ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম কিবরিয়া পিনু

রফিকুল হক তাঁর সৃজনশীল স্পর্ধা

প্রকাশিত: ০৬:২১, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

রফিকুল হক তাঁর সৃজনশীল স্পর্ধা

প্রখ্যাত ছড়াকার রফিকুল হকের ৮১তম জন্মদিন ৮ জানুয়ারি, তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩৭ সালের এই দিনে। তিনি দাদুভাই নামে সমধিক পরিচিত। আমাদের প্রিয় মানুষ। আমরা যারা কিশোর-তরুণ বয়সে লেখালেখি শুরু করেছিলাম, তাদের অনেকে এই মানুষটির কাছ থেকে অনুপ্রেরণা, উৎসাহ ও সহযোগিতা পেয়েছিলাম। আমিও তাদের মধ্যে একজন। শিশু-কিশোর সাপ্তাহিক ‘কিশোর বাংলা’ তার সম্পাদনায় বের হতো, সময়টা ছিল সত্তর দশকের শেষের, কী জনপ্রিয় ছিল পত্রিকাটি তখন। রঙিন আর বিভিন্নধর্মী লেখায়-রেখায় সমৃদ্ধ ছিল ‘কিশোর বাংলা।’ আমি তখন অবস্থান করতাম গাইবান্ধায়, পোস্টে লেখা পাঠাতাম, তিনি যতœসহযোগে ছাপতেন, ছড়া-গদ্য এমন কী খবর। বিশেষ সংখ্যায়ও আমার লেখা ছাপিয়েছেন তিনি। কী এক প্রেষণা নিয়ে আমি সেদিন ‘কিশোর বাংলা’র সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছিলাম, তা মনে হলে আজও শিহরিত হই, আর এর মূল কেন্দ্রভূমি ছিলেন ‘দাদুভাই’। এরপর ঢাকায় যখনই দেখা হয়েছে, মুহূর্তে কাছে টেনে নিয়েছেন, সম্পর্কের উষ্ণতা কমেনি বলে মনে হয়। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকা আমাদের স্বাভাবিক। তার জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধা ও শুভকামনা। রফিকুল হক ছড়াসাহিত্যে শক্ত ও দৃঢ় অবস্থান নিয়ে আছেন। আমাদের দেশে যারা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী, তাদের মধ্যে তিনি শুধু অন্যতম নন, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী। শব্দ, ছন্দ ও আঙ্গিকের কারণে তার ছড়া আলাদাভাবে চেনা যায় ও আলাদা ধরনের স্বাদ থাকে তার ছড়ায়। পঞ্চাশ দশক থেকে তিনি ছড়া লিখে আসছেন। ভাষা আন্দোলনের অভিঘাত নিয়ে পরবর্তীতে সমাজজীবন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ছড়া লিখেছেন, তবে শিশুতোষ ছড়া লেখা থেকে তিনি দূরবর্তী থাকেননি। গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় নিয়ে ‘বর্গী এলো দেশে’ নামের বইটি ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়, এটি তার প্রকাশিত প্রথম বই। রফিকুল হকের প্রথম বই যেমন দেরিতে বের হয়েছে, তেমনি বইয়ের সংখ্যা লেখার তুলনায় এখন পর্যন্ত কম। