ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লিটন আব্বাস

সংগ্রামী নারী জয়িতা সোনালী আক্তার

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

সংগ্রামী নারী জয়িতা  সোনালী আক্তার

যুব ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রথম জয়িতা অন্বেষণে (২০১৩) খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মানে ভূষিত হন কুষ্টিয়ার কুমারখালী সোনালী হস্তশিল্পের পরিচালক সোনালী আক্তার। অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনকারী ক্যাটাগরিতে এ কৃতিত্ব দেখান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে সকল বিভাগীয় জয়িতাদের (২০১৪) সংবর্ধনা দেয়া হয়। অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে সংগ্রামী জীবন ও সোনালী হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠায় একজন নারীর ত্যাগ, শ্রম ও কষ্ট অন্যান্য নারীর সামনে অনন্য দৃষ্টান্ত। ইচ্ছেশক্তি আর প্রবল স্বপ্ন থাকলে কিভাবে পিছিয়ে পড়া একজন নারী সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তার উজ্জ্বল উদাহরণ কুমারখালীর সোনালী আক্তার। একজন সংগ্রামী নারী সম্মানে ভূষিত হওয়া যেমন গৌরবের তেমনি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সাফল্য অর্জনও মর্যাদার। নি¤œœ আয়ের পিতা-মাতার চার সন্তানের মধ্যে সবার বড় সোনালী। পরিবারে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তার বাবা তাকে বেশিদূর লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। এসএসসি পাস করার পর ১৯৯৭ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে জসিম উদ্দিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছা থাকায় তার স্বামী কুমারখালী ডিগ্রী কলেজে ভর্তি করে দেন। কিন্তু স্বামীরও আর্থিক দীনতার কারণে লেখাপড়া করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তার স্বামী একজন ক্ষুদ্র কাপড়ের ব্যবসায়ী। বিয়ের পর থেকে স্বামীর সংসারে ছিল অভাব অনটন। পরবর্তীতে স্বামীর উৎসাহে ২০০৪ সাল থেকে কুমারখালী বিআরডিবি থেকে মাত্র ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দুস্থ ও বেকার ৪-৫ জন নারীর সমন্বয়ে ‘সোনালী হস্তশিল্প’ নামে একটি হস্তশিল্পের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বাবার দেয়া সামান্য গহনা বিক্রি করে ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেন। ২০০৪ সালে যখন এই হস্তশিল্প গড়ে ওঠে প্রথমদিকে বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হয় পরিবারে প্রথম দিকে স্বামী ছাড়া অন্যরা ভাল চোখে গ্রহণ করত না। অনেক কষ্ট করে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারী কর্মী যোগাড় করতে তাকে অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। সমাজের নি¤œ আয়ের অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের এই হস্তশিল্পে কাজ করতে বাধা দিত। প্রথম দিকে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে কাজের জন্য বাইরে যাওয়া, একদিকে যেমন ছিল পুঁজির স্বল্পতা, সন্তান রেখে বাইরে কাজ দেখতে যাওয়া সামাজিকভাবে গ্রামের অনেকে নেতিবাচক চোখে দেখত। সংসারের কাজের সমস্যা দেখা দিলে সোনালীর স্বামী তাকে যথেষ্ট সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল। সবকিছু উপেক্ষা করে সব প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতে তিনি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। অবশেষে তিন বছর পর হস্তশিল্পের তৈরি শাড়ি স্থানীয় ও বাংলাদেশের বিভিন্ন বাজারে ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি হওয়ায় ব্যবসা সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। পাশাপাশি নারী কর্মীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ব্যবসার উর্র্ধমুখী সম্প্রসারণে বর্তমানে ১২০০ নারী শ্রমিক কারখানায় কাজ করে। তারা নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করছে এবং সাফল্য লাভ করেছে। কারখানা প্রতিষ্ঠার সময় শাড়ি তৈরির জন্য ৪-৫টা ফ্রেম দিয়ে শুরু করে বর্তমানে প্রায় ৫০০টি ফ্রেমে ১২০০ জন নারী তাদের বাড়িতে বসে সংসারের কাজের পাশাপাশি সোনালী হস্তশিল্পে নান্দনিক ছোঁয়ায় সুন্দর সুন্দর শাড়ি তৈরি করে বাজারে সুনাম অর্জন করছে। কারখানায় কাজ করছে বেতনভুক্ত ২২ জন কর্মচারী। শাড়ি তৈরির পর নিপুণ তুলিতে ডিজাইন সম্পন্ন করছেন। শাড়ির থান কাপড়ে বিভিন্ন ডিজাইন এঁকে দেয়ার পর মেয়েরা শাড়িতে চুমকি, পাথর, সুতার (কারচুপির) কাজ করে দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটাচ্ছে। এতে করে নারীর কর্মসংস্থান ও কর্মক্ষম ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হওয়ার পাশাপাশি নিজেদের সংসারের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সমাজ, দেশ, জাতি গঠনসহ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে নারীরা। এক্ষেত্রে একজন নারী প্রতিমাসে ঘরে বসে গৃহকর্মের পাশাপাশি বর্তমানে ৪-৫ হাজার টাকা উপার্জন করছে। নারীরা পূর্ণ মাত্রায় কাজ করলে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা উপার্জন সম্ভব। নারীদের এমন স্বাবলম্বী ও সোনালী হস্তশিল্পের বিকাশ দেখে কুমারখালীতে বেশকিছু ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কুমারখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার নারী শ্রমিক এই পেশার সঙ্গে জড়িত থেকে অর্থনীতিতে ও পারিবারিকভাবে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করছে। শর.ষরঃড়হ৮৪@মসধরষ.পড়স
×