ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অন্যথায় নিবন্ধন বাতিল

যে কোন সরকারের অধীনে বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৭ জানুয়ারি ২০১৭

যে কোন সরকারের অধীনে বিএনপিকে নির্বাচনে  যেতে হবে

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। দলের নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েই যে কোন সরকারের অধীনে বিএনপিকে এ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে ওই নির্বাচনে অংশ না নিলে বাতিল হয়ে যাবে দলটির নিবন্ধন। এ কারণেই বিএনপি এখন রাজপথের আন্দোলনের পরিবর্তে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিটিকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে। সূত্র মতে, বার বার আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর এখন বিএনপির প্রধান লক্ষ্য দল গুছিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া। এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকার গঠন করার মতো আসন না পেলেও অন্তত সম্মানজনক আসন নিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের মর্যাদা পেলে পরবর্তীতে আস্তে আস্তে দলকে এগিয়ে নিয়ে সুবিধাজনক সময়ে ক্ষমতায় যাওয়ার টার্গেট নেয়া। এরই অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যাবতীয় কর্মপরিকল্পনা করছে দলীয় হাইকমান্ড। এজন্যই বার বার হাঁকডাক দিয়েও রাজপথের আন্দোলন থেকে পিছু হটছে তারা। এদিকে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। এছাড়া দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির প্রাথমিক কাজও শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে। এছাড়া নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করছে বিএনপি। আর এ কাজে বিএনপিকে সহযোগিতা করছে দলের থিঙ্কট্যাঙ্ক বলে পরিচিত ক’জন বুদ্ধিজীবী। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নিবন্ধিত কোন রাজনৈতিক দল পর পর ২ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে ওই দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। যেহেতু বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি সেহেতু নিবন্ধন ঠেকাতে হলে বিএনপিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে। এর আর কোন বিকল্প নেই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বিএনপি সব সময়ই নির্বাচনমুখী দল। তাই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে। তবে এ নির্বাচন যেন কোন অবস্থাতেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো না হয় সেজন্য আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলছি। কারণ নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন সরকার নিরপেক্ষ না থাকলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমরা ইতিমধ্যেই নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছি। দেখি রাষ্ট্রপতি কি করেন। তবে আমরা আশা করছি গণতন্ত্রের স্বার্থে রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের পদক্ষেপ নেবেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মতো সার্বিক প্রস্তুতি বিএনপির আছে। তবে আমরা চাই নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকল দলের অংশ গ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন। আর তা হলে বিএনপির নির্বাচনে যেতে কোন সমস্যা নেই। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার টার্গেট থাকায় বিএনপি এখন আন্দোলনের পরিবর্তে গতানুগতিক কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখার চেষ্টা করছে। এজন্যই বৈরী পরিবেশ থাকার পরও মাঝেমধ্যে কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেয়। তবে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা নেই দলটির। এছাড়া সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে দেশব্যাপী সর্বস্তরে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ চলছে বলে জানা গেছে। জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি হিসেবেই বিএনপি সারাদেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে কমপক্ষে তিনজন করে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা করা হচ্ছে। ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এমনটি বিবেচনায় নিয়েই করা হবে এসব তালিকা। এছাড়া বিভিন্ন মাধ্যমে গোপনে জরিপ চালিয়ে একটি তালিকা তৈরি করবে দলীয় হাইকমান্ড। পরে নির্বাচনের আগে দলের নির্বাচনী বোর্ড বসে তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। এখন নির্বাচন হলেও সারাদেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে পাস করার মতো বিএনপির কম পক্ষে ৩ জন প্রার্থী রয়েছেন। আর অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিই ক্ষমতায় যাবে। এদিকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন এবং ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিন জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন কর্মসূচী পালন করে বিএনপি যে ভুল করেছিল তার খেসারত দলটি এখনও দিচ্ছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। কারণ, ওই আন্দোলনে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় বিএনপি দেশের সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন প্রভাবশালীর অনুকম্পা হারায়। এছাড়া এ আন্দোলন করতে গিয়ে দলের বহু নেতাকর্মী মামলায় জড়িয়ে বর্তমানে চরম হয়রানির শিকার হয়েছে। তাই তারা এখন দলীয় কর্মকা- থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। সূত্র মতে, ২০১৫ সালের টানা ৯২ দিনের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩ বছর পরও বিএনপি আর রাজপথের আন্দোলনে যেতে পারছে না। তাই সময় ঘোষণা দিয়েও সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। আর বারবার দাবি করেও মধ্যবর্তী নির্বাচন আদায় করতে না পেরে বিএনপি এখন এ দাবি থেকে সরে এসেছে। সম্প্রতি দলের ক’জন সিনিয়র নেতা প্রকাশ্যেই বলেছেন বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচন চায় না নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। বিএনপি নেতাদের এমন অবস্থান থেকে জনমনে এ ধারণা স্পষ্ট হয়েছে যে, বিএনপি বর্তমান সরকারের ৫ বছর মেয়াদ শেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের মতো ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপি এখন রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আর এ কারণেই এখন আর ৫ জানুয়ারি উপলক্ষে কোন কর্মসূচী পালনের সুযোগ পাচ্ছে না। ২০১৫ সালে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করে ব্যর্থ হওয়ার পর এ দিনটিতে এখন রাজপথ দখলে রাখে সরকারী দল আওয়ামী লীগ। আর বিএনপিকে সরকারের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এবারও সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় ৫ জানুয়ারি রাজপথে কোন কর্মসূচী পালন করতে পারেনি বিএনপি। তবে রাজধানীর বাইরে গতানুগতিক আন্দোলন কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিএনপি। এতে তাদের চরম সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। পাশাপাশি দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা ভর করেছে। জানা যায়, বার বার চেষ্টা করেও আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় এখন একাদশ জাতীয় সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে তৎপর হয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। এজন্য অতীতের ভুলত্রুটি সংশোধন করে এবার সর্বস্তরে দল গুছিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। ৫৯২ মদস্যের বিএনপির নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের পর ইতোমধ্যেই সারাদেশের মহানগর, জেলা, উপজেলা ও এর অধীন অন্যান্য ইউনিটকে নতুন নেতৃত্বে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিএনপি পুনর্গঠনের পাশাপাশি দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকেও ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিএনপির থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরা চান যে কোন পদ্ধতিতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক না কেন বিএনপি যেন সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। বিএনপিপন্থী কোন কোন বুদ্ধিজীবী দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে চিঠি লিখে দল গোছানো এবং পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও দলের নিবন্ধন ঠেকাতে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে প্রস্তুত রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্যই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ১৮ নবেম্বর ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ১৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। ১৮ ডিসেম্বর দলের ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করেন। এ সময় তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও পেশ করেন। পরবর্তীতে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলীয় প্রস্তাব উত্থাপন করবেন বলে জানা গেছে।
×