ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী আলিম-উজ-জামান

জীবন যখন আনন্দময়

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

জীবন যখন আনন্দময়

(গত সংখ্যার পর) ‘এ আপনার বুড়ো বয়সের ব্যামো। মানুষ এতে রাজি হবি না নে।’ বেশ জোরের সঙ্গে বললেন সামাদ মিয়া। এ বলার মধ্যে ছিল তাচ্ছিল্য। ‘শোনেন ভাই সকল, আমি কেবল একটি প্রস্তাব দিয়েছি মাত্র। কোনো সিদ্ধান্ত দিইনি। আমার সে ক্ষমতাও নেই। এবার আপনারা আলোচনা করেন। তবে আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, গ্রামে জমি কমে যাচ্ছে। মানুষ বাড়ছে। ভাগ ভাগ হয়ে এমন দশা হয়েছে, যেখানে না লাগনো যায় ফসল, না কাটা যায় একটা পুকুর। তাহলে মানুষ খাবে কী! কিনে আর কত দিন! তাই আমি ভাবছিলাম গ্রামের মানুষেরা যদি একটা জায়গায় বসবাস করে বাকি জায়গা ফসলের জন্য ছেড়ে দেয়, আর সে জায়গায় যদি চাষাবাদ করা যায়, তাহলে খুব ভালো হয়। এবার সবাই যেন মুগ্ধ হয়ে শোনে চেয়ারম্যানের কথা। সবাই যেন অচেনা একজন চেয়ারম্যানকে দেখছে। ধরেন, আমাদের যদি টাকা থাকতÑআমরা একটা জায়গার মধ্যে ছয়তলা বিল্ডিং করতাম দশটা, তবে পুরো গ্রামের মানুষ সেখানে একসঙ্গে থাকতে পারতাম। পাশে বানাতাম তিনটা বড় পুকুর, মসজিদ, মন্দির, স্কুল, কবরখানা। কৌতূহল চেপে রাখতে পারেন না লতিফ মিয়া। ‘এ তো আপনার ভারি বুদ্ধি। শহরে যেমন করে বসবাস করে মানুষ।’ পরক্ষণেই আবার রোদে পোড়া ডাঁটাশাকের মতো চুপসে যায় লতিফ, ‘এ তো ম্যালা টাকার মামলা। এত টাকা আমরা কোথায় পাব?’ তারপরও মাসুদা মেম্বারের খুব পছন্দ হয় আইডিয়াটা। ‘তা ভাইজান, এর মধ্যে বাচ্চা-কাচ্চাদের জন্যি কিছু খেলনাÑকিছু দোলনা রাখা যায় না।’ হাসনা মেম্বার বলে, ‘হ্যাঁ, বাচ্চাদের পার্ক, শহরে যেমন থাকে। ওরা খুব খুশি হবে নে।’ ‘একপাশে যদি কিছু ফুলের গাছ থাকে তবে ভালো হয়। দোলনচাঁপা, কামিনী, কাঁঠালিচাঁপা, রাত্রির বেলা শুকতি ভারি ভালো লাগে। রেহানা মেম্বারের এ কথায় খটমট করে তাকায় সামাদ মেম্বার। ‘মানুষ পাচ্ছে না খাতি, ওনার লাগবে ফুল গাছ!’ ‘আমার একখান কথা আছে।’ হাসিব মেম্বার কিছু একটা বলতে চান। শিক্ষিত মানুষ বলে আলাদা একটা সম্মান পান হাসিব মেম্বার। ভোটের আগে নির্বাচনী পোস্টারে বরাবরই তিনি লেখেন, ‘ভোট দিলে হাসিবে, গ্রামের মানুষ হাসিবে। আবদুল হাসিব, বিএ, বিপিএড।’ স্কুলের শরীরচর্চা শিক্ষক ছিলেন তিনি। ছেড়ে দিয়েছেন। তার এই বিপিএড অনেকের কাছেই গোলকধাঁধা। ‘একখান বড় খেলার মাঠ কিন্তু থাকতি হবে। ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেটÑসব হবে।’ ‘সবাই যখন এত কথা বলতিছে, আমি আর বসে থাকি কেন। প্রত্যেকটা বিল্ডিংয়ের সামনে কয়েকটা বসার জায়গা করেন। আমরা বুড়োরা একটু গিদ্দা মাইরে বসপো।’ এ সময় উতাল চেয়ারম্যান টিপ্পনী কাটেন, ‘সামাদ ভাই, আপনি এতো বুড়ো হননি। আপনার মার বিয়ে কিন্তু আমি খেয়েছি। সে কথা ভুলে যাবেন না।’ ‘অ, শুনিছি আপনি আপনার বাপের কান্ধে চইড়ে আমার মার বিয়েতে গেছিলেন। তখন আপনার বয়স তিন-চারের কম না।’ থমথমে গম্ভীর অবস্থা থেকে বেশ একটা হাসি-আড্ডায় রূপ নেয় এই সভা। ‘কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব’, সামাদ মিয়া বলেন, ‘মানুষ তো মনে করবে আপনি তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে চাচ্ছেন। মানুষকে তো বোঝানো কঠিন কাজ। মা-বাপের কবর, ভিটেমাটিÑএসব তো কেউ ছাড়তে চায় না।’ ‘তা ঠিক।’ চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, ‘কিন্তু সামাদ ভাই, আপনি আপনার দাদার বাপের নাম বলতে পারবেন?’ ‘না, পারব না। মনে নেই।’ ‘লতিফ ভাই পারবেন, গোলাম মোস্তফা, হাসনা তোমরা? কেউ পারলেন না। অথচ মোটে ৭৫-৮০ বছরের ব্যাপার। আপনার দাদার বাপ আপনার থেকে বড়জোর ৭৫-৮০ বছরের বড় হবে। মোটে ৮০ বছরের আগের খবরই আমরা ভুলে বসে আছি।’ ‘শোনেন ভাই, বর্তমান সময়ের প্রতি এবং ভবিষ্যৎ সময়ের প্রতি আমাদের প্রত্যেকেরই একটা দায়িত্ব আছে। আছে কি না! আমরা কেউই সেই দায়িত্ব পালন করি না। সংসার, জীবনযাপন, ছেলেমেয়ে মানুষ করা, তাদের জন্য সহায়-সম্পত্তি করে যাতি পারলেই আমরা খুশি। সবাই খুশি। কিন্তু আমরা কেউ ভাবি নাÑআপনার ছেলেমেয়ের ধন আছে, মান আছে; আমার ছেলেমেয়ের যদি তা না থাকে, লতিফ মিয়ার ছেলেমেয়ের না থাকে, তবে কীভাবে আপনার ছেলেমেয়ে শান্তিমতো সমাজে বাস করবে। তাই আমাদের ভাবতে হবে সবার কথা। সবার কথা ভাবতে গিয়ে যদি গুটিকয়েক মানুষের অসুবিধা হয়, তো হোক। কী আর করা!’ ‘বুঝলাম চেয়ারম্যান সাহেব।’ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘জাগো জমিজিরেত নেই, তাগো কী হবে? এতক্ষণ ধরে সবার কথা শুনছিল আরব আলী। ‘এ প্রশ্নের উত্তর আপনিই দেন। আপনি প্রশ্ন করিছেন আপনিই দিন। আর আপনি না পারলি আমি দিই। তাগো কাইটে গাঙ্গে ভাসায়ে দেন। ব্যাটা, তোগো জমি নেই, তোরা খারাপ, তোগে বাপ-মা-দাদা চৌদ্দ পুরুষ খারাপ।’ গোলাম মোস্তফা জবাব দিতে ছাড়েন না। ‘আরব আলী, তুমি একটু বেশি কথা কও। চেয়ারম্যান সাহেব ভালো মানুষ, তাই তোমারে কিছু কয় না। আমি হলি তোমার চাকরি ছুটায়ে দিতাম।’ উত্তেজনা প্রশমনের ভূমিকা নিতে হয় চেয়ারম্যান উতালুদ্দিনকে। ‘আরব আলী তুমি থামো। বাড়তি কথা বলবা না। মোস্তফা ভাই, মাথা গরম কইরেন না। তবে আপনি যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা খুবই যৌক্তিক। যাগো জমি নেই, তারা এই ব্যবস্থার মধ্যে কীভাবে আসবেÑসে প্রশ্ন আমারও। এখন আমাদেরই ঠিক করতে হবে তাদের জন্য আমরা কী করব।’ ‘আমার কাছে একটা সমাধান আছে। গত ২৫ বছর ধরে আপনারা আমাকে ভোট দিচ্ছেন। কিন্তু আমি আপনাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি।’ হাত তোলেন সামাদ মিয়া, ‘এই কথাডা মানতি পারলাম না। আমি আপনার অনেক কথা ও কাজের বিরোধিতা করে থাকি তা সত্য, কিন্তু মূলঘর ইউনিয়নের জন্য আপনি কী কিছু করেননি, তা মানা যাবে না।’ ‘সামাদ ভাই, যদি কিছু করে থাকি, তা তো আপনাদের দশজনের সহযোগিতায়। তবে আসল কাজ এখনো বাকি। আপনারা জানেন, আমার দুই ছেলে আগুন আর ফাগুন ইউরোপে থাকে, তারা আর এ দেশে আসবে কি না, জানি না। হয়তো আমার মরার খবর পালি আসবে। তাই আমি ঠিক করেছি, আমার সহায়-সম্পত্তির একটা অংশ আমি এই গ্রামের ভূমিহীনদের মধ্যে দান করব। যারা দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রামে আছেন, এই গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তারাই এই সম্পত্তির অংশ পাবেন।’ উতাল চেয়ারম্যানের ঘোষণায় উপস্থিত সবার চোখ-মুখ খুশিতে ভরে ওঠে। সবাই যেন আজ আনন্দভুবনের বাসিন্দা। মজার মানুষ গোলাম মোস্তফা বলে ওঠেন, ‘ও আরব আলী ভাই, আর এক কাপ চা কি পাওয়া যাবে?’ তা আমরাও আর বাদ থাকি কেন। হাসনা, মাসুদা, হাসিব মেম্বার গোলাম মোস্তফার কথায় সুর মেলান। চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমারেও এক কাপ দিও।’ আরব আলী হই হই করে ভেতর বাড়ি চলে যায় চা-বিস্কুটের আয়োজনে। ভৈরব নদীর ওপাশে কাঁঠালতলা গ্রাম। সেটা আবার অন্য ইউনিয়ন। এ পাশের গ্রামের নাম মূলঘর। উতাল চেয়ারম্যান ঠিক করেছেন, ভৈরব নদী ঠিক তার ছোটবেলায় যতটুকু চওড়া ছিল, ঠিক ততটুকু চওড়া আর খনন করা হবে। তারা তাদের ইউনিয়নের অংশটুকু কাটাবেন। পরে অন্য ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা যখন দেখবে পানি সব মূলঘরের দিকে, তখন তারাও কাজে নামতে বাধ্য হবে। আর এই কাটা মাটির ওপরই হবে মূলঘর গ্রামের বাসিন্দাদের নতুন আবাসভবন। গড়ে উঠবে সারি সারি ভবন। ভেতরে খেলার মাঠ, চওড়া সড়ক, বাগান, স্কুল, বড় কয়টা পুকুরÑসবই থাকবে। বাকি পুরো গ্রাম সবাই ছেড়ে আসবে ফসলের জন্য, গাছগাছালি পাখপাখালির জন্য। দিনে দিনে সৃজিত হবে গভীর বন। গাছ বড় হবে, বাড়বে লতা-গুল্ম ঘাস। নানা প্রজাতির পাখি, প্রাণীর অভয়াশ্রম হবে এই গ্রাম। মূলঘর স্কুলের কোনায়, পল্টুর মোড়ে, কালা বড়ালের চায়ের দোকানে কান