ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

আগে জীবনের উদ্দেশ্য স্থির করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৭ জানুয়ারি ২০১৭

আগে জীবনের উদ্দেশ্য স্থির করতে হবে

যারা ১৭ থেকে ১৯ বছরের টগবগে যুবক-যুবতী অর্থাৎ Teenage তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, স্বপ্ন দেখেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে। এনসাইক্লোপিডিয়াতে বিশ্ববিদ্যালয় বা University বলতে যা বুঝায় Latin universitas “an Institution of Right Education & research which grants Academic degree” ev Latin Universitas Magistrorum et scholarium means “community of teachers and scholars”. আর এ ক্ষেত্রে তারা হলেও খুদে প-িত বাyoung Genious. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জাতীয় শিক্ষা নয়, এটা হলো আন্তর্জাতিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হলো আন্তর্জাতিক ছাত্র অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হলো Global citizen. অর্থাৎ বিদ্যালয় নয়, উচ্চ বিদ্যালয় নয়, মহাবিদ্যালয় নয়, তারা হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অর্থাৎ বিশ্ব নাগরিক। অত্যন্ত মূল্যবান ধারণা হলো বিশ্ববিদ্যালয় Academic Freedom বা মুক্ত শিক্ষা ও চেতনার জায়গা। ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮ সাল পৃথিবীর ৪৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটার স্বাক্ষরিত Magna Charta Universitatum এখনও পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটরগণ স্বাক্ষর করছেন। একই চার্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জ্ঞান অন্বেষণের জন্য অচেনা, অজানা ও অনাবিষ্কৃত পথে ভ্রমণের অনুমতি দিয়েছে। একেই বলে Academic Freedo.. বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, রাজনীতি, দর্শনসহ সর্বক্ষেত্রেই জ্ঞান অন্বেষণের চিন্তা করতে সাহায্য করে। আর্থিক দিক বিবেচনা করলে বলতেই হবে পাক-ভারত উপমহাদেশে সরকারী অর্থাৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মোটামুটি মুক্ত পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায়। খুলনা একদিকে যেমন পীর-আউলিয়ার বসতিস্থান, হিন্দু সাধক ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর অনেক বিদ্যাপীঠ বা আশ্রমের স্থান তেমনি এই মাটি ধন্য হয়েছে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্রের জন্ম দিয়ে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শ্বশুরবাড়ির সুবাদে এই পুণ্যভূমিতে পদচারণা করে গেছেন, সর্বোপরি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে জঠরে ধারণ করেছে এই খুলনা। আজ হানাদার বাহিনী সৃষ্ট ’৭১-এর বধ্যভূমির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। মনে রাখতে হবে ত্রিশ লাখ শহীদ, লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে কোটি কোটি বাঙালীর অশ্রুভেজা এই স্বাধীনতা এবং এই মাটি। আমার দেবতা, যেহেতু আমি হিন্দু ধর্মে বা স্রষ্টায় বিশ্বাসী, তাহলে হাজার ছেড়ে লাখ পর্যন্ত হতে পারে। আমার বাবা-মা যেমন আমার দেবতা তেমনি এই বিশ্বব্রহ্মা-ে আরও অনেক মনীষী আছেন এবং এমন কিছু শিক্ষক আছেন যারা দেবতুল্য। কিন্তু আমার দেবতার সিঁড়িতে সর্বশেষ সংযোজন হলেন ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ভারতরতœ এপিজে আবদুল কালাম। পৃথিবীতে একাধারে বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষক, চিন্তাবিদ বা