ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৭ জানুয়ারি ২০১৭

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

দশম অধ্যায় একাত্তরের দিনপঞ্জি আমার স্মৃতিকথার প্রথম খ- : আমার জীবনের প্রথম ২২টি বছরে শেষ হয়। ঐ খ-ের সমাপ্তি টানাটা খুবই সহজ বলে মনে হয়। জন্ম থেকে ছাত্র জীবনের সমাপ্তি পর্যন্ত সময়ের কাহিনী খ-টিতে প্রকাশিত হয়। এবারে দ্বিতীয় খ-ের সমাপ্তি টানতে কিন্তু অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছে এবং সমাপ্তি সময়টি নির্ধারণে অনেকটা ঘটনা প্রবাহের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। আমার কর্মজীবনের এখন ষাট বছর পূর্ণ হয়েছে। এখানে বিভিন্ন খ-ের কাহিনী কোন একটি ছক বেঁধে করা মনে হচ্ছে কষ্টকর। তবে লিখতে গিয়ে দ্বিতীয় খ-ের সমাপ্তির সময়টি যেন স্বাভাবিকভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই খ-ের সমাপ্তি আমি ১৯৭১ সালে করছি। ১৯৭১ সালে আমাদের জাতি এবং রাষ্ট্রগত পরিচয় এক নতুন রূপ লাভ করে। বাংলাদেশে আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করি এবং এর পরিচালনার দায়িত্ব আমরা নিজেরা গ্রহণ করি। এর আগে যত শাসক এদেশে ছিল তারা ছিল বহিরাগত। অবশ্য, তাদের সবাই শুধু ব্রিটিশরা বাদে এদেশে এসে এদেশটিকে নিজেদের বলে মেনে নেন এবং সেভাবে তারা নিজেদেরও নতুনভাবে গড়ে তোলে। তাই এই খ-ে আমি ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ষোলো বছরের কাহিনী লিপিবদ্ধ করছি। ১৯৭১ সালে আমাদের জীবনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। পৃথিবীর বুকে জেগে উঠে এক নতুন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বিংশ শতাব্দীতে আর কোন দেশ এমনভাবে একটি মুক্তিযুদ্ধ করে নিজেকে স্বাধীন করেনি। বায়াফ্রা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এই শতাব্দিতে মোটামুটিভাবে উপনিবেশবাদ বিদায় নেয়ার ফলে অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সবক্ষেত্রেই আন্দোলন বা বিক্ষোভ শেষে সমঝোতার মাধ্যমে উপনিবেশগুলো স্বাধীন হয়। ফরাসী সাম্রাজ্যের অনেক উপনিবেশে যথেষ্ট যুদ্ধবিগ্রহ হয় কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিচ্ছেদ হয় আলোচনার মাধ্যমে। অথচ দুটি বিচ্ছিন্ন এলাকা নিয়ে একটি দেশ পাকিস্তান গড়ে উঠে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছায়। তারাই ভারতে স্বতন্ত্র মুসলমান প্রধান রাষ্ট্র গঠনে মূল ভূমিকা পালন করে এবং ভৌগোলিকভাবে অস্বাভাবিক পাকিস্তান সৃষ্টিতে ব্যাপক ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী আমি আমার ডিসেম্বর ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘স্মৃতি অম্লান ’৭১’-এ বিশেষভাবে লিখেছি। এই ঘটনাপঞ্জি নতুনভাবে সম্পাদিত ‘স্মৃতি অম্লান ’৭১’ এও সংযোজিত হচ্ছে। স্মৃতি অম্লানের এই সংস্করণ আমার স্মৃতিকথার তৃতীয় খ- হিসেবে প্রকাশিত। তাই এখানে এ বিষয়ে আর কিছু না লিখে একাত্তরের ঘটনাপঞ্জি একটু পরেই তুলে ধরছি। আমি তখন দেশে ছিলাম না তাই সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি এবং সেটা দেখারও সুযোগ পাইনি। তবে পাকিস্তানের সামরিক রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন আলোচনার পথ বন্ধ করে রক্তললুপ এক সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালীদের নিধন ও তাদের দেশ ও সম্পদ ধ্বংসে লেলিয়ে দিলেন তখন থেকেই বাংলাদেশে পাকিস্তানের সমাধি রচনার কাজ শুরু হয়ে যায় এবং নয় মাসে তার সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধে নৃশংসতার এমন নিদর্শন বিংশ শতাব্দিতে আর কোনটি ছিল না। একই সঙ্গে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নির্বুদ্ধিতাও ছিল অচিন্তনীয়। তবে পাকিস্তান বিংশ শতাব্দিতে গণহত্যার যে রেকর্ড স্থাপন করে তাতে উন্মাদ হিটলারেরও মাথা হেট হয়ে যায়। মাত্র নয় মাসে ৩০ লাখ মানুষের হত্যা এবং একটি দেশের দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ ধ্বংসের লজ্জাকর কীর্তির সঙ্গে যুক্ত হয় দুনিয়ার সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীকে স্বআস্তানা থেকে বিদেশে বিতাড়ন। নয় মাসে এক কোটি আশ্রয় প্রার্থী নিকটস্থ ভারতে প্রাণরক্ষার খাতিরে পাড়ি দেয়। প্রতিফলও হয় একই রকমের বৃহৎ আকারের পরাজয়, সম্মানহানি ও তিরস্কার। ৯১০০০ সৈন্য ও তাদের সহায়ক ছিল যুদ্ধবন্দী এবং এই বন্দীত্বের অবসান হয় যুদ্ধবিরতির প্রায় বছরখানেক পরে। তবে পাকিস্তানের সাফল্য ছিল একটি ক্ষেত্রে। একটি সুন্দর নির্বিরোধী শান্তিময় দেশকে এমন ধ্বংস তারা করে যে সেখান থেকে উঠে দাঁড়াতে বাংলাদেশকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় এবং বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালাতে হয় প্রায় তিনটি বছর। বাংলাদেশের দুর্যোগই একটি আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রাণ প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তোলে- টঘ উরংধংঃবৎ জবষরবভ ঙৎমধহরংধঃরড়হ। নৃশংসতা, বর্বরতা, গণহত্যা, লুটতরাজ ও জনপদ ধ্বংসের প্রতিশব্দ হয়ে উঠে পাকিস্তান ও তার সেনাবাহিনী নির্লজ্জ জাতিটি আজও এই বর্বরতার উর্ধে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান এখন বিশ্বের “বদমায়েশ দেশের (জড়মঁব ংঃধঃব) মধ্যে অন্যতম। মুজিবরনগর সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রথম থেকেই ছিল সীমিত আকারে প্রতিষ্ঠিত। নির্বাচিত জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের প্রায় অর্ধেকের বেশি দেশ পাড়ি দেন। তারা এবং ঢাকার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের শীর্ষ ব্যক্তিরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন। তাদের সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিবৃন্দ যাদের একটি বৃহৎ অংশ ছিলেন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। এক হিসাব মতে দুটি সংসদের সদস্য যারা ভারতে পাড়ি দেন তাদের সংখ্যা ছিল ৩৪০ জন। ১২১ জন জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং ২১৯ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। মন্ত্রিসভার সদস্য প্রথমে ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিসহ মোট ৫ জন। তারা ছিলেন ১. ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম; ২. প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ; ৩. অর্থমন্ত্রী মোঃ মনসুর আলী; ৪. পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ; ৫. ত্রাণমন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান। ১৪ এপ্রিলে কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানী এমপিকে মন্ত্রীর মর্যাদায় জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চীফ অব দি লিবারেশন আর্মি নিযুক্ত করা হয়। অন্য রাজনৈতিক নিযুক্তি হয় ২১ এপ্রিলে। যখন লন্ডনে অবস্থানকারী পূর্ব পাকিস্তানের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ইউরোপ ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের এনভয় নিযুক্ত করা হয়। তিনি অসহযোগ আন্দোলনের সময় জেনেভাতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ২৬ মার্চে তিনি জেনেভা থেকে লন্ডনে যান এবং সেখান থেকে ১০ এপ্রিলে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করেন। মন্ত্রিসভার কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন মুক্তিযুদ্ধকালে করা হয়নি। তার মূল কারণ ছিল বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে কোন্দল এবং বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের নানা ধরনের তৎপরতা। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পরেই মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২৭ ডিসেম্বর ৪ জন নতুন মন্ত্রি নিযুক্ত হলেন যথা- শেখ আব্দুল আজিজ, ফণিভূষণ মজুমদার, আব্দুস সামাদ আজাদ এবং জহুর আহমেদ চৌধুরী এবং পরের দিনই অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। সেনাবাহিনীতে শুরুতেই লেঃ কর্নেল এম আবদুর রবকে চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হয়। ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতিতেই ৮টি সেক্টরের কথা বলা হয়। জুলাই মাসে সেই সেক্টরগুলোকে বর্ধিত করে ১১ সেক্টর করা হয় এবং তাদের মধ্যে ১টি ছিল ফ্লাইট লে. আহমেদ রেজার অধীনে, ১টি নৌবাহিনীর অধীনে (সেক্টর-১০)। জনপ্রশাসন সংগঠিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। তখন পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান যিনি আওয়ামী লীগ নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে পাবনায় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন তাকে সাধারণ প্রশাসন সচিব নিযুক্ত করে জনপ্রশাসনকে সংগঠন করার প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়। অচিরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অর্থ বিভাগের যুগ্মসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান যিনি যুদ্ধ শুরুকালে কিশোরগঞ্জে ছুটিতে ছিলেন তিনি সেখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতে পাড়ি দেন। তাকে এপ্রিল মাসেই অর্থসচিব নিযুক্ত করা হয়। চলবে...
×