পাতলেই শোনা যায় নানা আলোচনাÑহাসি-তামাশা। সু সু করে গরম চা-টা মুখের ভেতর টেনে নেন মোতাহার মিয়া। মুখে বক্র হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে, শুনিছো আনসার মল্লিক। চেয়ারম্যান নাকি আমাগো ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার মতলব আঁটিছে। আনসার জবাব দেয়Ñএরে কয় বুড়ো বয়সের ভীমরতি। সাবেক মেম্বার কালাম লুঙ্গির গিটটা শক্ত করে বেঁধে মোতাহারের গা ঘেঁষে বসে। ‘ওই মিয়া সরে বসো, ভদ্রতা-সভ্যতা কিছুই শিখলে না। কয়দিন পরে বাস করবা দালান বাড়িতে। পায়খানা, গোসল করবা ঘরের মধ্যে। আর এখনো? শিখল না কিছুই। তোমরা দেখি চেয়ারম্যানের এত ভালো কাজ সব ফেল খাওয়ায়ে দিবা।’ আনসার মল্লিকের এগিয়ে দেওয়া চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে কালাম মেম্বার বলে, ‘এর চেয়ে চেয়ারম্যান সাহেব যদি বলতেন, আমি একখান বিয়া করব এই বয়সে, তা হলিও এতটা ভেজাল হতো না। যে পরিকল্পনা উনি এঁটেছেন, এ কি যাই-তাই কথা!’ কিছুটা সলজ্জ ভঙ্গিতে কালা বড়াল বলে, ‘শুনিছি, আমাগো মতো মানুষেরাও দালানে থাকবে।’ গর্জে ওঠে মোতাহার মিয়া, ‘অ, সেই আশায় থাকো। চা বেইচে খাও। তাই খেয়ে যাও। বেশি লোভ কইরো না।’ ধমক খেয়ে চুলাটা আরেকটু হাঁকিয়ে দেয় বড়াল। টগবগ করে ফুটতে থাকে চায়ের পাতি। কালা বড়াল নিজে অবশ্য আশ্চর্য রকম শান্ত। উতালুদ্দিন চেয়ারম্যানের নতুন এই উদ্যোগের কথা কেবল নিজ মূলঘর ইউনিয়নে আটকে থাকে না। খবরটি ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের জেলায়ও। সরকারি কর্মকর্তাদের কানেও খবরটি যায়। ফকিরহাটের ইউএনও সাহেবও খবরটি তার এক কর্মচারীর মাধ্যমে জানতে পারেন। শুনে নাকি তিনি কিছু বলেননি। নির্লিপ্ত থেকেছেন। এর অর্থ হলো, তার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো খবরাখবর না এলে তিনি এ নিয়ে বাড়তি চিন্তা করবেন না। আর আশপাশের চেয়ারম্যানগণ, বিশেষ করে পিলজঙ্গ, বাহিরদিয়া, যাত্রাপুর, তাদের কারও কারও কথা আরব আলীর কানে এসেছে। যাত্রাপুরের চেয়ারম্যান গাজী গুলজার নাকি বলেছেন, ‘ধান ভাঙালি যেমন আটা হয় না, আর গম ভাঙালি যেমন চাল হয় না, তেমনি উতালুদ্দিনের এ চিন্তাও কোনো দিন আলোর মুখ দেখবে না।’ পিলজঙ্গের চেয়ারম্যান শাহজাহান ডাকুয়া ওরফে ছোট খাঁ বলেছেন, ‘এর পেছনে উতালুদ্দিনের আসল উদ্দেশ্যটা কী, সেটা আগে বাইর করতি হবে।’ গ্রামবাসীর কারও কারও কথা উতালুদ্দিনের কানে আসে। আসাটাই স্বাভাবিক। কোনো কোনো সময় একটু বেশি বেশি আসে। নানাজনের মাধ্যমে আসে। সুবিধা হলো, আরব আলী যা যতটুকু বলে, তার কতটুকু সত্যি, আর কতটুকু কম সত্যি, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু অন্যদের কথার ভালোমন্দ, উদ্দেশ্য সব সময় তিনি ধরতে পারেন না। ধরতে চানও না। এরা তো সবাই বয়সে তার ছোট, অভিজ্ঞতা চেনা-জানায় কম। চেয়ারম্যান উতালুদ্দিন অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, গ্রামের সব মানুষ একটা স্থানে বসবাস করবে। বাকি সব জায়গা ছেড়ে দেওয়া হবে ফসলের জন্য, গাছের জন্য, পশুপাখির জন্য। এক জায়গায় বসবাসের ফলে মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠবে, একজনের বিপদে অন্যজন পাশে দাঁড়াবে, সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হবে। বাড়তি জমিতে হবে বাড়তি ফসল, শাল-সেগুন বা মেহগনি, গজারিগাছ বড় হবে, প্রকাণ্ড হবে। সুশীতল ছায়ায় জিরিয়ে নেবে ক্লান্ত পথিক। প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হবে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, পেয়ারা, তাল, ডাব, গোলাপজাম, বেল, আতা, সফেদা, বাতাবি লেবু। চেয়ারম্যান ঘরের দাওয়ায় বসে বসে ভাবেন। তিনি তো আর থাকবেন না, যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে তার, অথবা পরম করুণাময়ের ইচ্ছায় বেঁচে যেতে পারেন আর ১০-২০ বছর। যদি মানুষের জন্য, গ্রামবাসীর জন্য কিছুটা করে যেতে পারেন, তবে এত দিনের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হয়। এমন হতে পারে, কাজটা তিনি শুরু করলেন, শেষ করল অন্য কেউ। সামাদ মিয়া, লতিফ মেম্বার, হাসনা, রেহেনা বা অন্য কেউ। আজ শুক্রবার। উতালুদ্দিন চেয়ারম্যানের অবশ্য শুক্র, শনিবার নেই। সব দিনই তার কাছে শুক্রবার, আবার সব দিনই তার কাছে শনিবার। এখনো বিছানা ছাড়েননি। আরব আলী খাতাপত্র দেখে জানাল, আজ দুপুরে চারটে বিয়ের অনুষ্ঠান যেতে হবে। একটি বাগেরহাট সদরে, আরেকটি ফকিরহাট সদরে, বাকি দুটি ইউনিয়নের মধ্যেই। আরব আলী জানে, চেয়ারম্যান সব অনুষ্ঠানেই যাবেন। তবে কোনো অনুষ্ঠানে গিয়েই তিনি কিছু খান না। দাওয়াত কবুল করেন কেবল। দেখা দেন, কথাবার্তা বলেন, খবরাখবর নেন। বিয়ে যদি কোনো মেয়ের হয়, তবে ছেলের বাবা-মামা-দুলাভাইয়ের সঙ্গে বাড়তি দুটি কথা বলেন। এমনভাবে বলেন, যাতে তারা মনে করে যে তিনি মেয়েপক্ষের খুব ঘনিষ্ঠ। এরই মধ্যে চেয়ারম্যানের মুঠোফোনে তিন-চারটি মিসড কল আসে। আরব আলী বিরক্ত হয়। আজকাল কেউ মিসড কল দেয় নাকি? নিশ্চয়ই গাড়ল প্রফেসর। আজ তার মেয়ের বিয়ে। তাই স্মরণ করে দেওয়ার জন্য মিসড কল দিচ্ছেন। কেন, ফোন করা যায় না? ‘তুমি শুধু শুধু উত্তেজিত হচ্ছ আরব আলী, এই সকালবেলা।’ ‘খালি খালি টাকা নষ্ট করার দরকার কী! দাও, ফোনটা দাও দেখি, আমিই ওনারে একটা ফোন করে বলে দিই, টেনশন করতি হবে না, ঠিক ঠিক সময়ে চলে আসব। অন্য যারা দাওয়াত দিয়েছে, তাগেরও বলে দিই।’ ‘আগামী সপ্তাহে যারা দাওয়াত দিতি পারে, তাগোরও ফোন দেবেন নাকি?’ ‘তুই তো বড় বাড় বেড়েছিস আরব আলী। তোর বয়স হচ্ছে, না হলি দশবার কান ধরে ওঠবস করাতাম।’ চেয়ারম্যানের রুম থেকে কেটে পড়ে আরব আলী। চেয়ারম্যানের সঙ্গে সম্পর্কের খাতিরে অনেক সময় বেফাঁস অনেক কিছু বলে ফেলেÑযেমন আজ সকালে বলল। তবে চেয়ারম্যান অবশ্য এসব গায়ে মাখেন না। হাজার হোক কাজের মানুষ, তা না হলে এতগুলো বছর থাকতে পারত না। ঘণ্টাখানেক পরে আবার লেজ ঘুরিয়ে চেয়ারম্যানের ঘরে আসে আরব আলী। চেয়ারম্যান সাহেব গুঁড়ো মাজন দিয়ে দাঁত সাফ করছেন। হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করে, ‘তা টাকা দেবেনে কিডা। এত কম টাকার ব্যাপার না। কোটি কোটি টাকার ব্যাপার। এত নগদ টাকা কার বাপের পকেটে আছে?’ মাঝেমধ্যে আরব আলীকেও কিছুটা বিরক্ত মনে হয়। কোনো কোনো সময় কোনো কিছুরই অর্থ পরিষ্কার হয় না তার কাছে। কী দরকার এত কিছুর! তার চেয়ে যেমন আছে তেমন চললেই তো হয়! সাধারণ মানুষ তো তা-ই চায়! তারা ঘুম থেকে ওঠে। বাজারে যায়। মাছ, আনাজপাতি কিনে আনে, খায়দায়, দুপুরে ঘুমায়, বিকেলে আবার দোকানে বসে চা খায়, গল্পগুজব করে, রাতে বাড়ি ফিরে স্টার জলসা দেখে ঘুমাতে যায়। দিনে দিনে চুল-দাড়ি পাকে, বুড়ো হয়। এই তো মানুষের জীবন। আরব যখন এসব ভাবছে, তখনই চেয়ারম্যানবাড়িতে নানা কিসিমের লোকের পা পড়ছে। মেম্বাররা আসেন, সরকারী লোকেরাও আসেন। ‘আসসালামু আলাইকুম। আপনারা এসেছেন আমি খুব খুশি হইছি। সবাই বৈঠকখানায় বসেন। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।’ আরব আলী ও আরব আলী বলে ডাক পাড়তে পাড়তে ভেতর বাড়ির দিকে যান। উপজেলা প্রকৌশলী ইসমাইল হোসেন ছোকরা ধরনের মানুষ। ইসমাইল বললেন, মাননীয় চেয়ারম্যান সাহেব, আমরা আপনার প্রস্তাব শুনেছি। আপনি যদি ভৈরব নদী খননের উদ্যোগ নেন, সরকারের কোনো আপত্তি থাকবে না। ততক্ষণে বৈঠকখানা ও বৈঠকখানার বাইরে বিস্তর লোকজন। মেম্বার সবাই উপস্থিত, শুধু গোলাম মোস্তফার আসতে একটু দেরি হচ্ছে। গরুগুলোর খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করে তবেই আসবেন। এখন চারটি গরু, কম তো নয়। তবে গোলাম মোস্তফা কাজের লোক। ‘সামাদ ভাই দূরে কেন, কাছে এসে বসেন’Ñচেয়ারম্যানের এ আহ্বানের জবাবে সামাদ মেম্বার হাত ও মুখের ইশারায় জানান, কোনো অসুবিধা নেই। স্বেচ্ছাশ্রমিক ঠিক করা আছে। সবাই কাজে নেমে