মনীষী, সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি একজনের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে, তিনি হলেন ভারতের জনগণের অবিসংবাদিত প্রয়াত রাষ্ট্রপতি। ‘‘Uncontroversial peoples president’ কালামজীর একটা বক্তব্য দিয়ে শুরু করছি “Life has to be built on a great Ideal” এবং সে জন্য শিক্ষার্থীদের চিন্তা করতে হবে, আবিষ্কার করতে হবে নিজেকে অর্থাৎ You identify what is unique in you. শিক্ষার্থীরা এখন যে মাঠে বসে অভিষেকে সংবর্ধিত হচ্ছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে Induction করা হচ্ছে। যখন তারা দেখে আলো এবং বৈদ্যুতিক বাল্ব তখন ভাবছে Thomas Alva Edisonএর কথা যিনি এই জিনিসগুলোর আবিষ্কারক। এই মুহূর্তে যদি একটা উড়োজাহাজের শব্দ শুনে, তখনই রাইট ভ্রাতৃত্বদ্বয়ের কথা মনে করবে। তাই নয় কি? সি ভি রমন Pondered why the horizon, where sky & sea meet looks blue, this is the phenomenon of scattering of light for which he was awarded Nobel. আমি কিছুদিন আগে একটা মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক ৪র্থ এবং ৫ম বর্ষের ছাত্রদের সামনে একটা বক্তৃতায় বলেছিলাম Read Read & Read ‘পড় পড় এবং পড়’ এটা কার উক্তি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য একজন ছাত্রও বলতে পারেনি এটা মহামতি লেনিনের অমোঘ বাণী। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, বিপ্লব করে বুর্জোয়া শ্রেণী অপসারণ করা হয়েছে। পুঁজিবাদের গোড়া উৎপাটন করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে অভূতপূর্ব উৎকর্ষ সাধনের জন্য, পড়া-লেখার কোন বিকল্প নেই। অর্থাৎ ছাত্র নং অধ্যয়নং তপ:। ণড়ঁ সঁংঃ ধিহঃ ঃড় নব ুড়ঁ.অর্থাৎ তুমি একটা আদর্শকে সামনে রেখে শুধু তুমিই হতে চাও। তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিভা লুকায়িত আছে। যা সমষ্টিগত সততা, গবেষণা, অধ্যয়ন, উচ্চ নৈতিকতা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশকে অনেক কিছু এনে দিতে পারবে। একই ভাবে মাদার তেরেসা বলেছিলেন এরাব, এরাব, এরাব, টহঃরষ রঃ যঁৎঃং. যিনি মানবতার সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করে ঘড়নষব চৎরুব পেয়েছিলেন। এটা দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, দিয়ে যাও, দিয়ে যাও এবং দিয়ে যাও যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি নিঃশেষ না হচ্ছো। কারণ, তুমি যখন পৃথিবীতে এসেছ, তখন শূন্য হাতে বিবস্ত্র অবস্থায় নিঃস্ব হিসেবেই এসেছিলে। যত ধন-সম্পদের মালিকই তুমি হওনা কেন, পৃথিবী থেকে বিদায় নিতেই হবে এবং সেই বিদায়ও শূন্য হাতে, নিঃস্বভাবে। বিজ্ঞানের আর একজন মহীয়সী নারীর নাম সবারই জানা, যিনি রেডিয়েশন আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন, পরবর্তীতে নিজের শরীরের ওপর রেডিয়েশনের বিক্রিয়ার প্রভাব ব্যাখ্যা করে রসায়নে নোবেল পেলেন, তা শুধু সম্ভব হয়েছে গবেষণার জন্য। এমনকি এই রেডিয়েশনের প্রভাব তাঁর শরীরে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, যার জন্য তিনি সানন্দে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। এই মহৎ ব্যক্তিদের আদর্শ স্মরণ করিয়ে দিলাম “The challenge is that you have to fight the hardest battle that any human can, ever fight and never stop fighting until you arrive at your destination. সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আমার বলার আছে, কিভাবে জীবনের উৎকর্ষ লাভ করতে পারা