ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

উস্কানির রাজনীতি কতদূর গিয়ে থামবে?

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৭ জানুয়ারি ২০১৭

উস্কানির রাজনীতি কতদূর গিয়ে থামবে?

স্বাধীনতার পরপরও এমন আগুনের লেলিহান শিখা দেখতাম আমরা। পাটের গুদাম, চটকল, খাবারের গোডাউন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-সবকিছুতে গায়েবি আগুনের জ্বালায় অতিষ্ঠ ছিল দেশের মানুষ। নতুন সরকার বঙ্গবন্ধুর নতুন দেশকে ঠিক জায়গায় পৌঁছুতে না দেয়ার জন্য প্রাণান্তকর অপচেষ্টা চালিয়েছিল দেশবিরোধী শক্তি। আমরা ভুলে যাইনি সাধারণ মার্জনার আওতায় ছাড় পাওয়া জামায়াত-মুসলিম লীগের নেতারা ঢাকায় নিজেদের একসভায় বলেছিল, বঙ্গবন্ধু তাদের দ্বিতীয় পিতা। নিজের বাপেরা জন্ম দিলেও জাতির পিতাই তাদের নতুন জীবন দিয়েছেন। সেই লোকেরা মাত্র তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। আজ এদের প্রেতাত্মারা শেখ হাসিনাকে ছাড় দিতে রাজি না। জনককন্যা এ দেশের ইতিহাস বা সময়কে পাপমুক্ত করার জন্য যেসব ঐতিহাসিক কাজ করেছেন ও পাপীদের দ- দিয়েছেন তারা কি এমনি এমনি সব ছেড়ে দেবে? আজ যেখানে যত আগুন যত ঝামেলা যত ধরনের অপকর্ম তার পেছনে এদের হাত স্পষ্ট। সম্প্রতি পাঠ্যবইয়ের যে সব কেচ্ছা, যেসব কাহিনী আর পরিবর্তন তাতে এটা স্পষ্ট ইন্ধন চলছে এবং তা এখন আওয়ামী লীগের ঘরে ঢুকে পড়েছে। এর ভেতরেই দেখছি উস্কানির আরেক পর্ব। খালেদা জিয়াকে মাঠে নামানোর সব প্রচেষ্টা মুখথুবড়ে পড়ার পরও চলছে সুশীল-কুশীল আর খালেদা জিয়ার নিজস্ব অপ-ইচ্ছার নীলনক্সার বাস্তবায়ন। আসিফ নজরুল ফতোয়া দিয়েছেন গেল বছরের ব্যর্থতম দল নাকি বিএনপি। ভাবছেন সমালোচনা বা বিরোধিতা করা হয়েছে? মোটেও না। এটা নেগেটিভ পপুলারিটি এনে দেয়ার বহুত পুরনো তরিকা। গেল বছর কেন, বলতে গেলে বিগত দশ বছর ধরে বিএনপি আসলে ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নেয়া একটা দল। মাঝে মাঝে গা-ঝাড়া দেয়ার নামে দেশকে অশান্ত করে তোলার ব্যর্থ প্রয়াস ছাড়া তারা আর কি করতে পেরেছে? জ্বালাও-পোড়াও আর টিভি বা মিডিয়ার সামনে মাইক্রোফোন হাতে কিছু নেতার আস্ফালন, বাইরে গঠনমূলক কি কাজ করেছে এই দল? অথচ আসিফ নজরুলদের মতো সুবিধাবাদী বিশ্বাস হন্তারক ও স্বাধীনতাবিরোধীরা এখনও মনে করেন বিএনপিই হচ্ছে দেশের সাইলেন্ট মেজরিটির প্রধান দল। সাইলেন্ট মেজরিটি নামের বোকা ও নিরীহ মানুষগুলোকে কোনভাবে রাগিয়ে বা মাঠে নামিয়ে ফায়দা লুটতে না পারায় আজ তারা এই জাতীয় নেগেটিভ কথা বলছেন। যেটুকু জনপ্রিয়তা বা মানুষের সমর্থন ছিল তাকে কাজে লাগাতে চাইলে বিএনপি সংসদে আসত। রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিকতার ধারা মানত। সেটা না করার পেছনে যত এমাজউদ্দীন, জাফরুল্লাহ আর আসিফ নজরুলরা আছেন তারাই এখন খালেদা জিয়াকে চাঙ্গা করার জন্য এভাবে নেগেটিভ ছুরি শান দিতে চাইছেন। আমরা বলি না যে, বিএনপির রাজনীতি করার দরকার নেই। দরকার অবশ্যই আছে। কিন্তু তাদের একটা সঠিক চেহারায় আসতে হবে। তারা ইচ্ছেমতো জামায়াতের সঙ্গে আবার সুযোগ বুঝে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষকের দলে পরিণত হতে চাইলে তা হবে না এবং এটাই এখন তাদের জন্য ক্লিয়ার মেসেজ। বিএনপির বুদ্ধিজীবীরা যে কথাটা বুঝতে পারছেন না, খালেদা জিয়ার দিন প্রায় শেষ। তার আগের