পড়তে প্রস্তুত। আজ সামাদ মেম্বারকে দেখে বড়ই বিগলিত হন চেয়ারম্যান সাহেব। এই সামাদ মেম্বার অন্তত দুইবার চেয়ারম্যান পদে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। অথচ আজ তাকে কতই না সহযোগিতা করছেন! প্রত্যেক মেম্বার প্রস্তুত। প্রত্যেকে ২০ জন করে স্বেচ্ছাশ্রমিক ঠিক করেছেন। এরাই শুরু করবে নদী খননের কাজ। কতটুকু খনন করা হবে, মাটি কোথায় ফেলা হবে, সব ঠিক করে দেবেন চেয়ারম্যান। অবশ্য তিনি ইউএনও সাহেব ও প্রকৌশলী সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে নেবেন। চেয়ারম্যান ঠিক করে রেখেছেন, যারা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করতে রাজি হয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে উপযুক্ত পাওনা মিটিয়ে দেবেন। ইউনিয়নের তহবিল আছে। তবে আগাম এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা দিতে চান না তিনি। মানুষের আগ্রহটা বুঝতে চান। মানুষ কতটা তাকে ভালোবাসে, সেটাও পরখ করার ইচ্ছা তার। চেয়ারম্যান সাহেব ভাবলেন, আজ যেহেতু বাড়ি-বৈঠকখানায় গ্রামের মানুষ, থানা-পুলিশের লোক, উপজেলা কাউন্সিলের লোক বেশি হাজির হয়েছেন, তাই হাজেরানে মজলিশের সামনে পরিকল্পনাটা আবার বলা যাক। চেয়ারম্যান সাহেব মুখে পান চাবানো অবস্থায় পানের বোঁটায় মাখানো চুন আরেকটু পোড়া জিহ্বায় মেখে নিলেন। পরিমাণে একটু বেশি হয়ে গেল কি না। খানিক বাদে আরব আলী এসে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা কপাল মুছে দিল। চেয়ারম্যান সাহেব এক ফাঁকে উঠে গিয়ে কুলি করে নেন। চেয়ারম্যানের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর হাততালিও পড়ল বেশ। নতুন কথা দুটি। মূলঘর গ্রামের নতুন আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে ভৈরব নদীর পাশে। একবারে তো আর হবে না। একটা ভবন নির্মাণ হয়ে গেলে কিছু পরিবার চলে আসবে। এভাবে পুরো কাজ শেষ হতে যদি ১০-২০ বছর লেগে যায় তো লাগবে। কারণ, গ্রামের মানুষের পক্ষে তো একবারে হাজার লাখ টাকা দেওয়া সম্ভব হবে না। কোন প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, এনজিও যদি এগিয়ে আসে, তো তাদের স্বাগত! বক্তৃতার মাঝে কেবল সামাদ মেম্বার হাত তোলেন। ‘বলছিলাম, জনগণ রাজি হবে তো!’ চেয়ারম্যান সাহেব প্রসন্ন হেসে বলেন, ‘সে দায়িত্ব না হয় আমিই নিলাম। আর আপনি চাইলে আমার সঙ্গে থাকতি পারেন। আমরা দুই বুড়ো গ্রামের প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বোঝাব। কি, রাজি তো?’ সামাদ মেম্বার গলায় হেলে পড়া সূর্যের তেজ এনে বলেন, কেন নয়? (শেষ)
×