ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৮ জানুয়ারি ২০১৭

সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা

বাস্তবিক যে, বাঙালী এখনও ইতিহাসবিমুখ। ‘বাঙালীর ইতিহাস নাই’ বলে এককালে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামানো বা ভাবনাচিন্তা বাঙালীর স্বভাবজাত নয়। আর সে কারণেই জাতির সবচেয়ে গৌরবের অংশ মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ইতিহাসের প্রতি বাঙালীর অনাগ্রহ। সুতরাং ইতিহাসের বিকৃতি ঘটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হতে পেরেছে। ইতিহাস থেকে যেহেতু শিক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে বাঙালী পশ্চাৎপদ অবস্থানে, তাই ইতিহাসমুখী হওয়ার প্রবণতাও ক্ষীণ। এমনিতেই বাঙালীর ইতিহাস চর্চা নামমাত্র। তাই অসাম্প্রদায়িক ও গণমুখী ইতিহাস চর্চার ধারাও অতি ক্ষীণ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে জাতীয় ইতিহাস পাঠকে অবশ্য পাঠ্য না করাও এর অন্যতম একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত। দেশে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেও ইতিহাস পাঠ নামমাত্র, চর্চা দূরে থাক। সঠিক ইতিহাস না পড়ানো এবং তা চর্চা না করার কারণে বাঙালী জাতির গৌরবের ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম তাই অবহিত নয় তার দেশ, জাতি ও সমাজের ঐতিহাসিক অবদানসমূহ সম্পর্কে। বাংলাদেশের ইতিহাসকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। ইতিহাসকে যোগ্য জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। তাই গৌরবের চিহ্নগুলো মুছে যাচ্ছে। সামনে আসছে অগৌরবের ইতিহাস। ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। যে কারণে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সাধারণ ইতিহাসের বিকল্প হিসেবে ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী শিক্ষাকে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অনেক আন্দোলন সংগ্রামের পর সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর স্নাতক পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ইতিহাস পাঠের বালাই নেই। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারী দল অনেক ইতিহাসের স্রষ্টা হলেও সেসব ইতিহাস রক্ষা, চর্চা বা গবেষণার কাজটিতে ন্যূনতম আগ্রহী নয়। যে কারণে স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস অদ্যাবধি রচিত হয়নি। তথ্য ও গবেষণাসমৃদ্ধ কোন কাজ হয় না বলে একালের প্রজন্ম জানে না তার উৎসমূলের ইতিহাস। জানার আগ্রহ থাকলেও তাদের সামনে কোন তথ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস নেই। পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তাশাসক ও তাদের উত্তরসূরিরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার পথটি রুদ্ধ করে দিয়ে বিকৃত এক ইতিহাসকে উপস্থাপন করেছিল। বাঙালীর ইতিহাস রচনার সম্ভাবনার ক্যানভাসটিকে বিস্ময়কর এবং বেদনাদায়কভাবে কালিমালিপ্ত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ পূর্বাপর ইতিহাস যথাযথভাবে তুলে না আনায় প্রকৃত সত্য চাপা পড়ে যাচ্ছে। তাই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধের বিন্যস্ত চিত্র না পাওয়ায় স্বাধীনতাবিরোধীদের অনেকে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় শুধু নয়, সার্টিফিকেটও পেয়েছে। দেশে ইতিহাস চর্চার যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিদ্যমান, তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার কাজটি যে সহজসাধ্য নয়, তা বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর প্রথম ত্রিবার্ষিক সম্মিলনে উচ্চারিত হয়েছে। শঙ্কা হিসাবে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসনের বিভিন্ন ধরন বাঙালীর মনোজগত থেকে সম্পূর্ণ বিতাড়িত হয়নি। কিন্তু রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকা-ে সেই অবস্থান উঠে আসে। তারা ইতিহাস বিকৃত করার মতো অপরাধ করে আসছে। সঠিক ইতিহাস যা পড়ানো এবং চর্চা না করার কারণেও এটা তারা করতে পেরেছে। ইতিহাস না জানলে ভবিষ্যতের পথরেখা নির্দেশ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। অসাম্প্রদায়িক নীতি থেকে বাংলাদেশ তাই দূরে সরে আসায় সমাজের প্রতিটি স্তরে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে পড়েছে। ইতিহাসকে যোগ্য জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে হলে রাষ্ট্রের পাশাপাশি ইতিহাসবিদদেরও এগিয়ে আসতে হবে। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করতে হলে সঠিক ইতিহাসের চর্চাও জরুরী। জাতি যত ইতিহাসমনস্ক হবে, অসাম্প্রদায়িকতা, দায়িত্ববোধ ততবেশি প্রভাবিত করবে। জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সত্যিকার মাথা তুলে দাঁড়ানো নির্ভর করছে সঠিক ইতিহাস পাঠের ওপর। আমরা চাই সবাই ইতিহাস পাঠ করুক, গড়ে উঠুক ইতিহাসমনস্ক জাতি।
×