জনপ্রিয়তা বা ইমেজের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া আওয়ামী লীগের মতো সারিসারি নেতা আর কর্মীর দলও নয় বিএনপি। তার জন্ম সরকারের গর্ভে। গদিতে থেকে দল করার নেতারা মারা গেলে বা গদি হারালে দল টেকে না। এটাই ইতিহাস। বরং বিএনপির ভাগ্য ভারত বিরোধিতা, পাকপ্রীতি আর আওয়ামী লীগের দুর্বলতার কারণে এখনও তারা মিডিয়া ও একশ্রেণীর মানুষের কল্যাণে বহাল তবিয়তে টিকে আছে। বিএনপি নেত্রী কম কথা বলেন এমন ধারণা আমরা মানি বটে, বুঝতে পারি না কেন? বললে আসলে তিনি কি বলেন? বেগম জিয়া প্রায়ই নীরব থাকেন। এক সময় এই নীরবতা বা চুপ থাকা তার ইমেজকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। বিপরীত প্রান্তে থাকা আওয়ামী লীগ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী সব সময় সরব। যাঁরা সরব বা মুখ খোলা রাখেন তাঁদের অন্তর সরল হলেও মুখের কথা মাঝে মাঝে বিপদে ফেলে বৈকি। শেখ হাসিনা সোজাসাপটা সরাসরি বলেন বলে প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়েন। তাঁকে পছন্দ করতে না পারা মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিবিরোধীরা এর সুযোগ নিয়েছেন বহুবার। অন্যদিকে তাঁদের মুখে বলতে না পারলেও মনের ভেতরে থাকা খালেদা জিয়াকে তাঁরা চুপ থাকতে বলেন। কারণ, মুখ না খুললে অনেক কথা বের হয় না, আর বের না হলে বোঝা যায় না কি বলছেন, কেন বলছেন, কাকে বলছেন? সেদিন এখন বিগত। শেখ হাসিনা এখন অনেক পরিণত। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে খালেদা জিয়াকেও কিছু বলতে হবে। আমি বলি না যে তিনি বলেন না। মাঝে মাঝে লাগসই কথা বলে খালেদা জিয়া বেশ চমক তৈরি করেন। তবে তিনি যে, মুখ খোলেন না আসলে সেটা তাঁর দল ও নিজের জন্যই মঙ্গলের। অনেকদিন পর যাও মুখ খুললেন তাও কিন্তু স্রেফ উস্কানি। বিএনপির নেতৃত্ব কতটা দিশেহারা সেটা মির্জা ফখরুলের কথা শুনলে আর মওদুদদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। এরা না পারছে কোন উত্তেজনা তৈরি করতে, না মানুষকে মাঠে নামাতে। বদলে যাওয়া বাস্তবতায় মানুষ আর আগের মতো মাঠে নেমে রাজপথে রাজনীতির জন্য জান দেবে না। সেটা বিএনপি টের পেলেও মানতে পারছে না। তাদের জ্বালাও-পোড়াও মানুষের জান নিয়ে খেলার জবাব দিয়েছে এ দেশের নিরাপত্তা বাহিনী। অন্যদিকে জনগণের মনেও তৈরি হয়েছে বিরূপ ধারণা। তারপরও গদির লোভ বলে কথা। খালেদা জিয়া সম্প্রতি ছাত্রদলের সভায় তাঁর মুখ খুলে আবারও প্রকাশ্য উস্কানি দিতে ভুল করেননি। ছাত্রদলের এখন সময় খারাপ। যুবরাজ লন্ডনে যাওয়ার পর থেকে ছাত্রদলের তেমন কোন কার্যক্রম নেই। শিবিরের ছেলেরা মাঠে-ময়দানে ঝামেলা পাকালেও ছাত্রদল নেই। তারা গৃহবন্দী অথবা আত্মগোপনে। অনেকদিন পর যাও নেত্রীর সামনে সেøাগান দিল খালেদা জিয়ার তা ভাল লাগেনি। খবরে দেখলাম তিনি তাদের ভালই শাসিয়ে দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন রাজপথে থাকার সেøাগান দিলেও ঠিক সময়ে তাদের নাকি দেখা মেলে না। তবে উস্কানিটা এসেছে অন্য ভাষায়। তিনি তাদের বলেছেন, জনপ্রিয়তা থাকলে হবে না। গদিতে যাওয়ার রাস্তা ক্লিয়ার করার জন্য যা যা করার সব করতে হবে। কথাটা ভেবে দেখার মতো। এই যে যুবসমাজ বা ছাত্ররা তারা কোন দল বা কাউকে গদিতে যাওয়ার জন্য আসলে কি করতে পারে? কি কি করতে পারে? তারা নিশ্চয় অন্যের ভোট নিজেরা দিতে পারবে