাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানটি জরুরী অবতরণ করে। এক্ষেত্রে কোন ধরনের বির্পযয় ঘটলে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা সঙ্কটের মুখে পড়ত। যে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তা ব্যর্থ হয়ে যেত। সঙ্কটের আবর্তে নিপতিত হতো বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন- এটি ছিল মানবসৃষ্ট ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ। এখানেই সতর্কতা, দায়িত্বশীলতা ও প্রকৃত বিশ্বস্ততার বিষয়টি মুখ্য হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ দায়িত্বশীল যে ব্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য অন্য কোন গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজন আছে কিনা। কেননা শষ্যের ভেতরই ভূত থাকে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে গোয়েন্দার ওপর গোয়েন্দা- এই নীতি অবলম্বন করলে কতটুকু সফলতা পাওয়া যাবে তা বলা সম্ভব নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ঘটে যাওয়া পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাকা-ের ঘটনার পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এ হামলায় ২৪ জন নিহত এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ জন আহত হয়। এই হামলায় নিহত হন প্রাক্তন রাষ্টপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী মিসেস আইভী রহমান। এই গ্রেনেড হামলার মূল হোতাদের আড়ালে রেখে জজ মিয়া নাটকের অবতারণা করা হয়। যা ছিল শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো ঘটনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উল্লেখ করেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এবার নিয়ে মোট ২০ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ঘটনায় কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় আনা হলেও পেছনের বড় শক্তিকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এখানে যেমন দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র থাকতে পারে তেমনি প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে যারা রয়েছেন তাদেরও তদন্তের আওতায় আনা উচিত। কেননা ব্যক্তির চেয়ে দল বড় এবং দলের চেয়ে দেশ বড়। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ একে অন্যের পরিপূরক। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অত্যন্ত সুকৌশলে খন্দকার মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মীর জাফরের মতোই খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মদদদাতা হিসেবে কাজ করেন। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার দুজন বিশ্বস্ত দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিংয়ের গুলিতে নিহত হন। কাজেই কাউকে সন্দেহের বাইরে রাখা ঠিক হবে না। কেননা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তার বিষয়টি সবকিছুর উর্ধে। এই ঘটনার পরপরই রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের ভিভিআইপি ফ্লাইটে আরেকটি ষড়যন্ত্রের অপচেষ্টা চালানো হয়। কেমিক্যালযুক্ত পানি দিয়ে এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিনের বেড পরিষ্কারের সময় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে ধরা পড়েন বিমানের এক জুনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার। শেষ মুহূর্তের তৎপরতায় সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরত আসার সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পান রাষ্ট্রপতি। এই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কেও ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে বর্তমানে বিমান কর্তৃপক্ষ অতি গোপনে বিষয়টি তদন্ত শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠেছে কাদের স্বার্থে এরকম একটি ষড়যন্ত্রকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন এম মোসাদ্দিক আহমেদ বলেছেন, ‘এটা এত বড় ঘটনা নয়। ওই ফ্লাইট পরিষ্কারের জন্য যে পাত্রে পানি নেয়া হচ্ছিল তাতে কেরোসিনের গন্ধ ছিল। তখন বিমানের লোকজনই তাতে বাধা প্রদান করেন। এ সময় এসএসএফ তাকে আটক করে। পরে তাকে বিমানের কাছেই সোপর্দ করা হয়। এ ঘটনায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়েছে।’ তবে এটা যদি ভুল বা গাফিলতিবশত হয়ে থাকে তাহলেও এর দায় বিমান এড়াতে পারবে না। এটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মূল বিষয় হচ্ছে ঘটনার পেছনের ঘটনা, ষড়যন্ত্রকারীদের পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র, জঙ্গীবাদ ও যারা ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’ এই নীতি নিয়ে চলছে তাদের নেপথ্যের মুখোশ উন্মোচন করা প্রয়োজন। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে উগ্রবাদীদের যে পদচারণা তা বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে শয়তানবেশী সাধুদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। নিরাপত্তার সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট রয়েছেন তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে। সময় বলছে আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সকল মানুষের আশা-ভরসার একমাত্র আশ্রয়স্থল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জনগণের শক্তিশালী বলয় ও স্বাধীনতার চেতনাই হতে পারে নিরাপত্তার মূল ভিত্তি। আর প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার বিষয়ে কোন ধরনের আপোস নয়। ॥ দুই ॥ বর্তমানে আরও একটি আলোচিত বিষয় হচ্ছে জঙ্গীবাদের সঙ্গে নারী সংশ্লিষ্টতা। বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। কেননা কোন মমতাময়ী মা তার সন্তানকে জঙ্গীবাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো প্রমাণ করছে জঙ্গীবাদে জড়িত মায়েরা তার সন্তানদের পরোক্ষভাবে হত্যা করছে। কেননা জঙ্গীবাদীদের যেমন কোন ধর্ম নেই, তেমনি তাদের কাছে পারিবারিক সম্পর্কের কোন মূল্য নেই। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক তাদের মেয়ে শিশুদের ঘরে আটকে রেখে শিক্ষার ব্যবস্থা করছেন। তাদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শিশুরা বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না। ফলে এই শিশুরা যখন পরিণত নারীতে রূপান্তরিত হচ্ছে তখন তাদের মধ্যে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব তৈরি হচ্ছে। আবার এই নারীকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে একজন সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে। ফলে পুরুষশাসিত সমাজে এই নারীরা নিপীড়িত হয়ে অনেকটা স্বামীর চাপেই জঙ্গীতে পরিণত হচ্ছে। তাদের কাছে স্বামীই হচ্ছেন দেবতা। আর তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত।’ সামাজিক রক্ষণশীলতা ও অমানবিক এই মূল্যবোধ নারী জঙ্গীবাদের একটি প্রধান কারণ বলে বিবেচনা করা যায়। সময় চায় পরিবর্তন। চায় উন্নত চিন্তাধারা ও সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গী। আর উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক মূল্যবোধই হতে পারে এ সমস্যার একমাত্র সমাধান। লেখক : বিভাগীয় প্রধান, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, ডুয়েট, গাজীপুর
×