নাট্যকার দার্শনিক সফোক্লিস ছিলেন ধ্রুপদী গ্রীক সাহিত্যের একজন প্রবাদপুরুষ। বিশ্ববিখ্যাত এ নাট্যকার আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এথেন্স নগরীর নিকটবর্তী কলোনাস গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রথম দিকে নাটকের চেয়ে কবিতা, প্রবন্ধ এবং ধর্মসঙ্গীত রচনার প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী ছিলেন তিনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহান এ শিল্পী সফল একজন নাট্যকার হিসেবেই বিশ্বময় প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সফোক্লিস খুব অল্প বয়সে জিমন্যাস্টিক্স বিদ্যা, মঞ্চাভিনয় শৈলী এবং নৃত্যকলাবিদ্যা রপ্ত করে নিয়েছিলেন। তারুণ্যময় মুহূর্তে এথেন্সের সেরা সঙ্গীতজ্ঞ ল্যামপ্রুসের কাছে সঙ্গীতবিষয়ক বিশেষ তালিম গ্রহণ করেন এবং ওই সময় দেশের বড় বড় অনুষ্ঠানে জিমন্যাস্টিক্স ও গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিজয়মাল্য কুড়িয়ে আনেন আর নিজের প্রতিভা ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করতে শুরু করেন। সুদর্শন দেহসৌষ্ঠব আর অদম্য প্রতিভার গুণে সব শ্রেণীর মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অত্যন্ত আদরণীয় ব্যক্তি।
সফোক্লিস তার সুদীর্ঘ ৯০ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে একটি স্যাটোয়ারধর্মী রচনার খ-াংশসহ মোট ১২৩টির মতো নাটক রচনা করেন। তবে আড়াই হাজার বছরের কালের ঝাপটায় তার অধিকাংশ রচনাই হারিয়ে গেছে মহাকালের কৃষ্ণগহ্বরে। টিকে আছে মাত্র ৭টি নাটক। তন্মধ্যে ‘ইদিপাস’, ‘কলোনাসে ইদিপাস’ ও ‘আন্তিগোনে’ নাটক ত্রয়ীর বদৌলতে একালেও সফোক্লিস নামটি প্রবলভাবে উচ্চারিত হতে দেখা যায়। আলোচ্যমাণ প্রত্যেকটি নাটকই ট্র্যাজিক তথা বিয়োগান্তক আখ্যানে স্বতন্ত্র। সফোক্লিসের নাটকগুলোতে প্রাচীন গ্রীসের রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা, নাট্যচিন্তা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও লোকপুরাণের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। গ্রীসের নিয়তিবাদী মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার তীব্রতাকেও প্রবলভাবে লেপ্টে দিয়েছেন তিনি নাটকের শরীরে। তার বিখ্যাত প্রায় প্রত্যেকটি নাটকেই ললাটলিখন খ-াতে না পারার দুর্বিষহ যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠতে দেখা যায়। ফলে মানুষ এবং দেবতাদের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিটিও। সফোক্লিস তার নাটকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিশেষত অন্তিমপর্বে সুকৌশলে পৃথিবীর মানুষের কাছে অসংখ্য প্রশ্ন ছুড়ে দেন, যার কিছু উত্তর খুঁজে পাওয়া আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও বেশিরভাগ প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। নাটকের প্রধানতম চরিত্রগুলোকে তিনি বারবার নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করেন।
তৎসময়ের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সফোক্লিসের দুর্বলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কেননা, গ্রীসের রোগ-আরোগ্যের দেবতা এসক্লেপিয়াসের নামে যে সময় উপাসনা প্রচলন ছিল, সফোক্লিস সে সময় দেবতা এসক্লেপিয়াসের মন্দির নির্মাণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং মন্দিরের কাজ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উপাসনা-প্রত্যয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। দ্বিধাহীনভাবে রাজনৈতিক ময়দানেও তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। সালামিসের নৌযুদ্ধে যেবার পার্শিয়ানদের পরাজিত করল এথেন্স সেবারের বিজয় গৌরবকে স্মরণীয় করে রাখতে দেশের প্রতিশ্রুতিশীল বালকদের সহযোগে একটি কোরাস সঙ্গীত রচনা করেন সফোক্লিস এবং মাত্র পনেরো বছর বয়েসে সেই কোরাস দলের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে নিবার্চিত হন তিনি।