না। পারবে না আওয়ামী লীগকে টেনেহিঁচড়ে গদি থেকে নামাতে। তাহলে কি করতে বলছেন খালেদা জিয়া? যার মানে তিনি চাইছেন তারা এমন সব কাজ করুক বা নৈরাজ্য তৈরি করুক যাতে সরকার টিকতে না পারে। এই জাতীয় কথা আসলেই রাজনীতির জন্য অপমানজনক এবং এর কারণেই মানুষ রাজনীতির ওপর বিরক্ত। খালেদা জিয়া একটু ভেবে দেখলেই বুঝতেন তাঁর দল বা বিএনপির আক্রমণাত্মক নীতি ও রাজপথে সন্ত্রাস মানুষ নেয়নি। বরং সে কারণে সরকারের নানা নেগেটিভ কাজের পরও জনগণের মনোভাবে চিড় ধরেনি। অথচ এসব বিবেচনা ব্যতিরেকে খালেদা জিয়া ছাত্রদলকে খামোখা উস্কে দিলেন। জানি এতে কারও কোন লাভ নেই, লোকসান নেই। সরকারেরও না। তারপরও আমরা জাতির স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে আর দেশের কল্যাণে এমন রাজনীতি চাই যা দেশ ও জনগণকে নিরাপদে রাখবে। সরকার আসবে সরকার যাবে। গদি কারও নিজস্ব সম্পত্তি না। দেশ শাসনের অধিকারও কোন দলের ব্যক্তিগত বিষয় হতে পারে না। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সুযোগ মিললেই উস্কানির কাজটি করতে কসুর করে না। এতদিন পর বিএনপি যখন আসলেই কোণঠাসা আর দল যখন মরিয়া তখন সঠিক দিকনির্দেশনার পরিবর্তে এমন বক্তব্য মূলত রাজনীতির দীনতা আর কুরুচির পরিচায়ক। আমরা কি এর কবল থেকে কখনও মুক্ত হতে পারব না? এখন তো দেখছি এরা যত নীরব থাকেন ততই মঙ্গল। রাজনীতিতে মুখ খোলা মানে কি কেবলই বিপদ টেনে আনা? না গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া? উন্নয়নের যে পথ দেশ খুঁজে পেয়েছে তার সঙ্গে দেশের রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। বরং খালেদা জিয়ার এবারের বক্তব্য আর আসিফ নজরুলদের উস্কানি মিলে নতুন দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের ভয় দেখাচ্ছে। সঙ্গে আছে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাজে ভূমিকা। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এখন তাঁর পদের আনন্দে বিভোর। হঠাৎ হঠাৎ এমন সব কা- আর কথা বলেন যাতে আমরা চমকে উঠি। দেখলাম তিনি বলেছেন শেখ হাসিনার কিছু হলে সারাদেশে নাকি আগুন জ্বলে উঠবে। সরকার প্রধানের কোন কিছু হলে দেশে তার দল আগুন জ্বালাতে চাইবে এটা একজন শিশুও বলতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে এমন আতঙ্ক সরকারী দলের সম্পাদকের মনে বাসা বাঁধল কি কারণে? আর ইতিহাস থেকে আমরা কি পাঠ নিয়েছি? অঘটন ঠেকানো, না অঘটন ঘটে গেলে মাতম করা? বঙ্গবন্ধুর আমলে দেয়াল লিখন ছিলÑ দরকার হলে আলেন্দের মতো রক্ত দেব তবু মাথা নিচু করব না। অথচ রক্তপাত ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়নি সে সময়। বলা উচিত ছিল আলেন্দের কাছ থেকে শিখেছি রক্তপাত হতে দেব না আমরা। ঠিক একইভাবে আজ আবার কিছু হলে আগুন জ্বলবে শুনে ভয় জাগে আমাদের মনে। সরকারী দলের সাধারণ সম্পাদক মানুষকে আশা ও ভরসা দেয়ার পরিবর্তে ভয়ের কথা জানিয়ে বিএনপির ব্যর্থতার রাজনীতিকেই কি সার্থকতার মুখ দেখাচ্ছেন না? আমরা এ দেশে শান্তি ও সহমর্মিতার রাজনীতি চাই। আমরা খালেদা জিয়ার কাছ থেকে, তাঁর বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে হিংসা ও ঘৃণার বিপরীতে জনকল্যাণের কথা আশা করি। আর সরকারী দলের কাছে চাই আশা ও শান্তির নিরাপত্তা। রাজনীতিই আর কত পচলে তারপর ঘুরে দাঁড়াতে শিখবে? নববর্ষে কি এতটুকুও আশা করতে পারব না আমরা?
×