ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

মোঘল গীবত ॥ ধারাবাহিক উপন্যাস

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

মোঘল গীবত ॥ ধারাবাহিক উপন্যাস

(পূর্ব প্রকাশের পর) - সাবধান! মুখ সামলে কথা বলুন মন্ত্রীজী। হতে পারে সম্রাট স্বয়ং আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন কিন্তু ভুলে যাবেন না আপনি সম্রাটের ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। ঢোঁক গিলে মুখ কুঁচকালেন মুরাদ। অজান্তে তাঁর হাত চলে গেছে কোমরে গোঁজা খঞ্জরে। আনমনে দুঃখের হাসি দিলেন আলী নকী। শুধু বাদশাহ শাহজাহান নয়, জাহাঙ্গীরের দরবারেরও সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণেই বাদশাহ তাঁকে এখনও রাজকাজে নিয়োজিত করে রেখেছেন। দীর্ঘদিন আর্জি জানিয়ে আসছেন- বয়স হয়েছে, এবার যেন তাঁকে ছুটি দেয়া হয়। জীবনের শেষ সময়টা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহ’তে কিংবা মক্কা শরীফে কাটিয়ে দেয়াই ছিল তাঁর মনের ইচ্ছে। কিন্তু প্রিয় বন্ধু সম্রাট শাহজাহান পাঠালেন তাঁর ছোট ছেলের ভালমন্দ দেখভাল করতে। অথচ শেষ বয়সে এসে দেখতে হচ্ছে যুবক শাহজাদার অপরিণামদর্শিতা। বংশের শেষ সন্তান হিসেবে রাজ সিংহাসনে বসার এই কুমতলব কে ঢোকালো মুরাদের ভেতর? আলী নকীর মনে হলো তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। -মহামান্য আমাকে মার্জনা করবেন। কি করে ভুলি আপনি কার সন্তান। শুধু তাই নয়, আপনি তো বয়সে আমারও সন্তানতুল্য। যাই হোক। আজ আমি যাই। অনেক জরুরী কাজ পড়ে আছে। আপনার মেজাজ-মর্জি একটু সুস্থির হলে আমাকে ডেকে পাঠাবেন।’ আলী নকী উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন। - দাঁড়ান। হুংকার দিয়ে উঠলেন মুরাদ। ‘আপনার এতো বড় আস্পর্ধা আমার কথা শেষ না হবার আগেই আপনি চলে যাচ্ছেন? আপনি জানেন আমি কে এবং কি করতে পারি আপনার? - আহ! কি মুশকিল মহামান্য। কেন এক কথা বারবার বলছেন? আমি কি বলেছি আমি জানি না আপনি কে? কিন্তু কিসের এতো পেরেশানে আপনি এতো অস্থির হয়ে আমাকে খামোখা হেনস্থা করছেন? আমি তো বললাম আপনি সুস্থির হন। তারপর আমি আপনার সঙ্গে এইসব বিষয়ে আলাপ করবো...। মেহজাবীন খাটিয়ায় চোখ বন্ধ করে আরাম নিচ্ছিলেন। সারা রাতের পরিশ্রমে হাল্কা ঘুম চলে এসেছিল তার। মনে করতে চেষ্টা করছিলেন গত রাতে শাহজাদার সঙ্গে কিভাবে ঝড়ো সময়টা পেরিয়ে গেল। ভালোবাসার ওই সময়টা আরও দীর্ঘ হলে ভালো হতো। অনেক পাকা প্রেমিক শাহজাদা। আফিমের নেশায় বুঁদ থাকলেও ঠিক জানেন কিভাবে প্রেম আদান-প্রদান করতে হয়। প্রতিবারই তার নাম ভুলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ভোরে আলী নকী প্রসঙ্গে কথাটা শোনার পরই পাগলের মতো অস্থির হয়ে উঠলেন। হঠাৎ বাগানে উচ্চকন্ঠের আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকালেন মেহজাবীন। দেখলেন প্রাসাদের বারান্দার ঘুলঘুলির ফাঁকে চোখ রেখে বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে বুলন্দ। মেহজাবীন বিছানা ছেড়ে উঠে এসে বুলন্দের পাশে সেই দৃশ্য দেখার জন্য উঁকি দিলেন। - কি হচ্ছে ওখানে বুলন্দজী! ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন মেহজাবীন। - কিসসু না বেটিয়া। বাগানের দিকে চোখ না সরিয়ে বুলন্দ বললো, ‘আলী নকীকে শাহজাদা আজ উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন। বুড়া বজ্জাত ব্যাটার দিন শেষ...।’ তারা দু’জনেই দেখলো আলী নকী উল্টা ঘুরে হেঁটে চলে যেতে চাচ্ছেন আর মুরাদ কোমরে হাত দিয়ে চিৎকার করে তাঁকে কিছু বলছেন। দূরত্বে থাকাতে মুরাদ-আলী নকীর বাদানুবাদ তারা পুরোপুরি শুনতে পারছে না। তবে শারীরিক ভাষা আর মুখের ভঙ্গিতে বোঝার চেষ্টা করছিল ধূর্ত বুলন্দ। পাশ থেকে মেহজাবীন বললেন, -দেখুন আলী নকী হুজুরকে কি মলিন দেখাচ্ছে। আহা, তিনি দেখতে হুবহু আমার দাদাজানের মতো সুন্দর। এমন মানুষটার নামে না বুঝেই আমি নালিশ দিয়েছি। চলুন না আমরা গিয়ে শাহজাদাকে ফিরিয়ে আনি...’ - ইশশশশ ... দরদ কতো? এটা তোমার-আমার ব্যাপার নয়। সাপের মতো হিসহিসিয়ে উঠলো বুলন্দ। আড়চোখে মেহজাবীনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, ‘আচ্ছা এই কথা! শাহজাদার জন্য এত্তো ভালোবাসা। তা কতবার হলো ওটা... হ্যাঁ ...।’ এরপর ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গি করে মেহজাবীনের কোমর জড়িয়ে ধরে তার স্তনবৃন্ত চিমটি দিয়ে মুচড়ে দিলো বুলন্দ। বুলন্দের এই শয়তানী পছন্দ করলেন না মেহজাবীন। সরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন। এমন অসভ্যতা তার সঙ্গে বুলন্দ আগে কখনো করেনি। মুরাদের আলী নকী-বধ সবরমতী নদীর পাড়ে শাহজাদা মুরাদের এই বাগানটি প্রাসাদ-সংলগ্ন পাঁচিলে ঘেরা। ওপর থেকে দেখলে সবুজ দ্বীপের মতো মনে হয়। প্রাসাদের পোষা ময়ূরগুলো বাগান জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। পায়রার ঝাঁক তো আছেই। মাঝে মাঝে খুব গরম পড়লে বাগানের ভেতর সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে আফিম-সুরা-তামাক খেতে খেতে দরবারের কাজ করতে পছন্দ করেন তিনি। কাজ বলতে প্রিয় অমাত্যদের সঙ্গে গল্প-গুজব। বাগানের প্রবেশ মুখে কালো গোলাপের ঝাড়। চার কোনায় সুবিন্যস্তভাবে লাগানো আছে খেজুর গাছ আর ঠিক মাঝখানে গোল করে ঝোপ বেঁধেছে কমলা গাছের সারি। বলা যায়, এটা মুরাদের খাস বাগান। কিন্তু ১৪১১ সাল হতে আহমদ শাহের বানানো কেল্লা আর দুর্গের প্রাচীন নগর এই আহমেদাবাদ মুরাদকে আকর্ষণ করে না। বিশেষ করে মুঘলদের বিশেষ গর্বের ধন ভাদ্রা দুর্গ ছাড়াও নাগিনবাগ, কানকারিয়া দীঘি, মোতিশাহী মহল বা তিন দরজাওয়ালা কেল্লা কিছুই মুরাদের মন ভরানোর জন্য যথেষ্ট নয়। দিল্লী-আগ্রা’র মতো জৌলুষ কি আর মারাঠিদের আছে? -আলাপের আর কিছুই বাকি নেই! এতই যদি সব বোঝেন তবে বলুন মন্ত্রী সাহেব, বিশ্বাসঘাতক আর নিমকহারামের কি শাস্তি হতে পারে? অধৈর্যের সুরে মুরাদ জিজ্ঞাসা করলেন। - কেন, অবশ্যই মৃত্যুদণ্ডÑ জবাব দিলেন সঙ্গে সঙ্গে আলী নকী। - আপনি নিশ্চিত হয়ে কথাটা বলছেন তো? - আলবত মহাত্মন, এই ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই সাম্রাজ্যের সঙ্গে যে বা যারা বেঈমানী করবে এই কবিরা গুনাহ মোটেও ক্ষমার যোগ্য নয়। তা না হলে রাজ্যে অরাজকতা সৃষ্টি হবে তাতে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু এই কথা আপনি আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করছেন হুজুর! সামান্য বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন মন্ত্রী। হঠাৎ দ্বিগুণ ক্রোধে চিৎকার করে মুরাদ পোশাকের ভেতর হতে একটা মোড়ানো কাগজের চিঠি আলী নকীর মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরে বললেন, -তবে এটা কি হারামখোর! আমার কেল্লায় থেকে আমার বিরুদ্ধে তুই ষড়যন্ত্র করিস! দারা শিকোর সঙ্গে যুক্তি করে বাদশাহের মৃত্যু সংবাদ রটিয়ে দিয়ে আমাকে সিংহাসনের উত্তরসূরীর পদ হতে হটাতে চাচ্ছিস! এটা কি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা নয়? মুরাদ সর্বাংশে তাঁর মেজাজ হারালেন। চিঠিটা খুলেই ক্ষণিকের জন্য বৃদ্ধ মন্ত্রী হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। এটা কি করে সম্ভব? এই মাতাল যুবরাজটা কি বলছেন? তাঁর হাতের লেখা ও স্বাক্ষর নকল করে শাহজাদা মুরাদের বিপক্ষে অভিযোগে সাজানো এই চিঠিটা তাঁর নিজ হাতের লেখা হতেই পারে না। কিন্তু মুরাদ এটাই বিশ্বাস করে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে রাগে থরথর করে কাঁপছেন আর অকথ্য ভাষা প্রয়োগ করছেন। হায়! এই কি বাদশাহ শাহজাহানের সন্তানের নমুনা! আলী নকী বুঝে গেছেন এক ভীষণ দুর্যোগের মুখে তাঁকে ঠেলে দিয়েছে বুলন্দ-খাসেগীদের চক্র। দাড়িতে অস্থিরভাবে হাত বুলিয়ে চিঠিটার আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন আলী নকী। নিমিষেই চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তাঁর। - মহামান্য দেখুন দেখুন... চিঠিটায় তাঁর স্বাক্ষর নির্দেশ করে বলতে থাকলেন তিনি- (চলবে)
×