ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বলাকায় ম্যারাথন বৈঠক ॥ একগুচ্ছ দিকনির্দেশনা

বিমান নিয়ন্ত্রণে নড়েচড়ে বসেছে মন্ত্রণালয়

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৭ জানুয়ারি ২০১৭

বিমান নিয়ন্ত্রণে নড়েচড়ে বসেছে মন্ত্রণালয়

আজাদ সুলায়মান ॥ বিমান নিয়ন্ত্রণে তৎপর হয়েছে মন্ত্রণালয়। বিমান পরিচালনা পর্ষদের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের নজরদারি ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ইতোমধ্যে একগুচছ দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ সব নির্দেশনায় রয়েছেÑ প্রতিদিন ফ্লাইট বিলম্বের কারণসহ রিপোর্ট মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা, বিমানের ভবিষ্যত কর্মপন্থা বের করা, সরকারী প্রতিষ্ঠানের মতো ৯টা ৫টা স্টাইলে শুধু অফিসে আসা-যাওয়ার মানসিকতা পরিহার করে এটাকে বাণিজ্যিকভাবে শক্তিশালী করা, সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে সমন্বয় রাখা এবং লাভজনক এয়ারলাইন্স হিসেবে দাঁড় করানোর অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সেগুলোর সমাধান করা। বৃহস্পতিবার বিমানের সদর দফতর বলাকায় সাড়ে চার ঘণ্টার এক বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ সব দিকনির্দেশনা দেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটি, ভিআইপিদের হস্তক্ষেপের দরুন সিডিউল বিপর্যয় ও যাত্রীসেবা নিয়ে ঘটনায় তৎপর হয়ে ওঠে মন্ত্রণালয়। ওই দিন বেলা দুটায় শুরু হয়ে টানা সাড়ে চার ঘণ্টার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সচিব এসএম গোলাম ফারুক, বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ। মিডিয়ার প্রতিনিধিদের বাইরে রেখে দীর্ঘ এই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিশেষ পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দেয়া হয়। বিমানের মার্কেটিং, কাস্টমার সার্ভিস, ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট, প্রশাসন, কার্গো ও অপারেশনসহ প্রতিটি বিভাগের ওপর আলাদা আলাদা বিশেষ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এ সময় কার্গো ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং শাখার অব্যবস্থাপনা ও নানা সঙ্কট নিয়ে বক্তব্য দেয়াকে কেন্দ্র করে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তারা বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সচিব ব্যক্তিগতভাবে কাস্টমার সার্ভিস ও কার্গোর বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। কেন এই দুটো বিভাগে এত সংকট, এত অভিযোগ সেটার ব্যাখ্যা চান। এ সময় বিমানের কাস্টমার সার্ভিস শাখার পরিচালক আতিক সোবহান তার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা যেমন-প্রশিক্ষিত জনবল, যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জামাদির কথা তুলে ধরেন। আতিক সোবহান যুক্তি দেখান- শাহজালাল বিমানবন্দরে শীতকালীন ঘন কুয়াশাজনিত কারণে একসঙ্গে যখন ১০/১২টা ফ্লাইট নামে তখন পরিস্থিতি কিছুতেই সামাল দেয়ার মতো নয়। বিমানবন্দরে বেল্ট আছে মাত্র আটটি। তার মধ্যে সচল থাকে ৬টি। গড়ে দুটো সব সময়ই রক্ষণাবেক্ষণে থাকে। এ কটা বেল্ট দিয়ে দুনিয়ার কোন ম্যানেজমেন্টের পক্ষেই এত ফ্লাইটের লাগেজ সঠিক সময়ে ডেলিভারি দেয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও উল্লেখ করেন, বেল্ট ছাড়া লাগেজ কন্টেনারবাহী ট্রলি সব বেল্ট এরিয়ায় পৌঁছানোর সুযোগ নেই। পুরনো বেল্ট এরিয়ায় পিলারের দরুন ট্রলি পৌঁছানো কষ্টকর। তখন হাতে ঠেলে কাজ করতে হয়। তিনি জানান, এ বেল্ট অপারেট করার দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশনের। তার বক্তব্য শেষ করার পর সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী এসব অভিযোগ খ-নের চেষ্টা করেন। তখন মেম্বার (অপস) এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান স্বীকার করেন দুটো বেল্ট পিরিয়ডিক্যালি মেইটেনেন্সে থাকে। একই সময় কার্গোর সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বিমানের মহাব্যবস্থাপক আলী আহসান বাবু জানান-চার বছর আগে শুরু হওয়া কার্গোর সেমি অটোমেশনের কাজ শেষ করতে পারেনি সিভিল এভিয়েশন। যুক্তরাজ্য কার্গোর ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদানের পরও গত দশ মাসে অভাবনীয় রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও কার্গোর ভলিউম বেড়েছে। তার এ বক্তব্য খ-ন করতে গিয়ে সিভিল এভিয়েশনের এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান ব্যাখ্যা দেন, সরকারী কেনাকাটায় অনেক জটিলতা থাকে। যে জন্য অটোমেশনের যন্ত্রপাতি কেনাকাটা ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কাজে সময় লাগে। তিনি অটোমেশনের কাজ শেষ না করার দায়ভার বিমানের ওপর চাপিয়ে বলেন, সময়মতো কার্গো জায়গা খালি করে দিতে পারেনি। তখন বিমান থেকে বলা হয়-প্রতিদিন শত শত টন কার্গো আসে। এগুলো রাখার জায়গা নেই। সেজন্য খালি করা যায় না। জানা যায়, কার্গো নিয়ে বর্তমান সঙ্কটের জন্য সিভিল এভিয়েশনকেই তথ্য প্রমাণাদিসহ খুব জোরালোভাবে দায়ের করা হয়েছে, যা সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে যৌক্তিকভাবে খ-াতে ব্যর্থ হয়। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ দেখা দেয়। বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের বাদানুবাদে সচিব এস এম গোলাম ফারুক কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে কড়া ভাষায় বললেন, এটা নেই, ওটা নেই বলে আর অজুহাত দেয়া যাবে না। বিমানকে বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে হলে কাজ করতে হবে। যার যেটুকু আছে- সেটুকু নিয়েই আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, এ ধরনের অজুহাত আর শোনা হবে না। প্রতিদিন কোন ফ্লাইট কি কারণে কতক্ষণ দেরি হয়, সেটা প্রতিদিনই মন্ত্রণালয়কে জানানোর নির্দেশ দেন তিনি। এজন্য প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়ের তৈরিকৃত সুনির্দিষ্ট ফরম্যাটে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেয়া হয়। বিমানের অপারেশন শাখা থেকে তা জানানো হবে বলে সচিবকে আশ্বস্ত করা হয়। বৈঠকে মার্কেটিং শাখার বর্তমান ও ভবিষ্যত পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। এতে আগামী পাঁচ ও দশ বছরে দেশীয় যাত্রীসহ এভিয়েশনে সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির চিত্র দেখানো হয়। সচিব তখন জানতে চান, সে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো সামর্থ্য বিমানের রয়েছে কিনা। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ জবাব দেন, বিমানের বহর ও রুট বাড়াতে হবে। কিন্তু কেনাকাটার জন্য আরএফপির সময় নানা জটিলতা দেখা দেয়। জানা যায়-মন্ত্রী সচিবের উপস্থিতিতে দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টার বৈঠকের পর বিমানের কর্র্তাদের মাঝে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দেয়। সন্ধ্যার দিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে-হঠাৎ কি ঘটতে যাচ্ছে। মন্ত্রী নিজেই বিমানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিচ্ছেন কি না একজন পরিচালক জানতে চান সেখানে বৈঠকের বাইরে অপেক্ষমাণ দু’সাংবাদিকের কাছে। কারণ বিমানের চেয়ারম্যান এয়ারমার্শাল ইনামুল বারির অনুপস্থিতিতে এ বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুরু করলাম। বিমান দেখতে হবে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। কিভাবে আরও ভাল করা যায় সে সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিমানের দেখভাল করার জন্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ সম্পর্কে কিছু সুপারিশসহ একটা সারসংক্ষেপ তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে। সেটার অপেক্ষায় রয়েছি। আশা করছি সপ্তাহখানেকের মধ্যে সেটা অনুমোদন হয়ে আসবে। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি বিমান কর্পোরেশন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কর্পোরেশন হিসেবে বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীই বিমান পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকতেন। ২০০৭ সালে বিমান প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি করা হয়। তৎকালীন কেয়ারটেকার সরকারের বিশেষ দূত মাহবুব জামিল বিমান পর্ষদের প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর বিমানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ারমার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি টানা ৬ বছর দোর্দ- প্রতাপে কঠোরহস্তে বিমানের দীর্ঘ চার দশকের দুর্নীতি, জঞ্জাল ও পাইলটদের নানা অপকর্ম ও অনিয়মের লাগাম টেনে ধরেন। যে কারণে বিমান দীর্ঘদিন পর ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত পর পর টানা দু’বছর লাভের মুখ দেখে। তারই ধারাবাহিকতায় বিমান গত বছরও লাভের মুখ দেখতে সক্ষম হয়। এরপর গত বছরের মার্চে এয়ারমার্শাল ইনামুল বারিকে চেয়ারম্যান করে বিমানের নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনায় দেশ-বিদেশে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। এতে বিমানমন্ত্রীকেও তোপের মুখে পড়তে হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বিমানের ওপর মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠান প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। তারই অংশ হিসেবে তিনি বৃহস্পতিবার বলাকায় এ ম্যারাথন বৈঠকের আয়োজন করেন।
×