যায় এবং নিজ গন্তব্যে পৌঁছতে পারা যায়। সেই লক্ষ্যে এখানে ৪টি ধাপ রয়েছে প্রথমত : কুড়ি বছরের আগে জীবনের উদ্দেশ্য স্থির করতে হবে। দ্বিতীয়ত : সর্বক্ষণিক শুধু জ্ঞান আহরণ করতে হবে। অর্থাৎ মনে রাখতে হবে লেখাপড়ার কোন শেষ নেই। তৃতীয়ত : কঠোর পরিশ্রম, সততা, নিয়মানুবর্তিতা দিয়ে যে কোন সমস্যার সমাধান করতে হবে। চতুর্থত : যথেষ্ট ইচ্ছাশক্তি এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে ক্ষুদ্র এবং মহৎ সব কাজ সম্পন্ন করতে হবে। In this connection let me recall these verses of the Nineteenth Century Persian Sufi Poet Jalal Uddin Rumi: “I am born with potential. I am born with goodness & trust I am born with Ideas & dreams I am born with greatness I am born with confidence I am born with wings So I am not meant for crawling I have wings I will fly I will fly & fly” My message to my young friends that education gives you’ the wings to fly, Achievement comes when your conscious and subconscious mind belives “I will win” বিদ্যা অমূল্য ধন। যা অর্জনের কোন শেষ নেই এবং অর্জিত জ্ঞান বিতরণ করেও শেষ করা যায় না। সুতরাং প্রাণ দিয়ে মনে রাখবে মন দিয়ে অর্জিত শিক্ষা বিতরণ করবে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে কিছু জিনিসের কোন বিকল্প নেই। লেখাপড়া, মা-বাবা, পুত্র-কন্যা। হ্যাঁ বিকল্প আছে শুধু উল্টিয়ে বলতে পারি, পড়ালেখা, বাবা-মা, কন্যা-পুত্র। আজ থেকে শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন হলো ৫ বছর পরে সমাবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে জাতীয় নাগরিক থেকে আন্তর্জাতিক বা বিশ্ব নাগরিকে পরিণত হবে। বিশ্ব নাগরিক বা Global Citizen হতে হলে তিনটি মন্ত্র প্রাণে ধারণ করতে হবে- ‘Don’t lie, Never chit & Never steal.’ শুধু এটা মনে রাখতে হবে সীমিত প্রাপ্তিতে (Limited demand) সন্তুষ্ট রাখতে পারবে। তোমাদের অনেক কিছু করার শখ জাগবে। যখনই তুমি কিছু করবে, একটু থাম, চোখ বুঝে তোমার মা-বাবা, প্রতিবেশী দরিদ্র মানুষটি যার শ্রমে আমাদের অন্ন যোগাচ্ছে তাদের চেহারা কল্পনা কর, চিন্তা কর তুমি যা করতে যাচ্ছ তাতে তোমার মা-বাবা বা দরিদ্র মানুষটি বা সমাজের কিছু উন্নতি হবে কিনা? আর এই সমাজটি হতে হবে সুসমাজ। ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বে ভরপুর নয়। সুসমাজ সৃষ্টি করতে হলে, প্রয়োজন সুশাসন, সুশাসন আসবে সুনেতৃত্বের কাছ থেকে, সুনেতৃত্ব সম্ভব যখন তুমি বা তোমরা হবে সুনাগরিক, সুনাগরিক হতে হলে প্রয়োজন সুশিক্ষা, সুশিক্ষার জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত জ্ঞান অর্জন, সুচিন্তিত জ্ঞান অর্জন তখনই সম্ভব যখন অধ্যবসায়সহ সুপাঠ্য বই ও সুস্বাস্থ্যকে তুমি গ্রহণ করে সুস্থ জীবনের অধিকারী হয়ে নিজের মধ্যে জ্ঞানচর্চা করে অন্যকে বিলিয়ে দেবে। সর্বশেষ ভাগবত গীতার উক্তি দিয়ে শেষ করছি, ‘ফুলকে দেখ, নিঃশব্দে ফুটে সৌন্দর্য ও সুগন্ধ বিলায়ে দিচ্ছে এবং যখন তার কাজ শেষ হচ্ছে, তখন রাতের অন্ধকারে কারও মনে আঘাত না দিয়ে নিঃশব্দেই ঝরে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের বলছি- তোমরা ফুলের মতো হও, মনে রাখবে পৃথিবীতে এমন কোন প্রাণী নেই, যা ফুল এবং শিশুকে ভাল বাসে না। জয় হউক শিক্ষার জয় হউক মানবতার। [খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনায় প্রদত্ত ভাষণের সার সংক্ষেপ] লেখক : ভাইস চ্যান্সেলর (সাবেক) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×