নাট্যচর্চার সূচনাকালে সফোক্লিস নাটকবিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞানলাভ করেন সেকালের সবচেয়ে খ্যাতনামা নাট্যবোদ্ধা ও গ্রীসের প্রথম ট্র্যাডেজি নাটকের রচয়িতা ইস্কিলাসের কাছে। ইস্কিলাসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস এবং যোগ্যতা সে সময়ের কোনো নাট্যকারেরই ছিল না। অথচ যৌবনকাল অতিক্রান্ত হতে না হতেই ইস্কিলাস আধিপত্যের সুকঠিন নাট্যব্যুহ ভেঙ্গে দেন তরুণ নাট্যজন সফোক্লিস। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে দেশের গুরুত্ববহ অনুষ্ঠান ডায়োনিসাসের উৎসবে আয়োজিত নাট্য প্রতিযোগিতায় সফোক্লিস তার গুরুতুল্য অগ্রজ নাট্যকার ইস্কিলাসকে পরাজিত করে বিজয়মাল্য ছিনিয়ে আনেন এবং সর্বমহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ইস্কিলাসের মতো প্রবীণ ও বোদ্ধা নাট্যকারকে পরাজিত করার মতো অসাধ্যকে সাধন করে সফোক্লিস সৃষ্টি করেছেন অসীম বিস্ময়, কুড়িয়েছেন প্রশংসা-স্তুতি; সেই সঙ্গে অজস্র তর্কবির্তকেরও জন্ম দিয়েছেন সেদিন। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। ফলে জীবদ্দশায় ডায়োনিসাসের সেই উৎসবের পরিশ্রমলব্ধ নাট্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কারটি আরও ২৩ বার কুড়িয়ে এনেছেন তিনি। এই বিরল গৌরব অর্জনের ক্ষেত্রে তার ইদিপাস ট্রিলজি (সফোক্লিসের ‘ইদিপাস’, ‘কলোনাসে ইদিপাস’ ও ‘আন্তিগোনে’ নাটক ত্রয়ীকে একত্রে ইদিপাস ট্রিলজি বলা হয়; কেননা প্রত্যেকটি নাটকই একই সূত্রে গাঁথা এবং একই চরিত্রে পরম্পরাও অভিন্ন) দারুণ ভূমিকা পালন করেছে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দিকে গ্রীক নাট্যাঙ্গনে যখন সোনালি যুগ চলছিল তখন খ্যাতির শীর্ষে থাকা সফোক্লিসকে পরাভূত করতে এথেন্স নগরীর বিরল প্রতিভাধর আরেক নাট্যজন ইউরিপাইসিস বহুবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কিন্তু রীতিমতো ব্যর্থ হয়ে ফিরেছিলেন তিনি। কেননা, সফোক্লিসের জীবৎকালে ইউরিপাইসিস কখনই তার মতো এত জননন্দিত হয়ে উঠতে পারেননি। পারেননি তাকে পরাজিত করতেও।
সফোক্লিস ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, নিরহঙ্কারী ও কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি। প্রখর মেধাশক্তি এবং প্রবল নীতিবোধের দৌলতে কৈশোরকাল থেকেই সকলের কাছে প্রণম্য এবং গ্রহণীয় ব্যক্তি হয়ে ওঠেন তিনি। সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেলের পদমর্যাদা থেকে শুরু করে ডেলিয়ান কনফেডারেশনের কোষাধ্যক্ষের (রাজকীয় কোষাধ্যক্ষ) দায়িত্বও অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন তিনি। তাছাড়া বংশানুক্রমিকভাবেই তিনি ছিলেন ধনাঢ্য ঘরের সন্তান। তার পিতা সোফিলাল এথেন্সের একজন বিত্তশালী ও অস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। তারপরও তার চাহিদা ও রুচিবোধ ছিল নির্মল, নিষ্কলুষ মানুষের মতো সাধারণ। গবেষকদের বক্তব্য মতে, অবিশ্বাস্য হলেও কথাটা ধ্রুব সত্য যে, নাট্যকার সফোক্লিস যতকাল লেখালেখি ও রাষ্ট্রিক পদমর্যাদায় অভিষিক্ত ছিলেন ততকাল পর্যন্ত এথেন্স নগরীতে স্বর্ণময় হাওয়া বিরাজ করছিল। রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকেও ঘটেছিল আমূল পরিবর্তন। কিন্তু সফোক্লিসের মৃত্যুর পর সে ঐতিহ্য ধীরেলয়ে ম্লান হতে শুরু করল। এথেন্স নগরীতে পড়তে লাগল নির্মম অন্ধকারের ছায়া। নগর রাষ্ট্র হতে শুরু করে রাজনীতি এবং অর্থনীতিতেও চরম ধস নামতে লাগল। এ ঘটনা থেকেই অনুমান করা সহজ, সফোক্লিস কতটা গুণী, দক্ষ এবং সৌভাগ্যবান মানুষ ছিলেন।
সফোক্লিসের নাট্যখ্যাতি এবং তার সৃষ্টিকর্মের প্রভাব বিশ্ববাসীর মনে কতটা বিলোড়ন সৃষ্টি করেছে সেটার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মেলে স্পার্টার এক সৈন্যবাহিনীর প্রধানের ব্যতিক্রম শ্রদ্ধা প্রদর্শন থেকে। সফোক্লিসের মৃত্যুর সমসাময়িক মুহূর্তে অর্থাৎ ৪০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স নগরীতে আক্রমণ চালিয়েছিল স্পার্টা সৈন্যদল। চারদিকে বেজে উঠেছিল যুদ্ধের দামামা, ভীতিপ্রদ মুহূর্ত নেমে এসেছিল জনজীবনে। এরই মধ্যে সফোক্লিস পরলোকগমন করলেন। সে খবর উড়ে এলো স্পার্টা সেনাপ্রধানের কাছে। এথেন্স নগরীর কৃতী সন্তান, বিশ্বনন্দিত নাট্যজন সফোক্লিস মারা গেছেন এবং তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনপর্বের প্রস্তুতি চলছে; এমন সংবাদ পেয়ে স্পার্টা সেনাপ্রধান হঠাৎ করেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেন। এরূপ সিদ্ধান্ত যুদ্ধেক্ষেত্রে বিরল এবং অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তারপরও নাট্যাঙ্গনের সদ্যপ্রয়াত এক কিংবদন্তির বিদেহী আত্মার সম্মানার্থে সাময়িককালের জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মাধ্যমে শত্রুরাষ্ট্রের কোন কীর্তিমান পুরুষের মৃতদেহের প্রতি যে ভক্তিমিশ্রিত উদার শ্রদ্ধা নিবেদনের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তিনিÑ এমন ইতিহাস তাবৎ পৃথিবীতে আর একটাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।