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছড়ার বই হলোÑপান্তা ভাতে ঘি, ঢামেরিক ও আমপাতা জোড়া জোড়া। ‘কট্টুস’ নামের কয়েক শত ভিন্ন মেজাজের ছড়া লিখেছেন, যাতে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনার ধারাবাহিক ছাপ পড়েছে, যা বই হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া তার শিশুতোষ গদ্যের বই রয়েছে। সব শেষে আমাদের হাতে এসেছে এ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত ‘মজার পড়া ১০০ ছড়া’ গ্রন্থটি, এটি বের হয় ২০১৫ সালে। ‘বর্গী এলো দেশে’ নামক বইয়ে লিখেছেন এমন ছড়াÑ ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই সিসের বুলেট বুকে বিঁধলো মরতে কি ভয় পাই? বাপ মরেছে মা মরেছে রক্ত ভরা নদী ভেসে গেছে সেই নদীতে রক্ষপুরের গদি।’ গণআন্দোলনের পটভূমিকায় উল্লিখিত ছড়া লিখেছেন তিনি সাহস আর শোষকের বিরুদ্ধ চেতনায়, সেই সঙ্গে শ্রেণীসচেতন ছড়াও লিখেছেন ‘বর্গী এলো দেশে’ বইয়ে, যেমন- ‘তাঁতী পাড়ায় বাতি নেইকো সূূর্যি বসে পাটে, সুতো কিনবো মুরোদ কোথা বাতি নেইকো হাটে।’ ১৯৭১ সালে তার লিখিত ‘খিজির খাঁ’ নামক ছড়ায় শাসকের চরিত্র ও তৎকালীন অবস্থাকে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন : ‘ক্ষীর নদী আর পায়েশে বেশ তো আছো আয়েশে. মন্দ কী হে খিজির খাঁÑ আমরা তো বেজির ছা! গামছা পরা চামচারা সব তোমার আসল মদদগার, বিলাস বসন এবং আসন মেজাজ ভারি চমৎকার। চামচা ওরে চামচা বেজিতে দেয় খামচা খবর কী হে খিজির খাঁ- প্রাণটা নিয়ে বাড়িত যা!’ সেই সময়ের পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, তাদের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের ঘৃণা ও পুঞ্জীভূত ক্ষোভ উল্লিখিত ছড়ায় তিনি টেনে এনেছেন। বাংলাদেশের সেই সময়ের মূলধারার সকল ছড়াকার স্বদেশভূমির ওপর শোষণ ও বৈষম্যের প্রতি সোচ্চার শুধু নয়, বাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার বোধকে বিকশিত করতে ভূমিকা রেখেছেন। সাহিত্যের এটা এক প্রধান কাজ, যা থেকে লেখকরা দূরবর্তী অবস্থানে থাকতে পারেন না। বাংলাদেশের লেখকরা সেই ঐতিহ্যের পথ ধরে সব সময়ে চলেছেন। তার আরও অনেক ছড়ার উদাহরণ টেনে আনা যায়, টেনে আনা যায় ছন্দের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার, তার একটি ছড়ার উদাহরণ, ‘পান্তা ভাতে ঘি’ বইয়ে লিখেছেন- ‘কাককে বলে কাউয়া, নাপিত বলে নাউয়া, বাঁ হাতে যেই ঢিল ছুড়েছো- বলবে, ‘তুমি বাঁউয়া!’ তিনি আরও লিখেছেন- ‘পু ঝিক্ ঝিক্ পু ঝিক্ ঝিক দেশ ঘুরবি চল নির্ভীক।’ বাংলা সাহিত্যে যে ছড়ার ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তারই ধারাবাহিকতার সাজুয্যে তিনি তার ছড়ার জগত নির্মাণ করলেও সৃজনশীলতার নিজস্ব ছাপ রেখেছেন জোরালোভাবে। তবে তিনি ছোট ছোট চরণে ছড়া লিখেছেন, তার ছড়ায় তিনি শব্দকে বেশ মেপে মেপে ব্যবহার করেছেন, এই বৈশিষ্ট্য তার এক সচেতন সৃজনশীল-স্পর্ধা, যা তার ছড়ার পাঠক হিসেবে আমরা বিবেচনা করতে পারি। উদাহরণ ‘ছাড়াছাড়ি’ নামক একটি ছড়া : ‘জড়াজড়ি গড়াগড়ি কাদামাটি ছড়াছড়ি। হাতাহাতি মারামারি পরিণতি ছাড়াছাড়ি।’ কী এক জাদু মেখে দৃশ্যকল্প তৈরি করে, মিলবিন্যাসের চমৎকার যোজনা করে, গভীর এক ম্যাজেস প্রদান করে ছড়া গড়ে তুলেছেন, যা একজন শক্তিশালী ছড়াশিল্পীর পরিচয় মেলে ধরে। এ রকম অনেক উদাহরণ টেনে আনা যায়। ছড়ার আঙ্গিক নিয়ে বহু রকমের ভাঙ্গা-গড়া ও বৈচিত্র্য রয়েছে তাঁর। মিল ও শব্দের সাজুয্যে তিনি পাঠককে এমন স্পর্শ দিয়ে আন্দোলিত করেন, যা এমন এক জগতে নিয়ে যায়, তা থেকে পাঠক আর এক অনুভবসিক্ত হয়ে বোধের জগত তৈরি করে নেন। তার ছড়া যেমন কান দিয়ে শুনে স্বাদ নিতে পারা যায়, তেমনি চোখ দিয়ে পড়েও অনুভব করা যায়, এই দুইয়ের সম্মিলনে রফিকুল হক তার ছড়াকে ভিন্নমাত্রায় উপস্থিত করেছেন। ‘ভিন্ন ছবি’ ছড়াটিতে তার উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়- ‘হারোডাঙ্গার বিল রাশি রাশি গাঙচিল ঝাঁকে ঝাঁকে পাক দিয়ে উড়ছে উড়ছে উড়ছে, হারোডাঙ্গার বিল মাছ করে কিলবিল দলে দলে নীল জলে ঘুরছে ঘুরছে ঘুরছে। হারোডাঙ্গার বিল সে ছবির নেই মিল দৃশ্যটা একবারে ভিন্ন ভিন্ন ভিন্ন হারোডাঙ্গার বিল নেই মাছ নেই চিল বিলটার নেই কোন চিহ্ন চিহ্ন চিহ্ন। রফিকুল হক বাংলা ছড়া সাহিত্যের মূলধারার বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে বিভিন্ন নিরীক্ষা করেছেন, তার ছড়ার আঙ্গিক এত বৈচিত্র্যময়, যার জুড়িমেলা ভার। বিষয় বৈচিত্র্যও বিভিন্ন স্বাদের। শিশুতোষ ছড়া থেকে রাজনৈতিক-সমাজ সচেতনমূলক ছড়ায় তার প্রমাণ মেলে। বাংলাদেশের ছড়ার মূল ভূমি আজ বিকশিত হয়ে যে উজ্জ্বল হয়ে দেদীপ্যমান, সেখানে রফিকুল হকের শ্রম-সাধনা ও ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে সম্পর্কিত, তা ছিন্ন করা যায় না, যাবে না। রফিকুল হকের পিতার বাড়ি রংপুর শহরের কামালকাচনায়। আদিনিবাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার শহরে। তার শৈশব কেটেছে কুচবিহার শহরে, সেখানেই স্কুল জীবনের শুরু, তারপর রংপুরের কৈলাশ রঞ্চন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা, সেখান থেকে মেট্রিকুলেশন শেষ করে কারমাইকেল কলেজে লেখাপড়া। তিনি দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। এখন তিনি দৈনিক যুগান্তরের ফিচার সম্পাদক। তিনি ছিলেন শিশু-কিশোর সংগঠন চাঁদের হাটের প্রতিষ্ঠাতা। ১৪০৫ বঙ্গাব্দে অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কারসহ দেশে ও বিদেশে অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৯ সালে শিশুসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তাঁকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। রফিকুল হক দাদুভাইয়ের জন্মদিনে, তার সুন্দর ও সুস্থ জীবন কামনা করি। তিনি সক্রিয় থাকুন তার সাহিত্য কর্মকাণ্ডে সেই শুভ আকাক্সক্ষা রইল আমাদের।
×